জামায়েতে ইসলামি-০২
জামায়াতে
ইসলামি-০২
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।
পূর্বে যে তিনটি ফির্কার (কাদিয়ানি, ব্রেলভী বা রিজভী,
দেওবন্দী) আকিদা আলোচনা করছি তাদের প্রতিটি
আকিদা তারা বিশ্বাস করে, প্রচার করে। তাই তাদের আকিদা সহজে জানতে পেরেছি কিন্তু
জামাতের রাজনৈতিক দর্শণ ছাড়া, এমন কোন একক বিশ্বাস নেই যা তার প্রচার করে এবং যাতে
বলা যাবে এটাই তাদের আকিদা। তবে জামায়েতে
ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর লেখা সম্পর্কে উপমহাদেশের খ্যাত
নামা বেশ কয়েক জন আলেম আপত্তি তূলেছেন, এমন কি অনেকে আবার বই আকারে প্রকাশ করেছেন।
তাদের অভিযোগ সমূহ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর পাশাপাশি জামায়েতে ইসলামির উপর চাপান
হয়। এর কতগুলি জামায়েতে ইসলামি স্বীকার
করে আবার অনেকগুলি অস্বীকার করে। কাজেই যেগুলি তারা স্বীকার করে সেগুলি তাদের
আাকিদা বলা যাবে, আর যে গুলী অস্বীকার করে সেগুলি তাদের আকিদা নয়।
জামায়েতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর লেখা
সম্পর্কে অভিযোগ সমূহ যা জামায়েতে ইসলামি বিরুদ্ধে আনা হয়, সেই সকল অভিযোগ সমূহ চারটি
ভাগে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
ক। যে সকল অভিযোগ জামায়েতে ইসলামি স্বীকার করে।
খ। যে সকল অভিযোগ জামায়েতে ইসলামি অস্বীকার করে।
গ। যে সকল অভিযোগ একেবারে অমূলক বা সমালোচনার জন্যই সমালোচনা
করা।
ঘ। ফিকহি মাসলা মাসায়েল সম্পর্কে সমালোচনা, অভিযোগ বা
মতভেদগুলি আলোচনা।
ক।
যে সকল অভিযোগ জামায়েতে ইসলামি স্বীকার করে।
০২। সাহাবায়ে কেরাম সত্যের
মাপকাঠি হওয়া প্রসঙ্গে
০৩। তাকলীদ সম্পর্কে
০৪। সুফিবাদ সম্পর্কে
০৫। ইমাম
মাহদী আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে
০৬। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি
মুল ইবাদাত কি না, এ প্রসঙ্গে
খ।
যে সকল অভিযোগ জামায়েতে ইসলামি অস্বীকার
করে।
০১। সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার প্রসঙ্গে
০২। মনগড়া
তাফসির করা সম্পর্কে
০৩। ঈসা
আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে।
০৪। কুরআন
ও ইসলাম সর্বযুগে সংরক্ষিত কি না, এ প্রসঙ্গে।
গ।
যে সকল অভিযোগ একেবারে অমূলক।
১। এ অভিযোগ মাওলানা মওদুদীর রচিত কোন গ্রন্থেই পাওয়া যায় না।
২। এ অভীযোগের অধিকাংশই কাট সাট করা বা মুল বক্তব্য আড়াল করে
রাখা হয়েছে।
৩।
ব্রেলভীদের মণগড়া আকিদার কিছু অমুলক অভিযোগ।
ঘ। ফিকহি মাসলা মাসায়েল সম্পর্কে
সমালোচনা, অভিযোগ বা মতভেদগুলির আলোচনা।
০১। ইসলামি দাড়ির সীমা
নির্ধারন সম্পর্কে।
০২। সেহরী
ও ইফতারের সময় সীমা নির্ধারনের প্রসঙ্গে।
০৩। সিজদার আয়াত পড়ে বা শুনে
বিনা অজুতে সিজদা প্রদান প্রসঙ্গে।
০৪। খোলা তালাক সম্পর্তে মতভেদ।
০৫। মোতা বিবাহ সম্পর্কে জায়েয, না জায়েয সম্পর্কে মওদূদীর অবস্থান।
০৫। মোতা বিবাহ সম্পর্কে জায়েয, না জায়েয সম্পর্কে মওদূদীর অবস্থান।
০৬।
আল্লাহে আইন জেনা শাস্তি কে জুলুম বলার অপবাদ।
০৭। দুই সহোদর
বোন কে একসাথে বিবাহ করা জায়েয প্রসঙ্গে। ০৮। সিনেম দেখ যায়েজ হোওয়া সম্পর্কে।
০১। নবীদের নিষ্পাপতা জামাতে ইসলামির আকিদা।
যে সমস্ত মাসআলার উপর ভিত্তি করে মাওলানা মওদূদী (রাহঃ) কে কাফির, পথভ্রষ্ট, খারিজী, কাদিয়ানী ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে সে গুলোর মধ্যে অন্যতম হল নবীদের নিষ্পাপতা।
ক। সোলাইমান আলাইহিস সালাম ও উরিয়ার স্ত্রীর ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা প্রসঙ্গে।
খ। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ক্ষনিকের
শির্কে গুনাহ করেছিল।
গ। ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে রিসালতের দায়িত্ব
পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি
প্রসঙ্গে।
ঘ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়তের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রসঙ্গে।
মাওলানা মওদূদী (রাহঃ) তার নির্বাচিত রচনাবলীতে সোলাইমান আলাইহিস সালাম ও উরিয়ার স্ত্রীর ঘটনা প্রবাহ বর্ণনার এক পর্যায় লিখেন, সোলাইমান উরিয়ার স্ত্রী কে তালাক দিতে বলে ছিলেন। এই ব্যাখ্যা অনেকে গ্রহন করতে দ্বিধা করবে কারন এই যে, নবীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভুল ভ্রান্তির অভিযোগ তোলা নবীদের নিষ্পাপ হওয়ার আকিদা পরিপন্থী বলে মনে হয়। কিন্তু যারা এরুপ মতামত পোষণ করেন তারা সম্ভবত এ ব্যবপারটি গভীরভাবে চিন্তা ভারনা করেনি যে, নিস্পাপ হওয়াটা আসলে নবীদের জম্মগত অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয়, বরং আল্লাহ তাদের নবুয়ত নামক সুমহান পদটির দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠভাবে পালন করার সুযোগ দানের জন্য একটা হিকমত ব্যবস্থা হিসাবে ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছেন। নচেৎ আল্লাহ তায়ালা এই সংরক্ষমুলক ব্যবস্থা যদি ক্ষনিকের জন্যও তাদের ব্যাক্তিস্বত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাহলে সাধারন মানুষের যেমন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে তেমনি নবীদের ও হতে পারে। এটা একটা বড়ই মজার করা যে, আল্লাহ কোন না কোন সময় তার নিজের সংরক্ষন ব্যাবস্থা উঠিয়ে দিয়ে দু-একটি ভুল-ত্রুটি ঘটে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, যাতে মানুষ নবীদের কে সৃষ্টিকর্তা মনে না করে। (নির্বাচিত রচনাবলী দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪; আধুনিক প্রকাশনি’ প্রকাশ কাল-১৯৯১)।
মহান
আল্লাহ বলেন,
قَالَ
يَـٰنُوحُ إِنَّهُ ۥ
لَيۡسَ مِنۡ أَهۡلِكَۖ إِنَّهُ ۥ عَمَلٌ غَيۡرُ صَـٰلِحٍ۬ۖ فَلَا
تَسۡـَٔلۡنِ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۖ إِنِّىٓ أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ
ٱلۡجَـٰهِلِينَ (٤٦)
জবাবে
বলা হলো, “হে
নূহ! সে
তোমার পরিবারভুক্ত নয়৷ সে তো অসৎ কর্মপরায়ণ৷ কাজেই তুমি
আমার কাছে এমন বিষয়ের আবেদন করো না যার প্রকৃত তত্ত্ব তোমার জানা নেই৷ আমি
তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি,
নিজেকে অজ্ঞদের মতো বানিয়ে ফেলো না”৷ (সুরা হুদের
৪৬)।
এরপর
হুদের ৪৬ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা মওদূদী (রাহঃ) তাফহিমুল কুরআনে লিখেন, এ
উক্তি দেখে কারো এ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, হযরত নূহের (আ) মধ্যে ঈমানী
চেতনার অভাব
ছিল অথবা তাঁর ঈমানে জাহেলিয়াতের কোন গন্ধ ছিল। আসল কথা হচ্ছে, নবীগণও
মানুষ। আর
মুমিনের পূর্ণতার জন্য যে সর্বোচ্চ মানদণ্ড কায়েম করা হয়েছে সর্বক্ষণ তার উচ্চতম
শিখরে আরোহণ করে থাকা কোন মানুষের সাধ্যায়াত্ত নয়। কোন কোন সময় কোন নাজুক
মনস্থাত্বিক অবস্থায় নবীর মতো উচ্চ মর্যদাসম্পন্ন লোকও মুহূর্তকালের জন্য হলেও
নিজের মানবিক দুর্বলতার কাছে পরাস্ত হন। কিন্তু যখনই তিনি অনুভব করেন অথবা মহান
আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর মধ্যে এ অনুভূতি জাগানো হয় যে, তিনি
কাংখিত মানের নিচে নেমে যাচ্ছেন তখনই তিনি
তাওবা করেন এবং নিজের ভুলের সংশোধন করে নেবার ব্যাপারে
এক মুহূর্তও ইতস্তত করেন না। হযরত নূহের নৈতিক উচ্চমানের এর চেয়ে
বড় প্রমাণ
আর কি হতে পারে যে, জওয়ান
ছেলেকে চোখের সমানে ডুবে যেতে দেখছেন! এ দৃশ্য দেখে তাঁর
কলিজা ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছে। কিন্তু যখনই আল্লাহ সবাধান করে জানিয়ে দেন, যে ছেলে
হককে ত্যাগ করে বাতিলের সহযোগী হয়েছে তাকে নিছক তোমার ঔরসজাত বলেই নিজের ছেলে
মনে করা একটি জাহেলী ভাবাবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। তখনই তিনি নিজের মানসিক আঘাতের
ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে ইসলামের কাংখিত চিন্তা ও ভাবধারার দিকে ফিরে আসেন।
এভাবে নবীদের নিষ্পাপতা নিয়ে মাওলানা মওদুদীর খোলামেলাভাবে অনেক কিছু লিখেছেন এবং এর বিস্তার সমালোচনাও হয়েছে। এ সম্পর্কে তার বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে, তার আরোপিত অভিযোগের পক্ষে তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করে, জামাত ঘরানার আলেম মাওলানা বশিরুজ্জামান, “সত্যের আলো” নামক বইয়ের ১৭-২৩ পৃষ্ঠায় নবীদের নিষ্পাপতা নিয়ে যে আলোচনা করেছের, তার সার সংক্ষেপ তুলে ধরছিঃ
মওদূদী (রাহ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “তাফহীমাত” দ্বিতীয় খন্ডের ৪৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত দাউদ (আঃ) এর কিচ্ছা বর্ণনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে এ সম্পর্কে লিখেনঃ
“এবং এটি একটি সূক্ষ্ম রহস্য যে, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে প্রত্যেক নবী থেকে কোন না কোন সময় তার হেফাজত উঠিয়ে দিয়ে দু-একটি ভুল-ত্রুটি হতে দিয়েছেন, যাতে মানুষ নবীদেরকে খোদা না বুঝে এবং জেনে নেয় যে, এরা খোদা নন বরং মানুষ।” মাওলানার উল্লিখিত কথা গুলোই হচ্ছে তাকে এ জঘন্য ও মারাত্মক আখ্যায় আখ্যায়িত করার মূল কারন।
সন্মানিত পাঠক বৃন্দ, আসুন আমরা তাহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের নির্ভরযোগ্য কিতাব এবং নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কিরামদের মতের সাথে মাওলানার কথাগুলো মিলিয়ে দেখি সত্যিই কি তিনি এ ধরণের বিষেষণে বিশেষিত হওয়ার যোগ্য?
ক. আল্লামা সা’দুদ্দীন মাসউদ তাফতাজানী (রাহঃ): আল্লামা সা’দুদ্দীন মাসউদ তাফতাজানী (রাহঃ) তার লিখিত “শারহে আকা’ঈদে নাসাফী”তে (যে কিতাবটি এ উপমহাদেশের সরকারী, আধাসরকারী এবং কওমী মাদ্রাসাগুলোতে পড়ানো হয়) বলেনঃ
নবীগন মিথ্যা হতে পবিত্র। বিশেষ করে শরীয়ত ও রিসালত প্রচারের সহিত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মধ্যে তারা মিথ্যা হতে সম্পূর্ন পবিত্র। ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হতে পবিত্র হওয়ার ব্যপারে সকলেই একমত,তবে ভুলবশতঃ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা হতে পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে। অধিকাংশ আলেমদের মতে তারা এই প্রকার মিথ্যা হতেও পবিত্র। অপরাপর যাবতীয় গুনাহ হতে নবীগণ পবিত্র হওয়া সম্পর্কে আলোচনা আছে। উহা এই যে, তাহারা কুফরী হতে সম্পূর্ন পবিত্র। অহি আসার পূর্বে হউক কিংবা পরে। এতে কারও মতভেদ নেই। অনুরুপভাবে তারা জমহুর বা অধিকাংশ উলামাদের নিকট ইচ্ছাকৃত কবীরা গুণাহ হতেও পবিত্র।
হাশাবিয়া সম্প্রদায় এর বিপরিত মত পোষণ করে। তবে মতভেদ
রয়েছে এ কথার মধ্যে যে, কবিরা গুনাহ হতে পবিত্র থাকা ও বিরত থাকা কি বর্ণিত দলীলের
দ্বারা প্রমানিত, না বিবেকের দ্বারা। আর ভুলবশতঃ কবীরা গুনাহ হওয়ার ব্যাপারে
অধিকাংশ উলামাদের মত হল যে উহা জায়েয ও সম্ভব আছে। ছগীরা গুনাহ জমহুর উলামাদের মতে
নবীগন হতে ইচ্ছাকৃতও হতে পারে। কিন্তু জুব্বাই ও তাহার অনুসারীদের অভিমত এর
বিপরিত। আর অনিচ্ছাকৃত ভুলের দ্বারা ছগীরা গুনাহ হওয়া সকলের ঐক্যমতে জায়েয আছে,
কিন্তু যা ঘৃণিত স্বভাবের পরিচয় দেয় ঐ
প্রকারের ছগীরা জায়েয নয়। যেমন- এক লোক যা চুরি করা ও ওজনে কম দেওয়া এ ব্যাপারে মুহাক্কে’ক বা নির্ভর যোগ্য আলেমগণ শর্ত করেছেন যে,
তাদেরকে এর উপর যেন সতর্ক করা হয়। যাতে
তারা বিরত থাকতে পারেন। এ সব মতভেদ অহি নাযিল হওয়ার পরের অবস্থায়। কিন্তু অহি
নাযিল হওয়ার পূর্বে নবীগণ হতে কবীরা গুনাহ নিষিদ্ধ ও অসম্ভব হওয়ার কোন দলীল নেই। ( দেখুন শারহে আকা’ঈদে নাসাফী,
ইছমতে আম্বিয়া আলোচনা।)
খ.
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীঃ তিনি তার লিখিত “ইছামানুল আম্বিয়া”
নামক কিতাবে বলেনঃএবং আমরা যা বলি তা হচ্ছে যে, আম্বিয়ায়ে কিরাম নবুয়াত প্রাপ্তির সময় থেকে ইচ্ছকৃত কবীরা এবং ছগীরা গুণাহ থেকে পবিত্র। কিন্তু ভুল বশতঃ কবীরা ও ছগীরা গুণাহ হতে পারে। (দেখুন পৃষ্ঠা নং-২৮)
গ. আল্লামা আলুসীঃ তিনি কোরআন শরীফের আয়াত এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেনঃ
বাহ্যিক ভাবে আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, আদম (আঃ) থেকে যা সংগঠিত হয়েছিল তা কবীরা গুনাহ ছিল। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযীর কথা থেকেও এমনটিই বুঝা যায়। (দেখুন পৃষ্ঠা নং ২৭৪, খন্ড নং-১৬)
ঘ. হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর (রঃ) অভিমতঃ মুফতি মোহাম্মদ শফী (রাহ) তার লিখিত “মাজালিসে হাকীমুল উম্মত”
নামক কিতাবে থানবী সাহেবের অভিমত উল্লেখ
করেনঃ আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে তার নৈকট্যের যে উচ্চ মর্যাদা দান
করেছেন এবং তাদেরকে সমস্ত গুনাহ থেকে পবিত্র রেখেছেন,
যেমন এটা তার রহমত ও নিয়ামত,
এমনি ভাবে কোন কোন সময় নবীদের থেকে কোন
কোন ব্যপারে ভুল ত্রুটি হওয়ার যে ঘটনা সমুহ কোরআন শরীফের মধ্যে উল্লিখিত হয়েছে
এগুলোও প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও রহমত। এর মধ্যে এক বড় ফায়দা এটাও যে,
মানুষের যেন নবীদের খোলা হোয়ার সন্দেহ না
হয়। ভুলত্রুটি হওয়া এবং এর উপর আল্লাহতায়ালার সতর্ক করা এটাই পরিষ্কার করে দেয় যে,
নবীরাও আল্লাহ তায়ালার বান্দাহ। (দেখুন পৃষ্ঠা নং- ৬৫)
ঙ.
