জামায়েতে ইসলামি-০৩
যে সকল
অভিযোগ জামায়েতে ইসলামি অস্বীকার করে।
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।
খ। যে সকল অভিযোগ জামায়েতে ইসলামি অস্বীকার করে।
০১। সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার প্রসঙ্গে
০২। মনগড়া
তাফসির করা সম্পর্কে
০৩। ঈসা
আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে
০৪। কুরআন
ও ইসলাম সর্বযুগে সংরক্ষিত কি না, এ প্রসঙ্গে।
০১।
সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার প্রসঙ্গে
সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর সব চেয়ে বেশী সমালোচিত হয়েছেন
সাহাবায়ে কেরাম সমালোচনার করা প্রসঙ্গে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যারা এর প্রতিবাদ
করেন তাদের মধ্যে দেওবন্দী আলেমগন অন্যতম।
মাওলনা মওদূদী (রহঃ) সাহাবি রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুমাদের
সম্পর্কে যে যে ভুল সমালোচনা করছেন, তার সমালোচনা করে মুফতি শফি (রহঃ) ছেলে,
পাকিস্থানের সাবেক চিপ জাস্টিস তাকী উসমানীর
লেখা “ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)” নামক বইটি খুবই গঠন মুলক। তিনি প্রতিটি ভুল সমালোচনা জবাব আঙ্গুল
দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তার সবগুলি এখানে বর্নণা করা সম্ভব নয়। শুধু কয়েকটি উদাহরন দিচ্ছি, বিস্তারিত
জানার জন্য “ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)” নামক বইটি পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। ক্রয় করার
সমস্যা হলে, স্ক্যান কপি নেট থেকে নিয়েও পড়তে পারেন। ইতিহাসের
কাঠগড়ায় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) বইটি মুলত মাওলানা মওদূদী (রঃ)-এর “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” নামক বইটিতে সাহাবি রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুমাদের সম্পর্কে যে
সমালোচনা করছেন তারই জবাব।
প্রথম অভিযোগঃ “খেলাফাত
ও মুলুকিয়াত” বইটিতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেন, “হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর
শাসনামল থেকেই এই নীতির সূচনা হয়। ইমাম যুহুরীর বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং
চারজন খোলাফায়ে রাশেদীনের যামানায় মুসলমানদের মধ্যে এ নীতি চলে আসছিল যে,
কাফের মুসলমানের ওয়ারিশ হতে পারতো না, আর
মুসলমান হতে পারতো না কাফেরের ওয়ারিস। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)
তাঁর শাসনামলে মুসলমানকে কাফেরের ওয়ারিস করেছেন, কাফেরকে
মুসলমানের ওয়ারিস করেননি। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয এ বেদআতকে রহিত করেন। কিন্তু হিসাম ইবনে আব্দুল মালেক তাঁর খান্দানের ঐতিহ্য
পুনর্বহাল করেন”। (আল-বেদায়া
ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৯; ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩২)। [“খেলাফাত ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৪৮” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): কাফের
মুসলমানের ওয়ারিশ হত পারা না পারা একটি ইখতেলাফি মাসায়েল। মুয়াবিয়ার পক্ষে উক্ত
কিতাবে অনেকের মতামত উল্লেখ করেছেন। মওদূদী লিখেছেন “হযরত ওমর ইবনে আব্দুল
আযীয এ বেদআতকে রহিত করেন”। তাকী উসমানীর দাবি ইমাম যুহুরীর বর্ণনা আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়ায়
অনুবাদ হবে, “হযরত ওমর ইবনে আব্দুল