আল্লামা সায়িদ সুলাইমান নদভী সাহেব বলেনঃমানুষ হিসেবে তাদের থেকে ও ভুল ত্রুটি হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার ওহীর দ্বারা এ সমস্ত ভুল ত্রুটিরও সংশোধন করে থাকেন। (দেখুন সিরতুন্নবী, খন্ড নং- ৪ পৃষ্ঠা নং-৭০)
মন্তব্যঃ পাঠক নিজেই সিদ্ধান্ত
নিবেন।
খ। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ক্ষনিকের শির্কে গুনাহ করেছিল।
এই ব্যাপারে আবুল আলা মওদুদী বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে মাওলানা মনসুরুল হক সম্পাদিত “মিস্টার মওদুদীর নতুন
ইসলাম”, মাওলানা হাবিবুর রহমানের লেখা “জামায়াতে ইসলাম সে
মুখালাতফাত কিউ” এবং মাওলানা আশরাফ আলী সম্পাদিত
“মওদুদীর
ইসলামের সরূপ” বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য। তারা
সকলে তাফহিমুল কুরআন ১ম খন্ড, ৫৫৮ পৃষ্ঠার
রেফারেন্সে বলেন, “ আলাইহিস সালাম ক্ষনিকের জন্য শির্কের গুনাহে নিজ্জিত
ছিলেন”। বাংলায় অনুদিত তাফহিমুল কুরআনের
কোন খন্ডেন পৃষ্ঠার সংখ্যা ৩০০ অতিক্রম করেনি। তাই খুজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে
তাফহিমুল কুরআন তৃতীয় খন্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠার পাওয়া গেল যা প্রকাশ করেছে আধুনিন
প্রকাশনি। যদি রেফারেন্স দেয়া হত সূরা আনআমের ৭৮ নম্বর আয়াতের ৫৩ নম্বর টিকার শেষ
অংশ, তা হলে আর কষ্ট হত না।
সে যা হোক জামায়াতে ইসলামি এ
অভিযোগ অস্বীকার করে। মাওলানা বশিরুজ্জামান, “সত্যের আলো” নামক বইয়ে মাওলানা মওদুদীর বিরুদ্ধে
আনিক এ অভিযোগ জঘন্য মিথ্যা অপবাদ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তাহলে আসুন ব্যাপারে আবুল আলা মওদুদী
তাফহিমুল কুরআন কি লিখেছেন। মহান
আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا رَءَا ٱلشَّمۡسَ بَازِغَةً۬
قَالَ هَـٰذَا رَبِّى هَـٰذَآ أَڪۡبَرُۖ فَلَمَّآ أَفَلَتۡ قَالَ يَـٰقَوۡمِ
إِنِّى بَرِىٓءٌ۬ مِّمَّا تُشۡرِكُونَ (٧٨)
অর্থঃ এরপর যখন সূর্যকে দীপ্তিমান দেখলো তখন বললো, এ আমার রব, এটি সবচেয়ে বড়! কিন্তু তাও যখন ডুবে গেলো তখন ইবরাহীম চীৎকার করে বলে উঠলো, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা!
তোমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করো তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই৷ (সূরা আনআম ৬:৭৮)।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ৫৩ নম্বর
টিকার শেষ অংশে বলেন,
এ প্রসংগে আর একটি প্রশ্নও দেখা দেয়। সেটি হচ্ছে, হযরত ইবরাহীম
(আ)
যখন তারকা
দেখে বলেন,
এ আমার
রব,
আবার যখন
চাঁদ ও সূর্য দেখে তাদেরকেও নিজের রব বলে ঘোষণা দেন,
সে সময়
কি তিনি সাময়িকভাবে হলেও শিরকে লিপ্ত হননি?
এর জওয়াব হচ্ছে, একজন সত্যসন্ধানী তাঁর সত্য অনুসন্ধানের পথে পরিভ্রমণকালে
মাঝপথে যেসব মনযিলে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য থামে আসল গুরুত্ব সে মনযিনলগুলোর নয় বরং আসল গুরুত্ব হচ্ছে সে গন্তব্যের যে,
দিকে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন এবং যেখানে গিয়ে তিনি অবস্থান করেন। মাঝখানের এ মনযিলগুলো অতিক্রম করা প্রত্যেক সত্যসন্ধানীর জন্য অপরিহার্য। সেখানে অবস্থান হয় অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে, অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে অবস্থান করা হয় না। মূলত এ অবস্থান হয় জিজ্ঞাসা সূচক ও প্রশ্নবোধক, সিদ্ধান্তমূলক নয়। অনুসন্ধানী যখন এ মনযিলগুলোর কোনটিতে অবস্থান করে বলেন, "ব্যাপারটি এমন" তখন একটি মূলত তার শেষ সিন্ধান্ত হয় না বরং তার একথা বলার উদ্দেশ্য হয়, জিজ্ঞাসা মূলক। অর্থাৎ "ব্যাপারটি কি এমন৷" তারপর পরবর্তী অনুসন্ধানে এর নেতিবাচক জবাব পেয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যান। তাই পথের মাঝখানে যেখানে যেখানে থামেন সেখানেই তিনি সাময়িকভাবে কুফরী বা শিরক করেন একথা সম্পূর্ণ ভুল। কাজেই হযরত ইবরাহীম আলাইহসি সালাম তাঁর সত্য অনুসন্ধানের পথে কোন প্রকার শিরকে লিপ্ত হননি।
মন্তব্যঃ এ থেকে প্রমানিত হয় আবুল আলা মওদুদী বক্তব্য
ভুলভাবে উপাস্থাপন করা হয়েছে।
গ।
ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে রিসালতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি
প্রসঙ্গে।
মহান
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
فَلَوۡلَا كَانَتۡ
قَرۡيَةٌ ءَامَنَتۡ فَنَفَعَهَآ إِيمَـٰنُہَآ إِلَّا قَوۡمَ يُونُسَ لَمَّآ
ءَامَنُواْ كَشَفۡنَا عَنۡہُمۡ عَذَابَ ٱلۡخِزۡىِ فِى ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا
وَمَتَّعۡنَـٰهُمۡ إِلَىٰ حِينٍ۬ (٩٨)
অর্থঃ এমন কোন দৃষ্টান্ত আছে কি যে, একটি জনবসতি চাক্ষুস
আযাব দেখে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার জন্য সুফলদায়ক প্রমাণিত হয়েছে? ইউনুসের কওম ছাড়া। (এর কোন নজির নেই)
তারা যখন ঈমান এনেছিল তখন অবশ্যি আমি তাদের ওপর থেকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনার
আযাব হটিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদেরকে একটি সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছিলাম৷
(সুরা ইউনুস ১০:৯৮)।
সুরা
ইউনুস এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহিমুল কুরআনের লিখেন, কুরআনে এ ঘটনার দিকে তিন
জায়গায় শুধুমাত্র ইংগিত করা হয়েছে। কোন বিস্তারিত বিবরণ সেখানে দেয়া হয়নি। তাই
আযাবের ফায়সালা হয়ে যাবার পর কারোর ঈমান আনা তার জন্য উপকারী হয় না। আল্লাহ তার এ
আইন থেকে হযরত ইউনুসের কওমকে কোন কোন কারণে নিষ্কৃতি দেন তা নিশ্চিতয়তার সাথে
বলা সম্ভব নয়। তবুও কুরআনের ইশারা ও ইউনুসের সহীফার বিস্তারিত বিবরণ থেকে এত টুকি
জানা যায় যে, ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে রিসালতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হয়ে
গিয়ে ছিল। এবং খুব সম্ভব সময় আসার
পূর্বে অধৈর্য হয়ে তিনি তার স্থান ত্যাগ করে ছিলেন। এ কারনে আযাব আসার পূর্বাভা্স
দেখতে পেয়ে তার কওমের লোকজন তওবা করল ও ক্ষমা চাইল। তখন আল্লাহ তাদের ক্ষমা করলেন।
কুরআনে এ ঘটনার দিকে তিন জায়গায় শুধুমাত্র ইংগিত করা হয়েছে। কোন বিস্তারিত বিবরণ সেখানে দেয়া হয়নি। (দেখুন আম্বিয়া ৮৭-৮৮ আয়াত ,আস সাফফাত ১৩৯-১৪৮ আয়াত ও আল কলম ৪৮-৫০ আয়াত।) তাই আযাবের ফায়সালা হয়ে যাবার পর কারোর ঈমান আনা তার জন্য উপকারী হয় না। আল্লাহ তার এ আইন থেকে হযরত ইউনুসের কওমকে কোন কোন কারণে নিষ্কৃতি দেন তা নিশ্চিতয়তার সাথে বলা সম্ভব নয়। বাইবেলে যোনা ভাববাদীর পুস্তক নাম দিয়ে যে সংক্ষিপ্ত সহীফা লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে কিছু বিবরণ পাওয়া গেলেও বিভিন্ন কারণে তা নির্ভরযোগ্য নয়। প্রথমত তা আসমানী সহীফা নয় এবং ইউনুস (আ) এর লেখাও না। বরং তার তিরোধানের চার পাচশো বছর পর কোন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ইউনূসের ইতিহাস হিসেবে লিখে এটিকে পবিত্র গ্রন্থসমূহের অন্তরভুক্ত করেন। দ্বিতীয়ত এর মধ্যে কতক একেবারেই আজেবাজে কথাও পাওয়া যায়। এগুলো মেনে নেবার মত নয়। তবুও কুরআনের ইশারা ও ইউনুসের সহীফার বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে কুরআনের তাফসীরকরগণ যে কথা বলেছেন তাই সঠিক বলে মনে হয়। তারা বলেছেন, হযরত ইউনূস (আ) যেহেতু আযাবের ঘোষনা দেবার পর আল্লাহর অনুমতি, ছাড়াই নিজের আবাস্থল ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন তাই আযাবের লক্ষণ দেখে যখন আসিরীয়ারা তওবা করলো এবং গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইলো তখণ মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাদের কে ক্ষমা করে দিলেন। কুরআন মজীদে আল্লাহর বিধানের যে মৌলক নিয়ম কানুন বর্ণনা করা হয়েছে তার একটি স্বতন্ত্র ধারা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ কোন জাতিকে ততক্ষণ আযাব দেন না যতক্ষণ না পূর্নাঙ্গ দলীল প্রমাণ সহকারে সত্যকে তাদের সামনে সুষ্পষ্ট করে তোলেন। কাজেই নবী যখন সংশ্লিষ্ট জাতির জন্য নির্ধারিত অবকাশের শেষ মূহূর্তে পর্যন্ত উপদেশ বিতরণের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেননি এবং আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজ দায়িত্বে হিজরাত করে চলে গেছেন তখন আল্লাহর সুবিচার নীতি এ জাতিকে আযাব দেখা সমীচীন মনে করেনি। কারণ তার কাছে পূর্নাঙ্গ দলীল প্রমাণ সহকারে সত্যকে সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরার আইনগত শর্তাবলী পূর্ণ হতে পারেনি।
মহান
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
وَذَا ٱلنُّونِ إِذ
ذَّهَبَ مُغَـٰضِبً۬ا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقۡدِرَ عَلَيۡهِ فَنَادَىٰ فِى
ٱلظُّلُمَـٰتِ أَن لَّآ إِلَـٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَـٰنَكَ إِنِّى ڪُنتُ مِنَ
ٱلظَّـٰلِمِينَ (٨٧)
অর্থঃ আর মাছওয়ালাকেও আমি অনুগ্রহ
ভাজন করেছিলাম৷স্মরণ করো যখন সে রাগান্বিত হয়ে চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও
করবো না৷ শেষে সে অন্ধকারের মধ্য থেকে ডেকে উঠলো। “তুমি ছাড়া আর কোনো
ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি
অপরাধ করেছি৷” (সুরা আম্বিয়া ২১:৮৭)।
সুরা
আম্বিয়া এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহিমুল কুরআনের ৮৭ নম্বর টিকায় লিখেন, তিনি (ইউনুস
আঃ) নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যান। আল্লাহর পক্ষ থেকে তখনো
হিজরত করার হুকুম আসেনি, যার ফলে তাঁর পক্ষ
থেকে নিজের কর্তব্য ত্যাগ করা জায়েয হতে পারতো।
এই
আয়াতের ও সুরা ইউনুস ৯৮ আয়াত যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যার অভিযোগ
ব্যাপারে তিনি নিজেই সুরা আম্বিয়া ৮৫ নম্বর
টিকায় লিখেন,
হযরত ইউনুসের (আ) এ ঘটনা সম্পর্কে আমি সূরা ইউনুস ও সূরা আম্বিয়ার
ব্যাখ্যায় যা কিছু লিখেছি সে সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি উঠিয়েছেন । তাই সংগতভাবেই
এখানে অন্যান্য মুফাসসিরগণের উক্তিও উদ্ধৃত করছিঃ
বিখ্যাত মুফাসসির কাতাদা সুরা ইউনুসের ৯৮
আয়াতের ব্যাখ্যার বলেন, “এমন কোন জনপদ দেখা যায়নি যার অধিবাসীরা কুফরী করেছে এবং
আযাব এসে যাবার পরে ঈমান এনেছে আর তারপর তাদেরকে রেহাই দেয়া হয়েছে। একমাত্র
ইউনুসের সম্প্রদায় এর ব্যতিক্রম। তারা যখন তাদের নবীর সন্ধান করে তাঁকে না পেয়ে
অনুভব করলো আযাব নিকটে এসে গেছে তখন আল্লাহ তাদের মনে তাওবার প্রেরণা সৃষ্টি
করলেন। (ইবনে কাসীর, ২ খণ্ড , ৪৩৩
পৃষ্ঠা )।
একই আয়াতে ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখছেন, এ জাতির কাহিনী হচ্ছে, “হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মসুল এলাকায়
নিনেভাসসীদের কাছে আগমন করেছিলেন। তারা ছিল কাফের ও মুশরিক । হযরত ইউনুস তাদেরকে
এক ও লা শরীক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ও মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করার আহবান জানান। তারা তাঁর
দাওয়াত প্রত্যাখ্যান কর এবং তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। হযরত ইউনুস তাদেরক জানিয়ে
দেন , তৃতীয় দিন আযাব আসবে এবং তৃতীয় দিন আসার আগেই
অর্ধ রাতে তিনি জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন। তারপর দিনের বেলা যখন এ জাতির মাথার ওপর
আযাব পৌঁছে যায় এবং তাদের বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সবাই ধবংস
হয়ে যাবে তখন তারা নিজেদের নবীকে খুঁজতে থাকে কিন্তু তাঁকে খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত তারা সবাই
নিজেদের ছেলেমেয়ে , পরিবার , গবাদি পশু নিয়ে খোলা প্রান্তরে বের হয়ে আসে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও
তাওবা করে। আল্লাহ তাদের প্রতি করুণা করেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন। (রূহুল মা 'আনী, ১১ খণ্ড,
১৭০ পৃষ্ঠা )
সূরা আম্বিয়ার ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখেছেন, “হযরত
ইউনুসের নিজের জাতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বের হয়ে যাওয়া ছিল হিজরাতের কাজ। কিন্তু
তাঁকে এর হুকুম দেয়া হয়নি। (রুহুল মা'আনী, ১৭ খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা)।
তারপর
তিনি হযরত ইউনুসের দোয়ার বাক্যাংশ বর্ণনা করেছেন এভাবে, “অর্থাৎ আমি অপরাধী ছিলাম।
নবীদের নিয়মের বাইরে গিয়ে হুকুম আসার আগেই হিজরাত করার ব্যাপারে আমি তাড়াহুড়া
করেছিলাম। হযরত
ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এটি ছিল তাঁর নিজের গোনাহের স্বীকৃতি এবং তাওবার
প্রকাশ , যাতে আল্লাহ তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। "
(রূহুল মা"আনী ১৭ খণ্ড, ৭৮ পৃষ্ঠা )।
এ
আয়াতাটির টীকায় মওলানা আশরাফ আলী থানবী লিখেছেন, “তাঁর নিজের জাতি তাঁর প্রতি ঈমান
না আনায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যান এবং জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাবার পরও নিজে
তাদের কাছে ফিরে আসেননি । আর এ সফরের জন্য আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষাও করেননি।"
(বায়ানুল কুরআন)
এ
আয়াতের টীকার মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ " জাতির কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধচিত্তে শহর থেকে বের হয়ে যান।
আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করেননি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে, তিনি দিনের মধ্যে তোমাদের ওপর আযাব নেমে আসবে, বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন
এ মর্মে যে, অবশ্যই আমি তাড়াহুড়া করেছি, তোমার হুকুমের অপেক্ষা না করেই জনপদের অধিবাসীদের ত্যাগ করে বের হয়ে পড়ি।
সূরা
সাফফাতের ওপরে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী লিখেছেন, হযরত ইউনুসের অপরাধ
ছিল, তাঁর যে জাতি তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল
আল্লাহ তাকে ধবংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এ আযাব নির্ঘাত এসে যাবে। তাই তিনি সবর করেননি। জাতিকে দাওয়াতে দেবার কাজ
বাদ দিয়ে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দাওয়াতের কাজ সবসময় জারী রাখাই ছিল তাঁর
দায়িত্ব। কারণ আল্লাহ তাদেরকে ধবংস না করার সম্ভাবনা তখনো ছিল।" (তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১৬৮
পৃষ্ঠা )।
আল্লামা
আলুসী এ সম্পর্কে লিখেছেন, “আবাকা এর আসল মানে হচ্ছে ,
প্রভুর কাছ থেকে দাসের পালিয়ে যাওয়া । যেহেতু হযরত ইউনুস তাঁর রবের
অনুমতি ছাড়াই নিজের জাতির কাছ থেকে পলায়ন করেছিলেন তাই তাঁর জন্য এ শব্দটির
ব্যবহার সঠিক হয়েছে।" তারপর সামনের দিকে তিনি আরো
লিখেছেনঃ "তৃতীয় দিনে হযরত ইউনুস আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই
বের হয়ে গেলেন। এখন তাঁর জাতি তাঁকে না পেয়ে তাদের বড়দের ছোটদের ও গবাদি পশুগুলো
নিয়ে বের হয়ে পড়লো। আযাব অবতীর্ণ হবার বিষয়টি তাদের কাছে এসে পৌছেছিল ।তারা
আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলো। আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে
দিলেন। (রূহুল মা'আনী, ২৩ খণ্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা)।
মাওলানা
শব্বির আহমদ উসমানী এ ব্যাখ্যা প্রসংগে লিখেছেন, “অভিযোগ এটিই ছিল যে,
ইজতিহাদী ভুলের দরুন আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে জনপদ থেকে বের
হয়ে পড়েন এবং আযাবের দিন নির্ধারণ করে দেন্”।
আবার
সূরা আল কলম এর একটি আয়াতের টীকার মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেন, “মাছের
পেটে প্রবেশকারী পয়গম্বরের (হযরত ইউনুস
আলাইহিস সালাম ) মতো মিথ্যা আরোপকারীদের ব্যাপারে
সংকীর্ণমনতা ও ভাতি আশংকার প্রকাশ ঘটাবে না। অর্থাৎ জাতির বিরুদ্ধে
ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে দ্রুত আযাবের জন্য দোয়া এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে
বসলেন।
মুফাসসিরগণের
এসব বর্ণনা থেকে একথা সুম্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনটি ভুলের কারণে হযরত ইউনুসের (আ ) ওপর অসন্তোষ ও ক্রোধ নেমে আসে ।
১। তিনি নিজেই আযাবের দিন নির্দিষ্ট করে দেন। অথচ
আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন ঘোষণা হয়নি।
২। সেদিন আসার আগেই হিজরাত করে দেশ থেকে বের হয়ে যান। অথচ আল্লাহর
হুকুম না আসা পর্যন্ত নবীর নিজ স্থান ত্যাগ করা উচিত নয়।
৩। সে জাতির ওপর
থেকে আযাব হটে যাওয়ার পর তিনি নিজে তাদের মধ্যে ফিরে যাননি।
ঘ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়তের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রসঙ্গে।
দেওবন্দী আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন “ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত
মতবাদ” গ্রন্থে বলেন, কুরআন হাদিস দ্বারা
প্রমানিত নবী রাসূলগন নবুয়তের দায়িত্ব পালনে কোন প্রকান ত্রুটি-বিচ্যুতি করে
নাই। কুরআনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এসেছে,
يَـٰٓأَيُّہَا
ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ وَإِن لَّمۡ تَفۡعَلۡ
فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَهُ ۥۚ (٦٧)
অর্থঃ হে
রসূল ! তোমার
রবের
পক্ষ
থেকে
তোমার
কাছে
যা
কিছু
নাযিল
করা
হয়েছে
তা
মানুষের
কাছে
পৌঁছাও৷
যদি
তুমি
এমনটি
না
করো
তাহলে
তোমার
দ্বারা
তার
রিসালাতের
হক
আদায়
হবে
না৷
(
সূরা মায়েদা ৫:৬৭)।
বিদায় হজ্জের সময়
লক্ষাধিক সাহাবিদের সামনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে সম্ভোধন করে
প্রশ্ন করলেন আমি কি তোমাদের নিকট পৌছে দিয়েছি? সাহাবিগন উত্তরে বললেন, জ্বি হ্যা,
আপনি পৌছে দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! তুমি
স্বাক্ষি থেক। (বুখারি)। অথচ
আবুল
আলা মওদুদী মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়তের দায়িত্ব পালনে কালে ত্রুটি-বিচ্যুতি করেছেন।
(নাউজুবিল্লাহ)।
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী “কোরআনের চারটি মৌলিক
পরিভাষা” গ্রন্থে (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সম্পর্কে) লিখেন, দীর্ঘ
তেইশ বছরের নবুয়তের দায়িত্ব পালনে আমার দ্বারা যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি
হয়ে গেছে,
তা ক্ষমা করে দাও! (সূত্রঃ
“ইসলামি
আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” পৃষ্ঠা ৩৮৭)।
অনেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার
করে। কারন তাদের মতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী বক্তব্যের আগের পিছের অংশ বাদ দিয়ে
ভূলভাবে উপাস্থাপন করা হয়েছে। সম্পুর্ণ অংশ পড়লে ভূল মনে করার কোন অবকাশ
থাকবেনা। সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী সূরা নসরের তাফসির করেছেন মাত্র।
সূরা নসরের মহান
আল্লাহ বলেন, إِذَا جَآءَ نَصۡرُ ٱللَّهِ وَٱلۡفَتۡحُ (١) وَرَأَيۡتَ ٱلنَّاسَ يَدۡخُلُونَ فِى دِينِ ٱللَّهِ أَفۡوَاجً۬ا (٢) فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَٱسۡتَغۡفِرۡهُۚ إِنَّهُ ۥ ڪَانَ تَوَّابَۢا (٣)
অর্থঃ
যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়।আর (হে নবী!) তুমি যদি দেখ যে লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দীন গ্রহণ।তখন তুমি তোমার রবের হামদ
সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যি তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী৷ (সূরা নসর ১১০:১-৩)।
এর ব্যাখ্যায় মওদুদী
বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে
সম্বোধন করা হয়েছে দীর্ঘ তেইশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার পর আরবে বিপ্লব সম্পন্ন
হওয়ার পর এ সম্বোধন করা হয়েছে। ইসলাম তার পরিপূর্ণ বিস্তৃতরূপে একটি চিন্তা-বিশ্বাস, নীতি, শিক্ষা, সমাজ, তমুদ্দুন, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব
বিষয়ের পরিপূর্ণ বিধান হিসাবে কার্যত প্রতিষ্ঠিত। আরবের প্রত্যন্তর প্রান্ত থেকে
দলে দলে সে বিধানের ছায়াতলে লোকেরা আশ্রয় নিচ্ছিলো। এমনিভাবে মুহাম্মদ (সঃ) যে
কাজের জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন, তার সমাপ্তি
ঘটলে তাঁকে বলা হয়, এ কার্যকে
নিজের কীর্তি মনে করে যেন গর্বিত হয়ে না পড়। ত্রুটিমুক্ত
ও পরিপূর্ণ সত্তা একমাত্র তোমার রবের, অন্য
কারো নয়। সুতরাং এ মহান কার্য সম্পাদনের জন্যে তাঁর প্রশংসা-স্তুতি
প্রকাশ কর এবং তাঁর দরবারে আবেদন করঃ প্রভু পরওয়ারদেগার! দীর্ঘ
তেইশ বছরের এ খেদমতকালে আমার দ্বারা যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি
হয়ে গেছে,
তা ক্ষমা করে দাও! (কোরআনের
চারটি মৌলিক পরিভাষা পৃষ্ঠা নম্বর ১১২)।
আবুল আলা মওদুদী তার লিখিত
তাফহিমূর কুরআনে আরও খোলাসা করে বলেন, তোমার
রবের কাছে দোয়া করো। তিনি তোমাকে যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা করতে গিয়ে
তোমার যে ভুল-ত্রুটি হয়েছে তা যেন তিনি মাফ করে দেন। ইসলাম বান্দাকে এ আদব
শিষ্টাচার শিখিয়েছে। কোন মানুষের দ্বারা আল্লাহর দীনের যতবড় খিদমতই সম্পন্ন হোক না
কেন, তাঁর
পথে সে যতই ত্যাগ স্বীকার করুক না এবং তাঁর ইবাদাত ও বন্দেগী করার ব্যাপারে যতই
প্রচেষ্টা ও সাধনা চালাক না কেন, তার মনে কখনো এ ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া উচিত নয় যে, তার ওপর তার
রবের যে হক ছিল তা সে পুরোপুরি আদায় করে দিয়েছে। বরং সবসময় তার মনে করা উচিত যে
তার হক আদায় করার ব্যাপারে যেসব দোষ-ত্রুটি সে করেছে তা মাফ করে দিয়ে যেন
তিনি তার এ নগণ্য খেদমত কবুল করে নেন। এ আদব ও শিষ্টাচার শেখানো হয়েছে রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। অথচ তাঁর চেয়ে বেশী আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা
ও সাধনাকারী আর কোন মানুষের কথা কল্পনাই করা যেতে পারে না। তাহলে এ ক্ষেত্রে
অন্য কোন মানুষের পক্ষে তার নিজের আমলকে বড় মনে করার অবকাশ কোথায়৷ আল্লাহর যে
অধিকার তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তা সে আদায় করে দিয়েছে এ অহংকার মত্ত হওয়ার কোন
সুযোগই কি তার থাকে৷ কোন সৃষ্টি আল্লাহর হক আদায় করতে সক্ষম হবে, এ ক্ষমতাই তার
নেই। মহান আল্লাহর এ ফরমান মুসলমানদের এ শিক্ষা দিয়ে আসছে যে , নিজের কোন
ইবাদাত , আধ্যাত্মিক
সাধনা ও দীনি খেদমতকে বড় জিনিস মনে না করে নিজের সমগ্র প্রাণশক্তি আল্লাহর পথে
নিয়োজিত ও ব্যয় করার পরও আল্লাহর হক আদায় হয়নি বলে মনে করা উচিত। এভাবে যখনই তারা
কোন বিজয় লাভে সমর্থ হবে তখনই এ বিজয়কে নিজেদের কোন কৃতিত্বের নয় বরং মহান আল্লাহর
অনুগ্রহের ফল মনে করবে। এ জন্য গর্ব ও অহংকারে মত্ত না হয়ে নিজেদের রবের সামনে
দীনতার সাথে মাথা নত করে হামদ, সানা ও তাসবীহ পড়তে এবং তাওবা ও ইসতিগফার করতে থাকবে।
মন্তব্যঃ এখান ভুল-ত্রুটি বলতে আল্লাহর হক বুঝান হয়েছে। আর
আল্লাহর হক আদায় করা কোন কালে, কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মনে রাখতে হবে, এ
ক্ষেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চেষ্টায় বিন্দু মাত্র ত্রুটি
করেন নি এবং আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে পৌছে দিয়েছেন। (প্রাঃ উঃ ৫:৬৭)।তরজমানুল কোরআনে একজন পাঠক প্রশ্ন করেন, নবীরা যে মা’সুম এটা স্বীকৃত ব্যাপার, কিন্তু হযরত আদম আ সম্পর্কে কোরআনের একটি আয়াত প্রমাণ করে যে, তিনি আল্লাহ পাকের হুকুম অমান্য করে গোনাহ করেছেন। এ সম্পর্কে আপনার গবেষণার ফলাফল জানিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তরে মাওলানা লিখেনঃ “নবীর মাসুম হওয়ার অর্থ এই নয় যে, ফেরেস্তাদের মতো তারও ভুল করার সম্ভাবনা বিলুপ্ত করা হয়েছে। বরঞ্চ এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে, জেনে শুনে নবী কখনো নাফরমানী করেন না। আর তার দ্বারা কোন ভূল হয়ে গেলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই ভুলের ওপর কায়েম থাকতে দেন না। ( অহীর সাহায্যে তাকে সঠিক পথ দেখান)।”
এরপরে তিনি লিখেন, “সংক্ষিপ্ত কথায় নীতিগত ভাবে আপনি একথাটিই বুঝে নিন যে, নবীর নিস্পাপ হওয়াটা ফেরেস্তাদের নিস্পাপ হওয়ার মতো নয় যে, ভুল ত্রুটি ও গুনাহ খাতা করার শক্তিই তিনি লাভ করেননি। না তা নয়। বরঞ্চ এর অর্থ হলো, নবুওয়াতের দায়িত্বপুর্ণ পদে অভিষিক্ত করার পর আল্লাহ তায়ালা বিশেষ ভাবে তার হেফাজত ও তত্ত্ববধান করে থাকেন এবং তাকে ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে থাকেন। কোনো ছোটো খাটো পদস্থলন যদি তার দ্বারা হয়েও যায় তবে অহীর সাহায্যে সাথে সাথে সংশোধন করে দেন, যেনো তার ভ্রান্তি গোটা উম্মাতের গোমরাহীর কারণ না হয়ে দাড়ায়। (তরজমানুল কোরআন রজব-শাওয়াল-১০৬৩ হিঃ, জুলাই - অক্টোবর-১৯৪৪)”
মাওলানা বশিরুজ্জামান, “সত্যের আলো” নামক বইয়ে লিখেন, কোরআন শরীফে এর অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাই।
১। তাবুকের যুদ্ধের সময় কিছু সংখ্যক মুনাফিক কৃত্রিম ওজর পেশ করে রাসুল করীম (সঃ) এর নিকট যুদ্ধে গমন হতে নিষ্কৃতি চেয়েছিল, রাসুল (সঃ) স্বীয় স্বভাবজাত নম্রতা-সহনশীলতার কারণে এরা মিথ্যা বাহানা করতেছে জেনেও তাদেরকে রোখছত দিয়ে দিলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এটা পছন্দ করেন নাই এবং এরুপ নম্রতা সমীচীন নহে বলে সাথে সাথে ওহী দ্বারা সতর্ক করলেনঃ
عَفَا ٱللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ وَتَعۡلَمَ ٱلۡكَـٰذِبِينَ (٤٣)
হে নবী, আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন। তুমি কেন এ লোকদের অনুমতি দিলে? যদি না দেতে তা হলে তোমার নিকট সুস্পষ্ট হত যে, কোন লোকেরা সত্যবাদী, আর মিথ্যেবাদীদেরকেও জানতে পারতে। (সুরা-তাওবা, আয়াত নং-৪৩)
২। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মুনাফিকের মৃত্যুর পর তাহার ছেলের অনুরোধে রাসুলে করীম (সঃ) ঐ মুনাফিকের জানাযার নামাজ পড়াতে উদ্যত হয়ে গেলেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা ওহী দ্বারা তাকে সতর্ক করলেন এবং নামায পড়ানো থেকে বিরত রাখলেন।
وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٍ۬ مِّنۡہُم مَّاتَ أَبَدً۬ا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦۤۖ إِنَّہُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَـٰسِقُونَ (٨٤
তাদের কোন লোক মরে গেলে তার জানাযা তুমি কখনই পড়বেনা তার কবরের পাশেও দাঁড়াবেনা। কেননা তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে কুফরী করেছে। আর মরেছে তারা ফাসেক অবস্থায়।
(সুরা-তাওবা, আয়াত নং ৮৪)
৩। রাসুল করীম (সঃ ) তার কোন স্ত্রীর মনস্তুস্টির জন্য মধু পান না করার কসম করেন। হালাল খাদ্য গ্রহণ না করার কসম করা রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্য শোভন নহে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে ওহী দ্বারা অবগত করলেন।
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلنَّبِىُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَآ أَحَلَّ ٱللَّهُ لَكَۖ تَبۡتَغِى مَرۡضَاتَ أَزۡوَٲجِكَۚ وَٱللَّهُ غَفُورٌ۬ رَّحِيمٌ۬ (١)
হে নবী। আল্লাহ তায়ালা যা তোমার জন্য হালাল করেছেন তা তুমি কেন নিজের জন্য হারাম করলে। তুমু কি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাইতেছ? আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা-তাহরীম, আয়াত নং-১)
৪। হযরত নূহ (আঃ ) সেই ঐতিহাসিক তুফানের সময় তার কাফের
ছেলেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে তা
পছন্দনীয় হল না, তাই সাথে সাথে ওহী নাযেল করলেনঃ-
قَالَ يَـٰنُوحُ إِنَّهُ ۥ لَيۡسَ مِنۡ أَهۡلِكَۖ إِنَّهُ ۥ عَمَلٌ غَيۡرُ صَـٰلِحٍ۬ۖ فَلَا تَسۡـَٔلۡنِ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۖ إِنِّىٓ أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلۡجَـٰهِلِينَ (٤٦)
আল্লাহ বলেন: হে
নূহ!
সে তোমার পরিবারভুক্ত নহে। সে অসৎ কর্ম পরায়ণ। সুতরাং যে
বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই, সে বিষয়ে
আমাকে অনুরোধ করনা। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি
অজ্ঞদের অন্তরভুক্ত না হও। (সুরা-হূদ
আয়াত নং-
৪৬)قَالَ يَـٰنُوحُ إِنَّهُ ۥ لَيۡسَ مِنۡ أَهۡلِكَۖ إِنَّهُ ۥ عَمَلٌ غَيۡرُ صَـٰلِحٍ۬ۖ فَلَا تَسۡـَٔلۡنِ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۖ إِنِّىٓ أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلۡجَـٰهِلِينَ (٤٦)
৫। হযরত মুসা (আঃ) যখন এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলেন তখন নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন – هذا من عمل الشيطان – এটা শয়তানের কান্ড। এ ছাড়াও কোরআন শরীফে অনেক উদাহরণ রয়েছে।
মাওলানা বশিরুজ্জামান, “সত্যের আলো” নামক বইয়ে আরও লিখেন, আহলে সুন্নত ওয়াল
জামায়া’তের সকল উলামায়ে কিরামের ঐক্যমত যে, ভুল বশতঃ নবীদের থেকে ছগীরা গুনাহ হতে পারে এবং জমহুর উলামাদের মতে
ইচ্ছাকৃতভাবেও ছগীরা গুনাহ হতে পারে। এমতাবস্থায় যদি হেফাজত উঠানো না হয়, তবে বুঝা যাবে যে, একদিকে আল্লাহর হেফাজত আছে,
আর অন্যদিকে নবীদের থেকে ভুল ত্রুটি তথা ছগীরা গুনাহ প্রকাশ পাচ্ছে।
এটা কিন্তু অসম্ভব। কারন এতে পরোক্ষ ভাবে আল্লাহ তায়ালা হেফাজতের উপর পুর্ণ সক্ষম
নন বলে প্রকাশ পায়। (নাউজুবিল্লাহ) অতএব মানতেই হবে যে, যখনই
নবীদের থেকে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি প্রকাশ পায় তখন আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করে তার
হেফাজত উঠিয়ে তা করতে দেন। কাজেই, মাওলানা মওদূদী (রাহ) ইছমতে আম্বিয়া সম্পর্কে
কোন কথা কোরআন হাদীস কিংবা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আ’কিদার
খেলাফ বলেন নি।
মন্তব্যঃ
কাজেই নবী আলাইহিস সালামদের নিস্পাপতা নিয়ে জামায়েত ও তাদের অনুসারি আলেমদের প্রতি
যে অভিযোগ দেওবন্দী আলেরগন করে থাকে তা সঠিক কিন্তু কে ভূল আর কে সঠিক তা নির্ধারণ
করা পাঠকদের নিজ দায়ীত্বে ছেড়ে দিলাম।
০২। সাহাবায়ে কেরাম
সত্যের মাপকাঠি হওয়া প্রসঙ্গে।
জামায়েতে ইসলামির
প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী “সত্যের মাপকাঠি এবং যাচাই বাছাই” সম্পর্কে এক আলোচনা
রাখেন, যা তৎকালীন পাকিস্তান জামায়া’তে
ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ৩নং ধারার ৬ নং উপধারায় লিখিত আছে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী আলোচনাটি কিছু
অংশ নিন্মরূপ,
“আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কোন মানুষকে
সত্যের মাপকাঠি বানাবেনা। কাউকে যাচাই বাছাইয়ের উর্ধে মনে করবেনা। কারো অন্ধ
গোলামীতে নিমজ্জিত হবে না, বরং আল্লাহর দেয়া এ পূর্ণ মাপ
কাঠির মাধ্যমে যাচাই ও পরখ করবে ‘এবং এ মাপকাঠির দৃষ্টিতে
যার যে মর্যাদা হতে পারে, তাকে সে মর্যাদাই দেবে’”।
তাহার এ আলাচনা থেকে এ কথা স্পষ্টত জানতে পারা যায় যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কেউ সত্যের মাপকাঠি নয়।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী উল্লিখিত কথাগুলোর উপর তখনকার উপমহাদেশের অনেক আলেম তিব্র প্রতিবাদ করে। এমন কি অনেকেতো কাফের ফতওয়াও প্রদান করেন। কারন তারা মনে করেন যে, যদি এ কথাগুলো মেনে নেওয়া হয় তা হলে সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সত্যের মাপকাঠি হচ্ছেন না এবং তাদের উপর তানকী’দ বা যাচাই বাছাই বৈধ হয়ে যায়। যারা এর প্রতিবাদ করেন তাদের মধ্যে বিশেষ করে দেওবন্দী আলেমগন অন্যতম। তাই আমি দেওবন্দী ঘরানার আলেমের মতামত তুলে ধরছি।
তাহার এ আলাচনা থেকে এ কথা স্পষ্টত জানতে পারা যায় যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কেউ সত্যের মাপকাঠি নয়।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী উল্লিখিত কথাগুলোর উপর তখনকার উপমহাদেশের অনেক আলেম তিব্র প্রতিবাদ করে। এমন কি অনেকেতো কাফের ফতওয়াও প্রদান করেন। কারন তারা মনে করেন যে, যদি এ কথাগুলো মেনে নেওয়া হয় তা হলে সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সত্যের মাপকাঠি হচ্ছেন না এবং তাদের উপর তানকী’দ বা যাচাই বাছাই বৈধ হয়ে যায়। যারা এর প্রতিবাদ করেন তাদের মধ্যে বিশেষ করে দেওবন্দী আলেমগন অন্যতম। তাই আমি দেওবন্দী ঘরানার আলেমের মতামত তুলে ধরছি।
(১) প্রথম যিনি এই ব্যাপারে বাংলায় কলম ধরেন তিনি
হলেন মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছূল হক ফরিদপুরী (রহ:)। তিনি এ সম্পর্কে যে বই লিখেন
তার নাম হল: “ভুল
সংশোধন”। তিনি উক্তি বইয়ের মাধ্যমে তিনটি কথার ব্যাপারে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক
আলোচনা পেশ করছেন। এবং পাশাপাশি মওদুদীর কথাগুলিও উল্লেখ করেছেন।
ক। সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সত্যের মাপকাঠি প্রসঙ্গ।
খ। সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সমালোচনার উর্ধে প্রসঙ্গ।
গ। সাহাবায়ে কিরাম (রা:) মর্জাদা সমুহ প্রসঙ্গ।
“সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সত্যের মাপকাঠি” সরাসরি এ
কথাটি কুরআন
সুন্নাহ উল্লেখ না থাকলেও “সাহাবায়ে
কিরাম (রা:) ফজিলত পূর্ণ কুরআনের আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সত্যের মাপকাঠি “এটাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের
আকিদা”।
(২) কওমি
মাদ্রাসার নেসাবভূক্ত আকিদার বই “ইসলামি
আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” কিতাবের ৩৯১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হলঃ সাহেবায়ে কেরামের সত্যের মাপকাটি। কুরআন হাদিসে সাহেবায়ে
কেরামের ঈমানকে ঈমানের মাপকাটি বলা হয়েছে। তাদের আমল ও মাসলাককে, আমল ও মাসলাকের মাপকাঠি করা হয়েছে।
কুরআনে
এরশাদ হচ্ছে,
وَإِذَا
قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ
অর্থঃ
আর যখন তাদের বলা হয়েছে , অন্য লোকেরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে
ঈমান আনো। (সুরা বাকারা ২:১৩)।
আরও এরশাদ
হচ্ছে,
فَإِنۡ ءَامَنُواْ بِمِثۡلِ مَآ
ءَامَنتُم بِهِۦ
فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ
অর্থঃ
তোমরা যেমনি ঈমান এনেছো তারাও যদি ঠিক তেমনিভাবে ঈমান আনে, তাহলে তারা হিদায়াতের
ওপর প্রতিষ্ঠিত বলতে হবে। (সুরা বাকারা ২:১৩৭)।
এ দুটি আয়াতে ঈমানের মাপকাঠি সাহেবায়ে কেরামের ঈমানের মাপকাটি হওয়ার
কথা বিবৃত হয়েছে।
আরও এরশাদ
হচ্ছে,
وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ
لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا
تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا (١١٥)
অর্থঃ
কিন্তু ব্যক্তি রসূলের বিরোধীতায় কোমর বাঁধে এবং ঈমানদারদের পথ পরিহার করে অন্য পথে
চলে,
অথচ তার সামনে সত্য –সঠিক পথ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে,
তাকে আমি সেদিকেই চালাবো যেদিকে সে চলে গেছে এবং তাকে জাহান্নামে ঠেলে
দেবো
, যা নিকৃষ্টতম আবাস৷ (সুরা নিসা ৪:১১৫)।
এ আমল ও মাসলাকের ক্ষেত্র, সাহেবায়ে কেরামের মাপকাঠি হওয়ার কথা বিবৃত
হয়েছে। এরপর লেখক বলেনঃ কিন্তু মওদুদী মনে করেন সাহেবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাটি নন।
একমাত্র আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামই সত্যের
মাপকাটি।
সাহেবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাটি এ প্রসঙ্গে জামায়াতের বক্তব্য কি? যারা
যদি তাদের এ বক্তব্যে অটল থাকে তবে বুঝব এটাই তাদের আকিদা। জামায়েতের এক সময়ের
আমির ও বর্সিয়ান নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম
এর লিখিত “ইকামাতে দ্বীন’ নামক বইয়ের ৫২ পৃষ্ঠায় “দ্বীনে মাপকাঠি একমাত্র রাসুল”
শিরোনামে এ সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি লিখেন:
শিরোনাম:-
দ্বীনের
মাপকাঠি একমাত্র রাসূল
আল্লাহ
পাক একমাত্র রাসূল (সঃ) কে উসওয়াতুন হাসানা বা দ্বীনের মাপকাঠি বানিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম
রাসূল (সঃ) এর সবচেয়ে বেশী অনুসরন করেছেন বলেই রাসূল (সঃ) এর আনুগত্যের ব্যাপারে
তারা শ্রেষ্ট আদর্শ। কিন্তু রাসূল (সঃ) যেমন
নিজেই আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম সে হিসেবে রাসূলের সমান মর্যাদার অধিকিরী নন। এমন কি সব
সাহাবী এক মানের নন। চার
খলিফার সবাইও এক মানের নন। তাই দ্বীনের একমাত্র
মাপকাঠি রাসূল (সঃ) এবং সবাইকে একমাত্র রাসূল (সঃ) কেই অনুসরন করার চেষ্টা করতে
হবে। আমরা
সাহাবায়ে কেরামকে কী জন্য মানি? তাঁদেরকে
মানার জন্য নয় বরং রাসূল (সঃ) কে মানার উদ্দেশ্যেই তাদেরকে মানিঅ রাসূল (সঃ) কে অনুসরন করার
ব্যাপারে তারাই আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাই রাসূলকে মানার জন্যই তাদেরকে মানতে হবে। কারন
বা রাসূল (সঃ) এর আনুগত্য ও অনুসরনের দিক দিয়ে সাহাবায়ে কেরামই শ্রেষ্ট আদর্শ। কিন্তু
রাসূল (সঃ) যে অর্থে আদর্শ বা উসওয়া সে অর্থে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা এক হতে
পারে না কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তুলনা করার জন্য একটা সহজ
উদাহরন দেয়া যেতে পারে।
স্বর্ণকে খাঁটি কি অখাঁটি এবং অখাঁটি হলে কি পরিমান অখাঁটি তা
বুঝবার জন্য একপ্রকার পাথর ঘষে জানা যায়। ঐ পাথরকে কষ্টি পাথর বলে। কষ্টি
পাথর হলো মানদন্ড বা মাপকাঠি যাকে আরবীতে বলে কষ্টি পাথর ঘষে যদি স্বর্নের কোন
টুকরাকে একেবারে খাটি সোনা বলেও জানা যায় তবুও ঐ টুকরকে কষ্টি পাথর বলা যাবে না। স্বর্ণ
কষ্টি পাথর হতে পারে না।
ঠিক তেমনিই আল্লার রাসূলই একমাত্র কষ্টি পাথর। সে
কষ্টি পাথরে যাচাই করেই সাহাবাগনকে খাঁটি স্বর্ণ বলে জনা যায়,কিন্তু তাই বলে তারা নিজেরা কষ্টি পাথর নন।
সাহাবায়ে কেরামের জামাতকে সামগ্রিক ভাবে খাঁটি হওয়া সত্বেও
ব্যক্তি হিসেবে সবাই আবার সমান মর্যাদার নন। খোলাফায়ে রাশেদার মর্যাদা
আর সব সাহাবা থেকে বেশী।মর্যাদার
এ কম বেশের হিসেব কিভাবে করা হয়েছে? একথা সবাইকে স্বিকার করতে হবে ,এ হিসাবের মাপকাঠি
একমাত্র রাসূল (সঃ)।হযরত উমর (রা) এর চেয়ে হযরত আবু বকর (রা) কে শ্রেষ্ট বলে
স্বীকার করার মানদন্ড বা মাপকাঠি একমাত্র রাসূল। রাসূলের কষ্টি
পাথরে যাচাই করেই এ হিসেব বের করা হয়েছে।
আর একটি তুলনা দ্বারা এ পার্থক্যটা আরও পরিষ্কার হয়। হযরত মুয়াবিয়া
(রা) সাহাবী হাওয়া সত্বেও তাঁকে খোলাফায়ে রাশেদার মধ্যে গন্য করা হয় না কেন?
হযরত উমার বিন আব্দুল আযিয (রা) কে দ্বিতীয় উমর আক্ষা দিয়ে খোলাফায়ে
রাশেদার নিকটতম মর্যাদা দেয়া হয় কিভাবে? অথচ তিনি সাহাবী
ছিলেন না। কোন
মাপাকাঠিতে বিচার করে এ দুজনের ব্যপারে এ তারতম্য করা হলো?