আযীয পূর্ববর্তী সুন্নতটি পুনর্বহাল করেন”। ইহাকে বিদআত বলা মওদূদীর ঠিক হয়নি। আর মুয়াবিয়া (রাদিঃ) যেহেতু
ফকিহ্ সাহাবি ছিলেন কাজেই মাসায়েলেন ক্ষেত্রে তার ইখতেলাফ করার অধিকার আছে। এ জন্য
তাকে অভিযুক্তি করা ঠিক হয় নি। (ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:) পৃষ্ঠা-৩৩)।
দ্বিতীয় অভিযোগঃ
“খেলাফাত ও
মুলুকিয়াত” বইটিতেসাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেন, “হাফেজ ইবনে কাসীর বলেন,
রক্তপনের ব্যাপারেও হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)
খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে বদলিয়ে দেন।
সুন্নাত ছিল এই যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের
মুক্তিপণ মুসলিমের সমান হবে। কিন্তু হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)
তাকে অর্ধেক করে অবশিষ্ট অর্ধেক নিজে গ্রহণ করা শুরু করেন”। (আল-বেদায়া
ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৯)। ইবনে কাসীরের ভাষায়ঃ মুআ’বিয়াই প্রথম ব্যক্তি যিনি রক্তপণকে হ্রাস করে অর্ধেক করেছেন এবং অবশিষ্ট
অর্ধেক নিজে গ্রহণ করেছেন। [“খেলাফাত ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৪৮” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): বাইহাকিতে
ইমাম যুহরির বর্ণায় আছে, অবশিষ্ট অর্ধেক তিনি বইতুল মালে জমা করেতেন। এবং মুআ’বিয়া (রাঃ) খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে বদলিয়ে দেন। মূল কিতার আল-বেদায়া
ওয়ান নেহায়ায় এই বাক্যটি নেই। (ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:) পৃষ্ঠা-৩৮;
বাইহা্কি ৮/১০২)।
তৃতীয় অভিযোগ: “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” বইটিতেসাইয়েদ আবুল
আলা মওদূদী লিখেন, “গণীমতের মাল বন্টনের ব্যাপারও হযরত মুয়াবিয়া কিতাবুল্লাহ এবং
সুন্নাতে রাসুলের স্পষ্ট বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করেন। কিতাব এবং সুন্নার দৃষ্টিতে
গণীমাতের মালের এক পঞ্চমাংশ বায়তুল মালে জমা করতে হবে এবং অবশিষ্ট চার অংশ যুদ্ধে
অংশ গ্রহণকারী সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। কিন্তু হযরত মুআরিয়া
(রাঃ) গণীমাতের মাল থেকে স্বর্ণ রৌপ্য তাঁর জন্য পৃথক করে রাখার এবং অন্যান্য মাল শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী বন্টন করার নির্দেশ
দান করেন”। (তাবাকাতে
ইবনে সাআদ, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮-২৯।
আত-তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৭।
আল-ইন্তীআব, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৮ ইবনুল
আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৩। আল-বেদায়া
ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯)।[“খেলাফাত ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৫০” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): গণীমতের মাল
বন্টনের ব্যাপারও হযরত মুআবিয়া (বাদিঃ) অভিযোগের যে রেফারেন্সে বেদায়া ওয়ান
নেহায়ার ৮ম খণ্ড কথা বলা হয়েছে সেখানে উল্লেখ আছে, হযরত
মুআরিয়া (রাঃ) গণীমাতের মাল থেকে স্বর্ণ রৌপ্য বায়তুল মালে জমা রাখার জন্য পৃথক
করে রাখতে বলেন।
অথচ
মওলান মোওদূদী লিখেছেন, ময়াবিয়া (রাঃ) নিজের জন্য জমা রাখতে বলেছেন।
মুয়াবিয়া (রাঃ) নির্বাচিত গভর্নর যিয়াদের নির্দেশে তার অধীনস্থ
হযরত হাকাম বিন আমর খোরাসানেরন জাবাল আল আসল অঞ্চলের জিহাদ পরিচালনা করে অনেক
গণীমতের মাল অর্জন করে। যিয়াদ তখন হাকাম বিন আমর কে লিখে পাঠান, আমিরুল মুমিনিনের