নিসন্দেহে বলা যায় যে, রাসূল (সঃ) এর মাপকাঠিতে বিচার করেই উম্মাত এ সিদ্ধান্তে
পৌঁছেছে।
এসব যুক্তি একথা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাবে প্রমান করে যে,
আল্লার রাসূল (সঃ)-একমাত্র আদর্শ মাপকাঠি এবং একমাত্র কষ্টি পাথর। এ
কষ্টি পাথরে বিচার করেই মানুষের মধ্যে কে কতটুকু মর্যাদা পেতে পারে তা নির্নয় করা
হয়। যদি
রাসূল ছাড়াও আর মানুষকে কষ্টি পাথর মনে করা হয় এবং মাপকাঠি বলে ধারনা করা হয় তাহলে
সে ব্যক্তি নিশ্চই রাসূলের চেয়ে নিন্ম মানের হবে। আল্লাপাক
রাসূল (সঃ) ছাড়া আর কোন নিন্ম মানের লোককে উসওয়া বা আদর্শ মেনে নিতে বলেননি।
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, রাসূল (সঃ)-কে আল্লাহপাক যে উসওয়ায়ে হাসানা হিসেবে একক মর্যাদা দিয়েছেন সে
মর্যাদা অন্য কারো নীতিগতভাবে স্বিকার না করলেও বাস্তবে দ্বীনি বড় ব্যক্তিত্বকে
এমন মর্যাদা দিয়ে ফেলা হয় যা একমাত্র রাসূলেরই প্রাপ্য।
রাসূলকে ওহী দ্বারা পরিচালিত করা হয় বলে তিনি যেমন নির্ভূল,
অন্য কোন ব্যক্তি এমন নির্ভূল হতে পারে না। রাসূলকে যেমন
অন্ধ ভাবে মেনে নিতে হয় তেমন ভাবেও আর কাউকে মানা চলে না। যুক্তি বুঝে
আসুক বা না আসুক রাসূলের নির্দেশ মেনে নেয়া যেমন ঈমানের দাবী,
আর কার নির্দেশের সে মর্যাদা হতে পারেনা। রাসূল (সঃ)
যেমন সমালোচনার ঊর্ধে আর কেউ তেমন নয়। বিনাযুক্তিতে রাসূলকে মানার
জন্য আল্লাহ যেমন নির্দেশ দিয়েছেন অন্য কারও বেলায় তেমন কোন নির্দেশ দেননি।
কোন দ্বীনি ব্যক্তিত্ব যত বিরাট হোক,
যদি তাকে নির্ভূল বলে বিশ্বাস করা হয়,তাকে
অন্ধ ভাবে মানা হয়,তাঁকে সমালোচনার ঊর্ধে মনে করা হয়,তাহলে প্রকৃতপক্ষে রাসূলের সমান মর্যাদা দেয়া হলো।অথচ মর্য়াদার দিক দিয়ে কেউ
রাসূলের সমান হতে পারে না।
দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তিই হলো তাওহিদ ও রিসালাত। আল্লাহর
যাত ও সিফাতের দিক দিয়ে আর কেউ আল্লার সাথে তুলনীয় নয়। তেমনি ওহী
দ্বারা পরিচালিত হওয়ার দরুন রসূল যেমন নির্ভূল তেমন আরকেউ হতে পারে না। এজন্যই
রাসূলকে যেমন অন্ধভাবে মানতে হয় তেমন আর কাউকে মানা চলে না। অর্থাৎ
উসওয়াতুন হাসনা হিসেবে রাসূল একক। আর কেউ এ পজিশন পেতে পারে না।কালেমা তাইয়েবার মাধ্যমে এই
অর্থেই তৌহিদ ও রিসালাতের স্বিকৃতি দিয়ে থাকি।
যদি রাসূলকে একমাত্র আদর্শ মনে করা হতো এবং রাসূলের জীবনকে
পূর্ণরূপে অনুসরন করাকে ইসলামী জীবনের লক্ষ মনে করা হতো তাহলে ইকামাতে দ্বীনের সংগ্রাম
বা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ কে অবশ্যই কর্তব্য মনে করা হতো। ইসলামী
আইন চালু করার চেষ্টা বা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলন না করলে রাসূলকে যে
সত্যিকার ভাবে অনুসরন করা হয় না এ কথা বুঝতে অসুবিধা হতো না।
রাসূল (সঃ) ছাড়া বড় আলেম, পীর বা বুজর্গকে আদর্শ মনে করার কারনেই কেউ মাদ্রাসার মাধ্যমে দ্বীনের
খেদমত করাকেই যথেষ্ট মনে করেন, কেউ ওয়াজ করেই দ্বীনের
দায়িত্ব পালন হলো বলে ধারনা করেন, কেউ ইমামতিতেই সন্তুষ্ট
আছেন।
যদি রসূল (সঃ) কে একমাত্র আদর্শ মনে করতেন তাহলে এটুকু খেদমত
করার পরও দ্বীন কে বিজয়ী করার জন্য পেরেশান হতেন। তাবলীগ জামাতের
দ্বায়ীত্বশীল মুরব্বিগন যদি রাসূল (সঃ) এর ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনকে আসল আদর্শ
মনে করেন তাহলে এ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রঃ) এর রচিত ছয় উসূলের
কর্মসূচীকে প্রাথমিক খেদমত বলে ধারনা করবেন। তাহলে তাবলিগের বর্তমান কর্মসূচিকেই হূবহু রাসূলের পরিচালিত
আন্দোলন বলে কেউ মনে করবেন না। কিন্তু রাসূল (সঃ) যদি শ্রেষ্ট আদর্শ হিসেবে সামনে না থাকে
তাহলে হযরত মাউলানা ইলিয়াস (রঃ) কেই আদর্শ মনে করে তার রচিত কর্মসূচীকেই ইসলামের
চুরান্ত কর্মসূচী বলে মনে করতে পারে।
“উসওয়াতুন হাসানা” হিসাবে
রাসূল (সঃ) এর মর্যাদাকে সঠিক ভাবে বুঝবার জন্য আর একটা উদাহরন বিশেষ সহায়ক হতে
পারে।
কলেজ ইউনিভার্সিটি ও মাদ্রাসার ছাত্রদের পাঠ্যসূচী সম্পর্কে যে
সিলেবাস বা নেসাব রচনা করা হয় সেখান থেকেই ফাইনাল পরিক্ষার প্রশ্ন তৈরী করা হয়। যদি
ছাত্ররা ঐ সিলেবাস সম্বন্ধে খুব সজাগ না থাকে এবং শিক্ষকেরা সিলেবাস যাতে সবটুকু
পড়ান সে দিকে যদি ছাত্ররা লক্ষ না রাখে এবং সিলেবস যদি সবটুকু পড়া না হয় তাহলে
পরীক্ষায় পাস হবার আশা কিছুতেই করা যায় না। ছাত্ররা শিক্ষকের প্রতি যতই
শ্রদ্ধা দেখাক, সিলেবাস পড়া বাকি
থাকলে পরীক্ষায় ভাল ফল কখনও হবে না। কোন শিক্ষক যদি সিলেবাসের
শুধু সহজ অংশটুকু পড়ায় এবং কঠিন অংশ বাদ দেয় তাহলে ছাত্র যতই ভাল হোক পরীক্ষায় ভাল
ফল আশা করা যায় না।
আল্লাহ পাক আখেরাতের পরীক্ষায় কামিয়াবীর জন্য রাসূল (সঃ)-এর
গোটা জীবনকে সিলেবাস হিসেবে দিয়েছেন। মৃত্যুর পর কবর থেকেই ঐ সিলেবাস অনুযায়ী প্রশ্ন করা হবে। কোন
লোককে এ প্রশ্ন করা হবে না যে, হযরত আবু
বকর (রঃ) বা ইমাম আবু হনীফা (রঃ) বা হয়রত আব্দুল কাদের জিলনী (রঃ) কে অনুকরন বা
অনুসরন করা হয়েছে কিনা।
রাসূলকে সিলেবাসের সাথে তুলনা করলে সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু
করে সব দ্বীনি ব্যক্তিকে শিক্ষক বা উস্তাদের সাথে তুলনা করা চলে। আমরা
সাহাবায়ে কেরাম থেকে রাসূলের জীবন সম্পর্কেই শিক্ষা নেই। রাসূলের
সিলেবাস শেখার জন্যই সাহবাদেরকে শ্রেষ্ঠ উস্তাদ মনে করতে হবে। রাসূলকে
জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে মেনে চলার প্রয়োজনেই ফেকার ইমামগনকে মানতে হবে। দুনিয়ার সব
বিষয় যেমন উস্তাদ থেকেই শিখতে হয়, দ্বীনি
জিন্দেগী শিখতে চইলেও উস্তাদ দরকার। সে উস্তাদকে যে নামেই ডাকা
হোক কাউকে দ্বীনি জামায়াতের আমীর এবং কাউকে শায়েখ বা পীর বলা হোক প্রকৃত পক্ষে
তাঁরা সবাই উস্তাদ।
তাঁদের কাছ থেকে রসূলের গোটা জীবনের সিলেবাস শেখার চেষ্টা করতে
হবে। একই
উস্তাদের কাছে গোটা সিলেবাস শেখা সম্ভব নাও হতে পারে। যদি
আমরা রসূলকে সিলেবাস মনে করি তাহলে সে উস্তাদের কাছে যেটুকু সিলেবাস শেখা যায়
সেটুকু শেখার পরও বাকি সিলেবাস শেখার জন্য উস্তাদ তালাশ করতে হবে। কোন এক
উস্তাদকেই সিলেবাস মনে করলে, তিনি যে টুকু
শেখান সেটুকুকেই যথেষ্ট মনে করলে আখেরাতের ফাইনাল পরীক্ষায় বিপদে পড়তে হবে।
দেশে এত আলেম, পীর ও
খাদেমে দ্বীন থাকা সত্বেও ইকামাতে দ্বীনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ার আসল কারন
এটাই। রাসূলকে
সিলেবাস হিসেবে গ্রহন না করে উস্তাদের অনুসরন করাই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে। এ
মহা ভূল যদি ভাংগে তাহলে ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব সবাই বোধ করতে সক্ষম হবেন।
***
জামায়াত
ঘরানার আরেক আলেম “মাওলানা বশিরুজ্জামান লিখিত
“সত্যের আলো” নামক বইয়ের ৩০
পৃষ্ঠায় লিখেন: “আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া
অন্য কোন মানুষকে সত্যের মাপকাঠি বানাবেনা। কাউকে যাচাই বাছাইয়ের উর্ধে মনে
করবেনা। কারো অন্ধ গোলামীতে নিমজ্জিত হবে
না বরং আল্লাহর দেয়া পূর্ণ মাপকাঠির মাধ্যমে যাচাই ও পরখ করবে এবং এ মাপ কাঠির
দৃষ্টতে যার যে মর্জাদা হতে পারে, তাকে সে মর্জাদা দেবে। মাওলানা মওদুদী (রাহ:) এ কথা বলার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামায়াত থেকে বহির্ভূত হওয়ার যোগ্য, না নিছক, একটা অপবাদ মাত্র। কোরআন শরীফের আলোকে মিয়ারে হক, আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফে
এরশাদ করেছেন
فَإِن تَنَـٰزَعۡتُمۡ فِى شَىۡءٍ۬ فَرُدُّوهُ إِلَى
ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأَخِرِۚ
ذَٲلِكَ خَيۡرٌ۬ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلاً (٥٩)
অর্থঃ “যদি তোমাদের মধ্যে
কোন বিষয়ে মত বিরোধ হয় তাহলে উহা আল্লাহ ও তার রসুলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি
তোমরা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখ । উহাই উত্তম এবং পরকালের দিক দিযেও
মঙ্গলজনক”। (সূরা নিসা ৪:৫৯)।
এ আয়াতে একটি কথা লক্ষণীয়
যে, আল্লাহ তায়ালা “তোমরা”
বলে যে সম্মোধন করেছেন এর মধ্যে সাহাবায়ে কিরাম (রা:) ও রয়েছেন। সুতরাং স্পষ্টত: বুঝা গেল
সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সহ কিয়ামত পর্যন্ত আগত মুমিনদের একে অন্যের সাথে মত বিরোধ
হতে পারে। একজন সাহাবীর সাথে যেমন অন্য একজন সাহাবীর মত বিরোধ হতে পারে, তেমনি
একজন সাহাবীর সাথে এমন ব্যক্তি যিনি সাহাবী নন তারও মত বিরোধ হতে পারে। কিন্ত
এমতাবস্থায় ফয়সালাকারী হবে আল্লাহর কিতাব ও সুন্নতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম। অতএব বুঝা গেল মিয়ারে হক বা সত্যের মাপকাঠি আল্লাহর কিতাব ও সুন্নতে
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যদি সাহাবায়ে কিরাম (রা:) সত্যের মাপকাঠি
হতেন তাহলে গায়রে সাহাবী (যিনি সাহাবী নন) তো দুরের কথা একজন সাহাবীর অন্য
সাহাবীর সাথে মতবিরোধের কোন অধিকার থাকত না, কিংবা মত বিরোধের সময় প্রত্যেক সাহাবী নিজ নিজ মতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার
হুকুম হত, এবং গায়ের সাহাবীকে বিনা দ্বিধায় সাহাবীর মতকে
গ্রহণ করার উপর বাধ্য করা হত। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন মতবিরোধের সময় কেউ কারো
মত গ্রহণ না করে বরং আল্লাহর কিতাব ও সুন্নতে রাসুল (স:) যে ফয়সালা দেয় উভয়
পক্ষ তা মেনে নিতে হবে। সুতরাং
সত্যের মাপকাঠি একমাত্র আল্লাহর কিতাব কোরআনে করীম এবং সুন্নতে রাসুল (স:)।
সাহাবায়ে কিরাম বা অন্য কেউ নন। কারণ
মিয়ারে হক বলতে এ জিনিষকেই বুঝায় যার অনুসরণ ও অনুকরণ উহার সত্য হওয়ার প্রমান
এবং যার বিরোধিতা উহার বাতিল হওয়ার পরিচয় বহন করে । আর এটা ঐ জিনিসই হতে পারে যা
নিশ্চিত সত্য এবং বাতিল হওয়ার এতে কোনরূপ আশাংকা নেই। এবং এটা প্রকাশ্য যে,
নিশ্চিত সত্য মাত্র দুটি জিনিষ, আল্লাহ
তায়ালার কিতাব কোরআনে কারীম এবং রাসুলে করীম (স:) এর সুন্নত। সুতরাং মিযারে হক
শুধুমাত্র এ দুটোকেই মানতে হবে। অন্য কাউকে নয়।
মাওলানা মওদুদী (রহ:) কে
মিয়ারে হক সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঠিক একথাটাই বলেছেন: “মিয়ারে হক বলতে আমরা সেই বস্তুকেই বুঝি, যার অনুকরণ
ও অনুসরণের মধ্যে হক বা সত্য নিহিত আছে এবং যার অবাধ্যতার মধ্যে বাতিল বা অসত্য
নিহিত আছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখো যায় যে, আল্লাহর
কিতাব ও রাসুলে করীম (স:) এর সুন্নতই হচ্ছে একমাত্র সত্যের মাপকাঠি। সাহাবীগণ
মাপকাঠি নন, বরং তারা হচ্ছেন আল্লাহর কিতাব ও রসুলের
সুন্নতের মাপকাঠি অনুসারে সত্যের পূর্ণ অনুসারী। কোরআন ও হাদীসের মাপকাঠিতে পরখ
করে আমরা এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হযেছি যে, সাহাবাদের
জামায়াত একটি সত্যপন্থি জামায়াত। তাদের ইজমা অর্থাৎ সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তকে আমরা
শরীয়তের প্রামান্য দলীল রূপে এজন্যে মেনে থাকি যে, কোরআন ও
হাদীসের সাথে সামান্যতম বিরোধমুলক বিষয়েও সকল সাহাবাদের একমত হযে যাওয়া সম্পূর্ণ
অসম্ভব। (তরজমানুল কোরআন, জিলদ ৫৬, সংখ্যা
৫)।
মন্তব্য: উপরের
আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, জামায়েতে ইসলামির আকিদা হল: আল্লাহর রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কেউই সত্যের মাপকাঠি নয়। ।
০৩। তাকলীদ বা যে
কোন এক মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ করা প্রসঙ্গে।
পূর্বের দেওবন্দীদের আলোচনা থেকে জানতে
পেরেছি যে, দেওবন্দীগন যে কোন এক মাজহার মানাকে ওয়াজিব মনে করে থাকেন। যত্র তত্র
মাজহার পরিবর্তনের ও সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে সালাফিগন চার মাযহাবের ইমামদের হক জানে
কিন্তু যে কোন এক ইমামের অনুসরণ ওয়াজির মনে করে না। চার ইমামসহ অন্য যে কারও
মাসয়ালা কুরআন সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী মনে করে তারই অনুসরণ করে থাকে। এ ব্যাপার জামায়েতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ
আবুল আ’লা
মওদুদীর বক্তব্য একেবারেই সালাফিদের মত যা দেওবন্দ আকিদার সম্পুর্ন বিরোধী। তিনি তার লিখিত গ্রন্থে এ ব্যাপারটি ষ্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন।
রাসায়েল
ও মাসায়েলের প্রথম খন্ডের ১৪২ পৃষ্ঠায় মাওলানাকে প্রশ্ন করা হয়:
প্রশ্ন:
চার ইমামের তাকলিদ সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
জবাব: আমার মতে আলেমে দ্বীন লোকদের সরাসরি কুরবান সুন্নাহ থেকে
বিশুদ্ধ জ্ঞান হাসিলের চেষ্টা করা উচিত। এ গবেষনার কাজে অতীতের বড় বড় আলেমের মতামত
থেকে সাহায্য নেয়া উচিত। তা ছাড়া সর্ব প্রথম পক্ষপাতিত্বের উর্ধ্বে উঠে উদার ও
মুক্ত মন দিয়ে মতবিরোধপূর্ন মাসআলাসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে অতীতে শ্রষ্ঠ
মুজতাহিদগণের কার ইজতিহাদ কুরআন ও সুন্নাহর সংগে অধিক সামজ্ঞস্যপূর্ণ। এভাবে যেটা
সত্য বলে মনে হবে, সেটাই অণুসরন করবে।
আহলে হাদিসের সব মত ও মাসআলাই যে সহিহ তা আমি মনে করি না। আর
হানাফি বা শাফেয়ী কোন মাজহাবেরই পূর্নাংগ তাকলিদ (অন্ধ অনুসরণ) করতে
হবে, তাও আমি মনে করি না। কিন্তু জামায়েতে ইসলামির লোকদের যে আমার এ মতই মেনে চলতে
হবে, তারও কোন কারন নেই। তারা পক্ষপাত মুক্ত হয়ে
এবং কেবল মাত্র
নিজের মাজহার ই হক আর অন্যগুলি বাতিল, এ ধারনা হতে মুক্ত হয়ে জামায়েতে ইসলামির
অন্তরভূক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে হানাফি, শাফেয়ী, আহলে হাদিস কিংবা যে কোন ফিকহী
মাজহাবের উপর আমল করতে পারে।
প্রশ্ন: আহলে হাদিস চার ইমামের তাকলিদ করাকে হারাম ও শিরক
কলে আখ্যায়িত করে। তাদের বক্তব্য কি ঠিক? আহলে
হাদিস কি কারো তাকলিদ করছে না? মুলত তাকলিদ জিনিসটা কি? তাকলিদ কি জরুরি?
জবাব: ইসলামে মুলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া
আর কারো তাকলিদ করা যায় না। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তাকলিদ
এজন্য করা হয় যে তিনি যা কিছু বলেছেন ও করেছেন তা আল্লাহর হুকুম ও নির্দেষের
ভিত্তিতে করেছেন। আর অনুগত্য লাভের একমাত্র প্রকৃত মালিকতে মহান আল্লাহ।
ইমামগনের অনুসবনের তাত্পর্য হল, তারা আল্লাহ ও রসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রদত্ত বিধানের উপর ইসতেহাদ করেছেন। এ গবেষনা ও ইসতেহাদ দ্বারা তারা জানতে পেরেছেন,
ইবাদত ও আচার আচরনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের কি পন্থা অবলম্ভন করা উচিৎ। এ ছাড়া তারা
শরিয়তের মূলনিতীর ভিত্তিতে এর প্রাশংগিক বিধান বাহির করছে। সুতরং তারা নিজেরা কোন
বিধান/হুকুম চালু করেনি। আর অনুগত্য লাভের দাবিও তারা করেনি। বরঞ্চ তারা অজ্ঞ
লোকদের জন্য শরীয়ত সম্পর্কে জানার নির্ভর যোগ্য মাধ্যম। যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান
ও সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন মুলনিতী আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারনের যোগ্যতা রাখে না,
তার জন্য ইমামের অনুসরন ছাড়া বিকল্প নেই। বিজ্ঞ ইমামদের থেকে যার প্রতি তার আস্থা
হয়। তার প্রদর্শিত পন্থা্বই সে অনুসরন
করতে পারে। এই প্রকৃত তথ্যের বিত্তিতে, যদি কেউ অনুসরন করে, তবে তার বিরুদ্ধে কোন
অভিযোগ উত্তলনের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু যে কেই যদি তাদের কে হুকুম কর্তা মনে করে,
কিংরা তাদের প্রতি এমন চরম অনুগত্য প্রকাশ করে যা, কেবল আল্লাহর জন্যই করা হয়ে
থাকে। অর্থাৎ কোন ইমামেন প্রদর্শিত তরীকা থেকে দুরে সরে যাওয়াকে মাজহাবেন উপর
দ্বীন থেকে সরে যাওয়া মনে করে থাকে। এবং তার উদ্ভাবিত কোন মাসআলাকে সহিহ হাদিস ও
কুরাআনেন খেলাফ পাওয়া সত্বেও যদি তার অনুসরণে অটল থাকে, তবে এটা নি:সন্দেহে শির্ক
হবে। (রাসায়েল ও মাসায়েলের প্রথম খন্ডের ১৪২ পৃষ্ঠা এবং তরজমানুল কুরআন, জুলাই –
অক্টোবর ১৯৪৪)।
প্রশ্ন:
কোন মুহাক্কিক আলেম প্রশিদ্ধ চার মাযহাব ত্যাগ করে হাদিস অনুসরন করার কিংবা ইসতিহাদ
করার অধিকার রাখে কি না? যদি অধিকার না
রাখেন তবে তার সপক্ষে দলিল কি? আর যদি অধিকার রাখেন তবে “তাহতাবী’ গ্রন্থে
একজন অতিবড় ফকিহ কর্তৃক এ কথা বলার তাত্পর্য কি?
“নিজের ইসতিহাদ এবং দলিল প্রমানের ভিত্তিতে এক মাযহাব
ত্যাগ করে অন্য মাযহার অরলম্ভর কারী গুনাহগার এবং শাস্তি পাওয়ার যোগ্য”।
জবাব: আমার মতে দ্বীনি ইলম সম্পর্কে বুত্পত্তি রাখেন এমন
ব্যক্তির জন্য তাকলিদ নাজায়েয এবং গুনাহ, বরং তার চাইতেও সাংঘাতিক। কিন্তু এ কথা
মনে রাখতে হবে যে, বিচার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কোন ফিকহি মাযহাবের অনুসরণ করা এক
জিনিস আর তাকলিদ করার কসম খেয়ে বসা সম্পুর্ন অন্য জিনিস। এ শেষোক্ত জিনিসটি আমি
সহিহ মনে করি না।
“তাহতাবী’
যে ফতোয়া আপনি উদ্ধৃত করছের, সে
সম্পর্কে আমার বক্তব্য হল, সেটা যতো বড় আলিমের লেখাই হোকনা কেন, তা আমি গ্রহন
যোগ্য মনে করিনা। আমার মতে এক মাযহাব ত্যাগ করে অন্য মাযহার অবলম্বনে কেবল তখনই
গুনাহ হতে পারে, যখন তা করা হবে খেয়াল খুশির বশবর্তী হয়ে। ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের ভিত্তিতে
নয়। (তরজমানুল কুরআন জুলাই – আক্টবর ১৯৪৪
এবং রাসায়েল ও মাসায়েলের প্রথম খন্ডের ১৪৯ পৃষ্ঠায়)।
মন্তব্যঃ তাকলীদ সম্পর্কে জামাতের বা মোওদূদীর মনভার একেবারে
পরিস্কার যে, ইসলামে ধর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কারো
তাকলিদ করা যায় না। কিন্তু তারা এ বিশ্বাস করে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান ও
সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, মুলনিতী আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারনের যোগ্যতা রাখে
না, তার জন্য ইমামের অনুসরন ছাড়া বিকল্প নেই।
০৪। সুফিবাদ বা তাসাওউফ সম্পর্কে।
এ কথা সর্বজন বিধিত যে
মওদূদী ও জামায়েতে ইসলামি সব সময় সুফিবাদ বা তাসাওউফ বিরোধী মন ভাব প্রসন করে
থাকে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মাওদূদী সুফিবাদ বা তাসাওউফ কে ব্যর্থ প্রমানে জন্য “ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন” নামক বই এ
“বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত” শিরোনামে লিখেছেন,
এ পৃথিবী এবং এই পার্থিব অস্তিত্ব মানুষের জন্যে কারাগারের শাস্তি স্বরূপ। দেহ পিঞ্জরে আবদ্ধ মানুষের প্রাণ আসলে একটি
শাস্তিভোগী কয়েদী। সমস্ত আমোদ-আহলাদ, কামনা-বাসনা, স্বাদ ও দৈহিক প্রয়োজন আসলে এই
কারাগারের শিকল ও লোহার বেড়ী মাত্র। মানুষ এ জগত এবং এর বস্তুনিচয়ের সংগে যত বেশী
সম্পর্ক রাখবে, ততই আবর্জনায় তার সারা অংগ ভরে যাবে এবং তত বেশী শস্তিলাভের অধিকারী হবে। নাজাত ও মোক্ষ লাভের একটি মাত্র পথ আছে। এ জন্যে জীবনের যাবতীয় আনন্দ- উচ্ছাস থেকে
সম্পর্কচ্যুত হতে হবে। সমস্ত কামনা-বাসনাকে নিমূর্ল করতে হবে্ সকল প্রকার ভোগ পরিহার করতে হবে। দৈহিক প্রয়োজন এ ইন্দ্রিয়ের দাবিসমূহ অস্বীকার করতে হবে। পার্থিব বস্তু সমষ্টি এবং রক্তমাংসের সম্পর্কের
সাথে যুক্ত যাবতীয় স্নেহ-প্রেম-ভালবাসাকে হৃদয় থেকে নিশ্চিত করে দিতে হবে। সর্বোপরি নিজের দেহ ও ইন্দ্রিয়রূপ শত্রুকে
ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে পীড়ন করতে হবে এবং এত অধীক পরিমাণ পীড়ন করতে হবে যে, আত্মার উপরে তাদের কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠিত থাকতে না পারে্ এভাবে আত্মা সূক্ষ্ম, পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে যাবে
এবং নাজাতের উন্নত স্থানসমূহে উড্ডীন হবার শক্তি অর্জন করবে।
এটি আসলে একটি অসামাজিক মতবাদ। কিন্তু সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর
বিভিন্নভাবে এ মতবাদ প্রভাব বিস্তার করে। এর ভিত্তিতে একটা বিশেষ ধরনের জীবন দর্শন গড়ে
ওঠে। তার
বিভিন্ন রূপ বেদান্তবাদ, মনুবাদ, প্লেটোবাদ, যোগবাদ,
তাসাউফ, খ্রীস্টীয় বৈরাগ্যবাদ ও বুদ্ধমত
প্রভৃতি নামে পরিচিত। এই দর্শনের সংগে এমন একটি নৈতিক ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে
যা খুব কম ইতিবাচক এবং খুব বেশী বরং পুরোপুরি নেতিবাচক হয়। এ দুটি বস্তু সম্মিলিতভাবে সাহিত্য, আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও
কর্মজীবনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। যেখানে তাদের প্রভাব পৌঁছায় সেখানে আফিম এ কোকেনের কাজ করে।
নির্ভেজাল জাহেলিয়াত এবং শির্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াতের
সংগে এই এ “বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত”
সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে সহেযোগিতা করেঃ
(১) এই
বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত সৎ ও ধর্মভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার ঝামেলা মুক্ত করে
নির্জনবাসী করে তোলে এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের জন্যে পথ পরিষ্কার করে দেয়। অসৎ লোকেরা খোদার দুনিয়ায় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করে অবাধে ফিতনা ফাসাদ
সৃষ্টি করে বেড়ায় আর সৎ লোকেরা নিজেদের নাজাত ও মোক্ষ লাভের চিন্তায় তপস্যা ও
সাধনায় আত্মনিয়োগ করে।
(২) এই
জাহেলিয়াতে প্রভাবে জনগণের মধ্যো অবাঞ্ছিত ধৈর্য, সহিষ্ণতাও
নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভংগীর সৃষ্টি হয় এবং তারা তার সহজ শিকারে পরিণত হয়। এজন্যে রাজা-বাদশাহ আমীর-ওমরাহ ও ধর্মীয়
কর্তৃত্বশালী শ্রেণী হামেশা এই বৈরাগ্যবাদী দর্শনে নৈতিক আদর্শের প্রচার ও
বিস্তারে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন। আর তাদের ছত্রছায়ায় এই মতবাদ নিশ্চিন্তে বিস্তারলাভ করেছে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও পোপবাদের সংগে এই
বৈরাগ্যবাদী দর্শনের কোনোকালে কোনো সংঘাত হয়েছে বলে ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্তও
পাওয়া যাবে না।
(৩) এই
বৈরাগ্যবাদী দর্শন মানব প্রকৃতির নিকট পরাজিত হলে নানান রকমের বাহানা তালাশ করতে
শুরু করে । কোথাও
কাফ্ফারা দানের নীতি উদ্ভাবন করা হয়। এতে করে একদিকে মনের আশা মিটিয়ে গোনাহ করা যায় আবার অন্যদিকে
জান্নাত ও ছাড়া হয় না। কোথাও
ইন্দ্রিয় সুখ চরিতার্থ করার জন্যে দেহকেন্দ্রিক প্রেমের বাহানা করা হয়। এর ফলে অন্তরের আগুনে ঘৃতাহুতিও দেয়া হয় আবার
সংগে সংগে ‘হুজুরে আলার’ পাক-পবিত্রতার মধ্যেও কোনো পার্থক্য
সূচিত হয় না। আবার
কোথাও সংসার বৈরাগ্যের অন্তরালে রাজা-বাদশাহ ও ধনিকদের সাথে যোগসাজশ করে
আধ্যাত্মিকার জাল বিছানো হয়। এর জঘন্যতম রূপ প্রদর্শন করেছেন রোমের পোপ
সম্প্রদায় ও প্রাচ্য জগতের রাজা-বাদশাহগণ।
এ জাহেলিয়াত নিজের
স্বগোত্রীয়দের সংগে এহেন ব্যবহান করে থাকে। কিন্তু নবীগণের উম্মতের মধ্যে এর অনুপ্রবেশ আরেক দৃশ্যের
অবতারণা করে। খোদার
দ্বীনের ওপর এর প্রথম আঘাত হলো এই যে, সে এ দুনিয়াকে কর্মস্থল, পরীক্ষাস্থল ও পরকালের কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তে ‘দারুল
আজাব’ ও ‘মায়াজাল’ হিসেবে মানুষের সম্মুখে পেশ করে। দৃষ্টি ভংগির এই মৌলিক পরিবর্তনের
কারণে মানুষ ভুলে যায় যে, তাকে এ পৃথিবীতে খোদার প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছে। সে মনে করতে থাকে, ‘আমি এখানে কাজ করার ও পৃথিবীর
যাবতীয় বিষয়াবলী পরিচালনা করার জন্যে আসিনি বরং আমাকে আবর্জনা ও অপবিত্রতার মধ্যে
নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ থেকে গা বাঁচিয়ে আমাকে দূরে সরে যেতে হবে। আমাকে এখানে নন-কোঅপারেটর হিসেবে থাকতে হবে
এবং দায়িত্ব গ্রহণ করার পরিবর্তে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে’। এধারণার ফলে পৃথিবী ও তার সমুদয় কার্যাবলী সম্পর্কে মানুষ
কেমন যেন সংশয়ী ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে এবং খোদার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব তো দূরের
কথা,সমাজের
দায়িত্ব গ্রহণ করতেও ভয় করে। তার জন্যে শরিয়তের সমগ্র ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইবাদত-বন্দোগী ও খোদার আদেশ-নিষেধ যে পার্থিব
জীবনের সংস্কার ও খোদার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্যে মানুষকে তৈরী
করে, এগুলোর
এ-অর্থ তাদের নিকট অগ্রাহ্য হয়। বিপরীত পক্ষে সে মনে করতে থাকে যে, ইবাদত-বন্দেগী এবং কতিপয় বিশেষ
ধর্মীয় কাজ জীবনের গোনাহসমূহের কাফ্ফারা স্বরূপ। কাজেই কেবল এগুলিকেই পূর্ণ মনোযোগের সংগে
যথাযথ পরিমাপ করে সম্পাদন করা উচিত, তাহলেই আখেরাতে নাজাত ও মোক্ষলাভ করা যাবে।
এই মানসিকতা নবীগণের উম্মতের একটি অংশকে মোরাকাবা, মোশাহাদা, কাশফ, রিয়াজাত, চিল্লাদান,
অজীফা পাঠ, আমালিয়াত, মাকামাত,
সফর ও হাকীকত প্রভৃতির দার্শনিক ব্যাখ্যার, গোলক
ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছে। তারা মুস্তাহাব ও নফল আদায়ের ব্যাপারে ফরজের চাইতেও বেশী
মনোযোগী হয়েছে। এভাবে
খোদার যে প্রতিনিধিত্বের কাজ জারি করার জন্যে নবীগণ তাশরিফ এনেছিলেন, তা থেকে তারা গাফেল হয়ে গেছে। অন্যদিকে আর একটি অংশের মধ্যে কাশ্ফ ও কেরামত, দ্বীনের নির্দেশের ব্যাপারে
অযথা বাড়াবাড়ি, অনর্থক প্রশ্ন উত্থাপন ছোট ছোট জিনিসকে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিমাপ করা এবং খুঁটিনিটি ব্যাপারে অস্বাভাবিক মনোযোগ ও যত্ন
নেয়ার রোগ জন্ম নিয়েছে। এমনকি খোদার দ্বীন তাদের নিকট এমন একটি হালকা কাঁচপাত্রে
পরিণত হয়েছে, যা সামান্য কাথায় বা সামান্য ব্যাপারে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যায়,
ফলে তাদের মনে সবসময় সন্ত্রস্তভাব বিরাজিত, যেন
একটু এদিক-ওদিক না হয়ে যায়, তাদের শিরোপরি রক্ষিত কাঁচপাত্র যেন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো না হয়ে যায়। এ সন্ত্রস্ততার মধ্যেই তাদের
সবটা সময় অতিবাহিত হয়। দ্বীনের
মধ্যে এই গভীর সূক্ষ্মতার পথ প্রশস্ত হবার পর অনিবার্যরূপে স্থবিরতা, সংকীর্ণ চিন্তা ও স্বল্প
হিম্মত সৃষ্টি হয়। তখন
মানুষের মধ্যে উচ্চতর যোগ্যতার চিহ্নই বা কেমন করে অবশিষ্ট থাকতে পারে।
(১) আমালিয়াত
তার চাইতে বড় বে-আমলের
পদ্ধতি আজ পর্যন্ত মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি।
(২) দুনিয়ায়
মাকামাত নয় রূহানী মাকামাত আধ্যাত্মিক জগত।
(৩) যেমন ধরুন সর্বেশ্বরবাদ। পৃথিবী পর্যবেক্ষণকারী দৃষ্টি দিয়ে মানব জীবনের
বৃহত্তম সমস্যাবলীকে সে কিভাবে নিরীক্ষণ করতে পারে! কিভাবে ইসলামের বিশ্বজনীন
মূলনীতিও খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করে যুগের প্রতিটি আবর্তনে
প্রতিটি নব পর্যায়ে সে মানবতাকে নেতৃত্বদান করতে পারে!
তিনি আরও বলেন,
খোদার নবীগণের শিক্ষার প্রভাবে যেখানে মানুষ একমাত্র পরাক্রমশীল খোদার
কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে অন্যান্য খোদার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে সত্য;
কিন্তু নবী, ওলী, শহীদ,
দরবেশ, গওস, কুতুব,
ওলামা, পীর ও ঈশ্বরের বরপুত্র দের ঐশ্বরিক
কর্তৃত্ব তবুও কোনো না কোনো পর্যায়ে ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে স্থানলাভ করতে সক্ষম
হয়েছে। অজ্ঞ
লোকেরা মুশরিকদের খোদাগণকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর সেইসব নেক বান্দাদেরকে খোদার
আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, যাদের সমগ্র জীবন
মানুষের কর্তৃত্ব খতম করে একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে ব্যয়িত
হয়েছিল। একদিকে
মুশরিকদের ন্যায় পুজা-অর্চনার পরিবর্তে ফাতেহাখানি, জিয়ারত, নজরনিয়াজ,উরূস,
চাদর চড়ানো, তাজিয়া করা এবং এই ধরনের আরো
অনেক ধর্মীয় কাজ সম্বলিত একটি নতুন শরিয়ত তৈরী করা হয়েছে। আর অন্যদিকে
কোনো তত্ত্বগত দলিল প্রমাণ ছাড়া ঐসব নেক লোকদের
জন্ম-মৃত্যু, আবির্ভাব-তিরোভাব, কাশফ-কেরামত,
ক্ষমতা-কর্তৃত্ব এবং আল্লাহর দরবারে তাঁদের নৈকট্যের ধরন সম্পর্কে
পৌত্তলিক মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের সংগে সর্বক্ষেত্রে সামঞ্জস্যশীল একটি পৌরাণিকবাদ
তৈরী করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ
‘ওসিলা’, ‘রূহানী’,
‘মদদ’, ‘ফয়েজ’ প্রভুতি
শব্দগুলোর সুদৃশ্য আবরণের আড়ালে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার যাবতীয় সম্পর্ককে ঐ সব
নেক লোকদের সংগে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যেসব মুশরিকের মতে বিশ্ব প্রভুর নিকট পৌঁছবার সাধ্য মানুষের
নেই এবং মানুষের জীবনের সংগে সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় নীচের স্তরের কর্ম-কর্তাদের
সংগে জড়িত, কার্যতঃ সেইসব আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকারকারি
মুশরিকের মতো অবস্থা সেখানেও সৃষ্টি হয়। তবে পার্থক্য এতটুকু যে,
তারা এই নীচের কর্মকর্তাদেরকে প্রকাশ্য উপাস্য, দেবতা, অবতার অথবা ঈশ্বরের পুত্র বলে থাকে আর এরা
গওস, কুতুব, আবদাল, আওলিয়া, আহলুল্লাহ প্রভুতি শব্দের আবরণে ওদেরকে ঢেকে
রাখে ।
মন্তব্য: “তাসাওউফ বা সুফিবাদ’ সম্পর্কে জামায়েত ও সালাফিদের অনেকটা মিল
খুজে পাওয়া যায়। জামায়েত ও সালাফিদের মত আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য কুরআন সুন্নাহ
ভিত্তিক আমলের কথা বলেন। এবং তারা প্রচলিত পীর মুরিদী বা “তাসাওউফ বা সুফিবাদ’ কে
সম্পুর্ণ ইসলাম বহির্ভূত মনে করে থাকেন। উপরের লেখা যারই প্রমান বহন করে।
০৫। ইমাম মাহদী
আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে।
“ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন” নামক বইটিতে আবুল আ’লা মাওদূদী, ইমাম
মাহদী আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে অনেকগুলি মন্তব্য লিখেন, যা সেই সময়ের অনেকে সমলোচনা
করেন। যারা তার এই মন্তব্যগুলির সমালোচনা করেন তাদের বেশীর ভাগই দেওবন্দী আলেম।
উদাহরন সরুপ বলা যায় উক্ত বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন:
মুসলমানদের
মধ্যে যারা ইমাম মেহদীর আগমনের ওপর বিশ্বাস রাখেন তারা যথেষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থান করছেন এবং তাদের বিভ্রান্তি এর প্রতি অবিশ্বাসী নতুন প্রথা প্রবর্তনকারী মুতাজাদ্দিদের থেকে কেনো অংশে কম নয়। তাঁরা মনে করেন, ইমাম মেহদী পুরাতন যুগের কোনো সুফী ধরনের লোক হবেন। তসবিহ হাতে নিয়ে অকস্মাৎ কোনো মদ্রাসা বা খানকাহ থেকে বের হবেন। বাইরে এসেই ‘আনাল মেহদী’ -আমিই মেহদী বলে চর্তুদিকে ঘোষণা করে দেবেন। ওলামা ও শায়খগণ কিতাব পত্র বগলে দাবিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছে যাবেন এবং লিখিত চিহ্ন সমূহের সঙ্গে তাঁর দেহের গঠন প্রকৃতি মিলিয়ে দেখে তাকে চিনে ফেলবেন। অতঃপর বাইয়াত গ্রহণ শুরু হবে এবং জিহাদের এলান করা হবে। সাধনাসিদ্ধ দরবেশ এবং পুরাতন ধরনের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীরা তাঁর পতাকাতলে সমবেত হবেন।নেহাত শর্ত পূরণ করার জন্যে নামমাত্র তলোয়ার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে, নয়তো আসলে বরকত ও আধ্যাত্মিক শক্তি বলেই সব কাজ সমাধা হয়ে যাবে। দোয়া-দরুদ-জেকের-তাসবিহের জোরে যুদ্ধ জয় হবে। যে কাফেরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে সে-ই তড়পাতে তড়পাতে বেহুশ হয়ে যাবে এবং নিছক বদদোয়ার প্রভাবে ট্যাংক ও জংগী বিমানসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে।
মেহদীর আবির্ভাব সম্পর্কে সাধারণ লোকদের মধ্যে অনেকটা এই ধরনের বিশ্বাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু আমি যা অনুধাবন করেছি, তাতে দেখছি ব্যাপার সম্পূর্ণ উল্টো। আমার মতে আগমনকারী ব্যক্তি তার নিজের যুগের একজন সম্পূর্ণ আধুনিক ধরনের নেতা হবেন। সমকালীন সকল জ্ঞানবিজ্ঞানে তিনি হবেন মুজতাহিদের ন্যায় গভীর জ্ঞান সম্পন। জীবনের সকল প্রধান সমস্যাকে তিনি ভালভাবে উপলব্ধি করবেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার দিক দিয়ে সমগ্র বিশ্বে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করবেন এবং সকল আধুনিকদের চাইতে বেশী আধুনিক প্রমানিত হবেন। আমার আশংকা হয়, তাঁর নতুনত্বের বিরুদ্ধে মৌলবী ও সুফী সাহেবরাই আগে চিৎকার শুরু করবেন। উপরন্ত
আমার মতে সাধারণ মানুষের থেকে তাঁর দৈহিক গঠন ভিন্ন রকমের হবে না এবং নিশানী দেখে
তাঁকে চিহ্নিত করাও যাবে না। এবং তিনি নিজের মেহদী হবার কথাও ঘোষণা করবেন না। বরং
হয়তো তিনি নিজেও জানবেন না যে, তিনি মেহদী
। তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত তাঁর কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করে মানুষ জানবে যে, তিনিই
ছিলেন নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠাকারী মেহদী। এতদিন তাঁরই আগমনের সুসংবাদ
শুনানো হয়েছিল।
এই লেখা
সম্পর্কে উপমহাদেশের অনেক আলেমই আপত্তি তুলছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশের দেওবন্দী
ঘরানার আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন অন্যতম, তিনি তার লিখেত “ইসলামি
আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ’ বই এ অনেকগুলি অধিযোগ করেন। যেমন:
প্রথম
অভিযোগ:
আবুল আ’লা মাওদূদীর মতে, পীর আওলিয়া বা ফকির
দরবেশদের ভাবমূর্তি এবং ইসলামি লেবাস-পোশাক, বুজুর্গদের কারামত, বরকত ও অধ্যাত্বিক
শক্তির ধারনাকে অত্যান্ত তাচ্ছিল্য ও বিদ্রুপের ভাষায় এবং হাস্যকর ভংগিতে বিবরন
দিয়েছেন।
দ্বিতীয়
অভিযোগ:
আবুল আ’লা মাওদূদীর মতে, অলী আওলিয়াদের
নিকট ইমাম মাহদী আ: এর আগমণকে অস্বীকার করেছেন।
অথচ সহিহ
হাদিসে এসেছেঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের গুপ্তধনের নিকট
তিনজন লোক ঝগড়া করবে। প্রত্যেকেই হবে খলীফার পুত্র। কেউ তা দখল করতে পারবেনা।
অতঃপর পূর্বের দিক থেকে কালো পতাকাধারী একদল সৈনিক আসবে। তারা ব্যাপক হত্যাকান্ড
চালাবে। হাদীছের বর্ণনাকারী বলেন, ‘‘এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু বিষয়ের কথা বর্ণনা
করলেন যা আমি স্মরণ রাখতে পারিনি। তোমরা যখন তাদেরকে দেখতে পাবে তখন তাদের নেতার
হাতে বায়আত করবে। যদিও বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হতে হয়। কেননা তিনি হলেন
আল্লাহর খলীফা মাহদী’’। ( ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান। নাসির উদ্দিন আলবানী (রহঃ) বলেনঃ ‘আল্লাহর খলীফা’ কথাটি ব্যতীত হাদীছের বাকী অংশ সহীহ)।
তৃতীয়
অভিযোগ:
আবুল আ’লা মাওদূদীর মতে, ইমাম মাহদির
হাতে বাইয়াত গ্রহনের মত কিছু হবে না। (তাকে কেউ চিনতে পারবেনা বা তার আগমন ও
প্রস্থান হবে অগোচরে)।
চতুর্থ
অভিযোগ:
আবুল আ’লা মাওদূদীর মতে, ইমাম মাহদি আ: এর কাজের
কোন অংশে অস্বাভাবিকতা, কাশফ, ইলহাম, চিল্লা, মুজহাদা ও মুরাকারার কোন এস্থান
থাকবে না।
মন্তব্য: প্রথম দুটি অভিযোগ
সুফিবাদের সাথে সম্পর্কিত আর আবুল আ’লা মাওদূদীর যেহেতু সুফিবাদে বিশ্বাসি ছিলেন
না, তাই তার মন্তব্য সুফিবাদে বিশ্বাসি লোকদের থেকে ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। আমার মতে তৃতীয় অভিযোগের তিনি অভিযুক্ত বলতে পারেন।
চতুর্থ অভিযোগের উত্তর পরের
আলোচনায় মওদূদীর নিজের ভাষয় পাবেন।
আবুল আ’লা মাওদূদীর “ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন” বইয়ের এই বাক্যটি
সরাসরি সহিহ হাদিস বিরোধী। বাক্যটি হলঃ “তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত তাঁর
কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করে মানুষ জানবে যে, তিনিই ছিলেন
নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠাকারী মেহদী”। অথচ সহিহ হাদিসে এসেছে, জাবের (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ঈসা (আঃ) যখন অবতরণ করবেন তখন মুসলমানদের আমীর তাঁকে
বলবেনঃ আসুন! আমাদের নামাযের ইমামতি করুন। ঈসা (আঃ) বলবেন, বরং তোমাদের আমীর তোমাদের
মধ্যে হতেই। এই উম্মতের সম্মানের কারণেই তিনি এ মন্তব্য করবেন। (আল-মানারুল
মুনীফ, (পৃষ্ঠা নং-১৪৭-১৪৮) ইমাম ইবনুল কায়্যিম বলেনদ,
হাদীছের সনদ ভাল)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘সেদিন কেমন হবে তোমাদের অবস্থা যেদিন তোমাদের মধ্যে ঈসা ইবনে মারইয়াম নেমে
আসবেন এবং তোমাদের মধ্যে হতেই একজন ইমাম হবেন’’। ( বুখারী, অধ্যায়ঃ আহাদীছুল আম্বীয়া, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের গুপ্তধনের
নিকট তিনজন লোক ঝগড়া করবে। প্রত্যেকেই হবে খলীফার পুত্র। কেউ তা দখল করতে পারবেনা।
অতঃপর পূর্বের দিক থেকে কালো পতাকাধারী একদল সৈনিক আসবে। তারা ব্যাপক হত্যাকান্ড
চালাবে। হাদীছের
বর্ণনাকারী বলেন, ‘‘এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু বিষয়ের কথা বর্ণনা
করলেন যা আমি স্মরণ রাখতে পারিনি। তোমরা যখন তাদেরকে দেখতে পাবে তখন তাদের নেতার
হাতে বায়আত করবে। যদিও বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হতে হয়। কেননা তিনি হলেন
আল্লাহর খলীফা মাহদী’’। ( ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান। ইমাম আলবানী বলেনঃ ‘আল্লাহর
খলীফা’ কথাটি ব্যতীত হাদীছের বাকী অংশ সহীহ)।
মন্তব্যঃ ঈসা আলাইহিস সালাম ইমাম মেহেদির পিছনে সালাত আদায়
করবেন। লোকজন তার হাতে বাইয়াত গ্রহন করবের। এই মর্মে বর্ণিত সহিহ হাদিস মিথ্যা
প্রমানিত হয়।
১৯৪০ সালে যখন বইটি লেখা হয়
তখনই সমালোচনার ঝড় উঠে। যেহেতু তখন আবুল আ’লা মাওদূদীর জীবিত ছিলেন তাই সেই সকল
সমালোচনার উত্তরগুলি তার সম্পাদিত “তরজুমানুল
কুরআন” পত্রিকার মাধ্যমে প্রদান করেন। এবং তার অবস্থান পরিস্কার করেন। যা
পরবর্তিতে ১৯৬০ সালে মুল বইয়ের সাথে সংযুক্ত করেন। সেই সময়ের
অভিযোগ সমুহের সার সংক্ষেপ তুলা ধরা হল:
প্রথম
অভিযোগ:
আপনার ওপর দোষারোপ করা হয় যে, আপনি আসলে নিজে মুজাদ্দিদ বা মেহদী হবার আশাবাদি। কথাটি কত টুকু সত্য?
জবাব: সর্বপ্রথম ১৯৪১ সালে
মওলানা মুনাজির আহসান গীলনী করুণা বশতঃ নিম্নস্বরে আমাকে এ সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর জবাবে আমার সন্দেহ
নিরসন নামক প্রবন্ধে আমি আরজ করেছিলামঃ
“আমার
সাহসসুলভ শব্দাবলী থেকে সম্ভ্বতঃ আপনার মনে এ ধারণা জন্মেছে যে, আমি নিজেকে বিরাট কিছু মনে করি এবং কোন বিরাট মর্যাদার আশা পোষণ করি। অথচ আমি যা কিছু করছি
কেবল নিজের গোনাহ মাফ করাবার জন্যে করছি। নিজের মূল্য আমি খুব ভাল করেই জানি। বিরাট মর্যাদা তো দুরের
কথা যদি কেবল শাস্তি থেকেও নিস্কৃতি পাই, তাহলেও আশাতিরিক্ত মনে করি”। (তর্জমানুল কোরআন,
সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নবেম্বর,
১৯৪১)
অতঃপর এ
সময় মওলানা সাইয়েদ সোলায়মান নদবী (র) আমার একটি বাক্য ওলট পালট করে তা থেকে এ
অর্থ গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। যে আমি মুজাদ্দিদ হবার দাবীদার। অথচ ঐ বাক্যের মধ্যে আমি
নিজের নগন্য প্রচেষ্টাবলীকে দ্বীনের তাজদীদের প্রচেষ্টার মধ্যে একটি প্রচেষ্টা বলে
গন্য করেছিলাম। তাঁর
এই সুষ্পষ্ট দোষারোপের জবাবে আমি বলেছিলামঃ
“কোন
কাজকে তাজদীদের কাজ বলার এ অর্থ হয় না যে, যে ব্যক্তি
তাজদীদের কাজ করবে তাকে মুজাদ্দিদ পদবীও দান করতে হবে। আর শতাব্দীর মুজাদ্দিদ
হওয়া তো অনেক বড় কথা। ইট উঠিয়ে নিয়ে প্রাচীর নির্মাণ করা অবশ্যি একটি গঠনমূলক
কাজ। কিন্তু
এর অর্থ এ নয় যে, যে ব্যক্তি কয়েকটি ইট উঠিয়ে নিয়ে বসিয়ে দেবে্। তাকে ইঞ্জিনিয়ান বলা হবে
আর ইঞ্জিনিয়ার ও সাধারণ নয় শতাব্ধীর ইঞ্জিনিয়ার? অনুরুপ ভাবে কোন ব্যক্তি নিজের
কাজকে যদি তাজদিদী কাজ বা তাজদিদী প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করে যখন বাস্তবে দ্বীনের
তাজদীদের উদ্দেশ্যই সে এ কাজ করে তখন সেটি হয় নিছক একটি বাস্তব ঘটনার প্রকাশ এবং
তার অর্থ এ হয় না যে, সে মুজাদ্দিদ হবার দাবী করছে এবং তার
শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হতে চায়। ক্ষুদ্রমনা লোকেরা অবশ্য সামান্য কাজ করে বড় বড় দাবী করতে
থাকে বরং দাবীর আকারেই কাজ করার বাসনা করে। কিন্তু কোন জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট আশা করা যায় না, যে, তিনি কাজ করার পরিবর্তে নিছক দাবী করবেন। দ্বীনের তাজদীদের কাজ
ভারতবর্ষে ও ভারতবর্ষের বাইরে অনেকে করেছেন। মওলানা সাহেবকেও (অভিযোগকারী) আমরা এরি মধ্যে গণ্য করি। আমিও নিজের সামর্থ
মোতাবেক এ কার্যে অংশ গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিএবং বর্তমানে আমরা কতিপয় দ্বীনের
খেদমতকারী একটি জামায়াতের আকারে এ কার্য সম্পাদন করার চেষ্টা করছি। আল্লাহতায়ালা যার কাজের
মধ্যে এমন বরকত দান করবেন যে, তার ফলে তার হাতে যথার্থ খোদার দ্বীনের তাজদীদের
কার্য সম্পন্ন হবে, আসলে তিনিই হবেন মুজাদ্দিদ। দাবী করা বা দুনিয়ার
কাউকে মুজাদ্দিদ উপাধি দান করা আসল জিনিস নয়। বরং আসল জিনিস হলো এই যে, মাণুষেকে এমন কাজ
করে তার যথার্থ মালিকের নিকট পৌছতে হবে যে, সেখানে যেন সে
মুজাদ্দিদের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়। মওলানার জন্যে আমি এ
জিনিসটিরই দোয়া করি। এবং তিনিও যদি অন্যের জন্যে এই দোয়া করেন যে, আল্লাহতায়ালা যেন
তার সাহায্যে দ্বীনের এমনি সব কার্য সম্পাদন করেন,তাহলেই
বেহতের হবে। আমি
আশ্চর্য হই যে, অনেক ইসলামী শব্দ কে খামাখা বিভীষিকা বানিয়ে রাখা হয়েছে। দুনিয়ার কোন ব্যক্তি
রোম জাতির গৌরব পুনরুদ্ধারের দাবী নিয়ে অবতীর্ণ হয় আর রোম জাতীয়তাবাদের পুজারিরা
তাঁকে স্বাগত জানায় কোন ব্যক্তি বৈদিক সভ্যতার পুনরুজ্জীবনের দাবী নিয়ে অগ্রসর হয়, আর হিন্দুরা তাকে
সমর্থন জানায়। কোন ব্যক্তি গ্রীক শিল্পকে পুররুজ্জীবিত করার ইচ্ছায়
এগিয়ে আসে আর শিল্পানুরাগীরা তার হিম্মত বাড়িয়ে দেয়। এ সকল সংস্কারমূলক
কার্যাবলির মধ্যে একমাত্র খোদার দ্বীনের সংস্কারটা কি এমন একটি অপরাধ যে, তার নাম উচ্চারণ
করতে লজ্জা অনুভব করবে এবং কেউ এ ধরনের চিন্তা প্রকাশ করলেই খোদার পূজারীরা তার
পিছনে লেগে যাবে?” (তর্জমানুল কোরআন, ডিসেম্বর
১৮৪১,জানু,ও ফেব্রু,১৮৪২)
এই
সুস্পষ্ট বিবরনের পরও আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের প্রচারণা বন্ধ করেননি। কেননা মুসলমানদেরকে আমার
বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্যে যে সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ করার প্রয়োজন ছিল তন্মধ্যে
আমার বিরুদ্ধে কোন প্রকার দাবী করার অভিযোগ উত্থাপন করাও একটি অস্ত্র ছিল। কাজেই ১৯৪৫ ও ৪৬সালে
অনবরত এ সন্দেহ চতুর্দিকে ছড়ানো হয়েছে যে, এ ব্যক্তি মেহদী দাবী করার প্রস্তুতি
নিচ্ছে। এ
সম্পর্কে আমি ১৯৪৬ সালের জুন সংখ্যা তর্জমানুল কোরআনে লিখেছিলামঃ
“যাঁরা
এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করে মানুষকে জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত থেকে দুরে সরিয়ে রাখার
চেষ্টা করছেন, আমি তাদেরকে এমন একটি ভয়াবহ শাস্তি দেবার
সিদ্ধান্ত করেছি যে, তা থেকে তারা কোনক্রমেই নিষ্কৃতি লাভ
করতে পারবে না। সে শাস্তি হলো এই যে, ইনশাআল্লাহ আমি সব রকমের দাবী থেকে নিজেকে
নিষ্কলুষ রেখে আমার খোদার সমীপে হাযির হয়ে যাবো এবং তারপর দেখবো যে, এরা খোদার সম্মুখে নিজেদের এইসব সন্দেহ এবং এগুলো বিবৃত করে মানুষকে
হকের পথে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখার স্বপক্ষে কি সাফাই পেশ করেন”।
এসব লোকের
দিলে যদি কিছু পরিমাণ খোদাভীতি ও পরকাল বিশ্বাস থাকতো, তাহলে আমার এ
জবাবের পর তাদের মুখে পুনর্বার এ অভিযোগ শুনা যেতো না। কিন্তু কেমন নির্ভীকভাবে
আজ আবার সেই অভিযোগগুলোকে ছড়ানো হচ্ছে, তা সবাই প্রত্যক্ষ করছেন। তর্জমানুল কোরআনের সম্প্রতিক
সংখ্যাসমুহে এ সম্পর্কে যা কিছু লিখেছি তা অধ্যায়ন করার পরও এদের কারুর মুখে
অপপ্রচার একটু ও বাধছে না। আখেরাতের ফয়সালা অবশ্যি খোদার হাতে কিন্তু আমাকে জানান এ
ধরনের কার্যকলাপের ফলে দুনিয়ায় আলেম সমাজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত থাকার আশা আছে কি?
মজার কথা
হলো এই যে, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন কিতাবের বিভিন্ন বাক্যের ওপর এসব সন্দেহের ভিত্তি
স্থাপন করা হযেছে এবং তার উদ্ধৃতাংশ বিভিন্ন রঙে রঙিন করে জনসমক্ষে উপস্থাপিত করে
জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। অথচ তারই পৃষ্ঠায় আমার এ কথাগুলো আছেঃ
“দাবীর
মাধ্যমে কার্যারম্ভ করার অধিকার নবী ছাড়া আর কারুর নেই এবং নবী ছাড়া আর কেউ
নিশ্চিতভাবে একথা জানেন না যে, তিনি কোন কার্যে আদিষ্ট
হয়েছেন মেহদী কোন দাবী করার জিনিস নয় । এ ধরনের দাবী যাঁরা করেন
আর যাঁরা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন আমার মতে তাঁরা উভয়েই নিজেদের জ্ঞানের
স্বল্পতার ও মানসিক অধোগতির প্রমাণ পেশ করেন”।
আজ যেসব
লোক আমার বই থেকে উদ্ধৃতাংশ পেশ করেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, আমার ঐ বইয়ে
উল্লেখিত কথাগুলো কি তাদের নজরে পড়েনি? অথবা তারা জ্ঞানের ও
গুলো প্রচ্ছন্ন রেখেছেন? (তর্জমানুল কোরআন ,যিলকদ, যিলহজ্জ, ‘৭০হিঃ
সেপ্টেম্বর ১৯৫১খৃঃ)।
দ্বিতীয়
অভিযোগ:
আপনি মেহদীর জন্যে কোন বিশেষ আলামত স্বীকার করতে রাজি নন। অথচ হাদীসে মেহদীর
আলামতের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে এ ক্ষেত্রে এসব হাদিসকে কেমন করে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?
(এমন অভিযোগ
মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীনের ও ছিল)।
জবাব: ইমাম মেহদীর আবির্ভাব
সম্পর্কে হাদীসে যে সব বর্ণনা আছে সে সম্পর্কে হাদীস বিশ্লেষনকারীগণ এত কঠোর
সমালোচনা করেছেন যে,
তাদের মধ্যে একটি দল আদতে ইমাম মেহদীর আবির্ভাবকে স্বীকারই করেন না। এ হাদীসগুলো যারা বর্ণনা
করেছেন তাদের সমালোচান করার পর জানা যায় যে, তাদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই শিয়া সম্প্রদায়
ভুক্ত।
ইতিহাস পর্যালোচনা করেও জানা যায় যে, প্রত্যেকটি দল নিজেদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয়
স্বার্থোদ্ধারের জন্যে এ হাদীসগুলো ব্যাবহার করেছেন এবং নিজেদের কোন ব্যক্তির
গায়ে সংশ্লিষ্ট আলামত সমুহ লাগিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। এসব কারণে আমি এই
মীমাংসায় পৌঁছেছি যে,
ইমাম মেহদীর নিছক আবির্ভাবের ব্যাপারে এ হাদীসগুলের বর্ণনা সত্য
কিন্তু বিস্তারিত আলামত সম্পর্কিত বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই সম্ভ্বতঃমনগড়া এবং
স্বার্থবাদীরা সম্ভবত পরবর্তীকালে এ গুলো নবী করিমের আসল বাণীর ওপর বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন যুগে যেসব লোক
মেহদী হবার মিথ্যা দাবী করেছে তাদের বইপত্রেও দেখা যায় যে, তাদের সকল ফেতনা
সৃষ্টির মূলে এই বর্ণনাগুলোই তথ্য সরবরাহ করেছে।
নবী করিমে
র (স) ভবিষ্যদ্বাণীসমুহ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করার পর আমি দেখেছি যে, তাদের ধরন কখনো
মেহদির আবির্ভাব সম্পর্কিত হদিসের ন্যায় নয়। নবী করিম (স) কখনও কোন আগমনকারী
বস্তুর আলামত বিস্তারিত বর্ণনা এ ভাবে দেননি। তিনি অবশ্যি বড় বড় মূল
আলামত বর্ণনা করতেন কিন্তু খুঁটিনিটি বিবরণ দান তার পদ্ধতি ছিল না।
তৃতীয়
অভিযোগ:
প্রতিশ্রুত মেহদি আধুনিক ধরনের লীডার হবেন আমার এ কথার অর্থ কি
জবাব:
প্রতিশ্রুত
মেহদি আধুনিক ধরনের লীডার হবেন আমার এ কথার অর্থ এ নয় যে, তিনি দাঁড়ি চেঁছে
ফেলবেন, স্যুট-কোট পরবেন এবং আপটুডেট ফ্যাসানে চলাফেরা
করবেন। বরং
এর অর্থ হলো এই যে,
তিনি যে জামানায় পয়দা হবেন সে জামানার জ্ঞান -বিজ্ঞান অবস্থা ও
প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ন ওয়াকেফহাল থাকবেন। সমকালিন যুগোপযোগী
বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন। এবং সমকালীন বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসন্ধানের মাধ্যমে
আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি ও উপায়-উপকরণ ব্যবহার করবেন। এটি একটি অকাট্য
যুক্তিপূর্ণ কথা। এর
জন্যে কোন হাদীসের প্রয়োজন নেই নবী করিম (স) যদি তাঁর যুগের পরিখা, কঠোর কামান (Battering
Ram), প্রস্তর নিক্ষেপন যন্ত্র প্রভৃতি ব্যবহার করতে পারেন তাহলে
আগামী কোন যুগে যে ব্যক্তি নবি করিমের স্থলাভিষিক্ত হক আদায় করতে অগ্রসর হবেন
তিনি অবশ্যি ট্যাংক এরোপ্লেন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমকালীন অবস্থা ও বিষয়াবলী থেকে
অসম্পর্কিত হয়ে কাজ করতে পারবেন না। শক্তির আধুনিকতম উপায়-উপকরণ লাভ করা এবং নিজের প্রভাব
বিস্তৃত করার জন্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও কর্ম পদ্ধতি ব্যবহার করাই হলো
কোন দলের উদ্দেশ্য সাধন ও কোন আন্দোলনের বিজয় লাভের স্বাভাবিক পথ।
চতুর্থ
অভিযোগ:
আলামতে কিয়ামত পুস্তুক (লেখকঃ মওলানা শাহ রফিউদ্দিন অনুবাদক: মৌলবী নুর মুহাম্মদ)
এ উদ্ধৃত একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘মেহদীর হাতে বায়েত গ্রহণ করার সময় আকাশ
থেকে আওয়াজ আসবে’। এ হাদিস সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
জবাব: আলামতে কিয়ামত কিতাবে যে
হদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিছুই বলতে পারি না। যদি তা নির্ভুল এবং সত্যি
নবী করিম (সঃ) যদি এমন খবর দিয়ে থাকেন যে, মেহদির হাতে বায়েত গ্রহণের সময় আকাশ থেকে
আওয়াজ আসবে যে, অর্থাৎ ইনিই আল্লাহর খলিফা মেহদী এঁর কথা
শুনো ও এঁর আনুগত্য করো তাহলে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পুস্তকে আমি এ সম্পর্কে
যে রায় পেশ করেছি তা ভুল। কিন্তু আমি আশা করি না যে, নবী করিম (স) এমন কথা বলবেন। কোরআন মজিদ অধ্যায়ন করে
জানা যায় যে, কোন নবীর আগমনেও আকাশ থেকে এ ধরনের আওয়াজ আসেনি। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদের
(স) পর ঈমান ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার দ্বিতীয় কোন সুযোগ আসবে না, তবুও তাঁর আগমনে
আকাশ থেকে এমন কোন আওয়াজ শুনা যায়নি। মক্কার মুশরিকরা দাবী
করতে থাকে যে, আপনার সাথে কোন ফেরেশতা থাকতে হবে তিনিই আমাদেরকে জানাবেন যে, ইনি খোদার নবী। অথবা এমন কোন সুস্পষ্ট নিশানী থাকতে হবে, যা থেকে
দ্ব্যর্থহীন ভাবে আপনার নবী হবার বিষয় জানা যাবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা
তাদের এ সকল দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এবং এগুলো গ্রহণ না করার কারণসমুহ কোরআনের
বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন যে, সত্যকে পূর্ণরূপে আবরণ মুক্ত করা, যার ফলে বুদ্ধিগত পরীক্ষার অবকাশ না থাকে, এমন
পদ্ধতি খোদার হিকমতের পরিপন্থি। এখন এ কথা কেমন করে মেনে নেয়া যেতে পারে যে, আল্লাহতায়ালা
তাঁর এই নিয়ম একমাত্র ইমাম মেহদীর ব্যাপারে পরিবর্তন করবেন,
এবং তাঁর বায়েতের সময় আকাশ থেকে আওয়াজ দেবেন যে, ইনিই খোদার
খলিফা মেহদী এঁর কথা শুনো, এঁর আনুগত্য কর। (তর্জমানুল কোরআন,রজব,১৩৬৫হিঃ,জুন,১৯৪৬খৃঃ)।
মন্ত্বব্যঃ
০৬। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইসলামী রাস্ট্র গঠনের পূর্ব প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং কোর্স মাত্র।
অনেকে জামায়েতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর
এই মতামতকে সমালোচনা করছেন। সমালোচকরা মনে করেন, এতে ইসলামের মূল ইবাদাতকে
হালকাভাবে গ্রহন করা হয়েছে। মনাব মওদূদী বলেন,
“বস্তুত ইসলামে নামাজ, রোজা, হজ্জ,
যাকাত ইত্যাদি ইবাদাত সমূহ এ উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে।
দুনিয়ায় সকল রাস্ট্রশক্তি নিজ নিজ সৈন্যবাহিনী, পুলিশ ও সিভিল
সার্ভিসের কর্মচারীদেরকে সর্বপ্রথম এক বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সে প্রশিক্ষণে উপযুক্ত প্রমাণিত
হলে পরে তাকে নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত করা হয়। ইসলাম তার কর্মচারিদের সর্বপ্রথম
এক ধরনের পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দিয়ে চায়। তার পর তাদের জিহাদ ও হুকুমাত
কায়েম করার দায়িত্ব দেয়া হয়”।(ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা; আধুনিক প্রকাশনি; প্রকাশ
কাল-২০১৪; পৃষ্ঠা–২৫৪)।
নামাজ,
রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি হল ইসলামের বুনিয়াদ
বা ফরজ ইবাদত। কিন্তু সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর দৃষ্টিতে এটি জিহাদ ও ইসলামী
হুকুমত কায়েমের লক্ষে একটি ট্রেনিং কোর্স। অথচ জিহাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল নামায,
রোজা, যাকাত, হজ্জ,
আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র
কালামে আল্লাহ বলেছেন,
ٱلَّذِينَ
إِن مَّكَّنَّـٰهُمۡ فِى ٱلۡأَرۡضِ أَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ
ٱلزَّڪَوٰةَ وَأَمَرُواْ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَنَهَوۡاْ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۗ وَلِلَّهِ
عَـٰقِبَةُ ٱلۡأُمُورِ (٤١)
অর্থঃ
তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং
সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের
পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে। (সুরা হজ্জ ২২:৪১)।উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হল কালিমা, নামায, রোজা, যাকাত, হজ্জ, সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অন্যায় কাজে বাঁধা প্রদান করা।
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।
0 Comments
Thanks for your comment