নিকট থেকে চিঠি এসেছে যাবতীয় সোনা চাঁদি তার জন্য আলাদা রেখে দেয়া হয়। এগুলো বাইতুল
মালে রেখে দেওয়া হবে। উত্তরে হাকাম বিন আমর লিখে পাঠান, আমিরুল মুমিনিনের চেয়ে
আল্লাহর নির্দেশই বড়। আল্লাহর কসম! আসমান জমিন যদি কারো দুশমন হয়ে যায়, আর সে শুধু
আল্লাহকে ভয় করে তাহলে তার জন্য আল্লাহ কোন না কোন উপায় অবশ্যই করে দেন। অতঃপর নির্দেশ দিলেন জিহাদের মাল তোমরা তাকসীম
করে ফেল। এভাবে আমিরুল মুমিনিনের নামে যিয়াদের পাঠান চিঠি নির্দেশ তিনি আমলে না
নিয়ে গণীমতের মাল নিয়ম মত ভাগ করে দেন। (ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:)
পৃষ্ঠা-৪২৫)। তাকী উসমানীর মতে,
রাষ্টিয় প্রয়োজনে রাষ্ট্রের প্রাপ্য যুদ্ধ লব্ধ মালের এক পঞ্চমাংশের জন্য শুধু
সোনা চাঁন্দি রাখা দোষের কিছু নয়। হয়ত মুয়াবিয়া (রাদিঃ) রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাইই
করতে চেয়েছেন।(ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া
(বাজি:)
চতুর্থ অভিযোগ:
“খেলাফাত ও
মুলুকিয়াত” বইটিতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেন, “হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শসনামলে আর একটি
নিকৃষ্টতম বেদআত চালু হয়। তিনি নিজে এবং তাঁর নির্দেশে তার গভর্ণররা মিম্বারে
দাঁড়িয়ে একবারে নবীজীর রওযার সামনে হুযুর (সাঃ)-এর প্রিয়তম সাথী ও আত্মীয়কে গালি
দেয়া হতো। আর হযরত আলী (রাঃ)-এর সন্তানেরা এবং তাঁর নিকটতম আত্মীয়রা নিজেদের কানে
এসব শুনতেন”। [আত-তাবারী,
৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮৮। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩৪; ৪র্থ
খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫৪। আল-বেদায়া, ৮ম খন্ড,
পৃষ্ঠা-২৫৯; ৯ম খন্ড পৃষ্ঠা-৮০।]
কারো মৃত্যুর
পর তাকে গালি দেয়া শরীয়ত তো দূরের কথা, মানব সুলব চরিত্রেরও পরিপন্থী। বিশেষ করে খোতবাতে এভাবে কলংকিত করা দ্বীন
এবং নৈতিকতার দৃষ্টিতে আরও জঘন্য কাজ। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয তাঁর খান্দানের
অন্যান্য খারাপ ঐতিহ্যের মতো ও ঐতিহ্যও পরিবর্তন করেন এবং জুমার খোতবায় হযরত আলী
(রাঃ) কে গালমন্দ দেয়ার পরিবর্তে এ আয়াত পাঠ শুরু করেনঃ
إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَـٰنِ وَإِيتَآىِٕ ذِى ٱلۡقُرۡبَىٰ وَيَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنڪَرِ وَٱلۡبَغۡىِۚ يَعِظُكُمۡ لَعَلَّڪُمۡ تَذَكَّرُونَ (٩٠)
আল্লাহ ন্যায়-নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি
এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন৷ তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ
করতে পারো৷ (সূরা নাহল ১৬:৯০)। (আত-তাবারী, ৪র্থ খন্ড,
পৃষ্ঠা-১৮৮। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩৪;)। [“খেলাফাত ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৪৯” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): তকী উসমানী লিখেন, “আবুল
আলা মওদূদী আত-তাবারী ও ইবনুল আসীর এ দুটি কিতাবের হাওলা দিয়েছেন অথচ এ দুটি
কিতাবে এর লেসমাত্র নেই। এমন কি আরও অনেক কিতাব চষে বেড়ালাম মওদূদী সাহের কে
লজ্জার হাত থেকে বাচাতে কিন্তু কোন উপাদান পেলাম না। অবশেষে শীয়ার কিতার ঘাটাঘাটি
করেও কিছু পেলাম না”। এরপর তিনি অনেকগুলি রেফারেন্সসহ উল্লেখ করেন, মুয়াবিয়া
(রাদি) সব সময় আলী (রাদি) প্রশংষা করতের কেউ নিন্দা করলে তিনি রাগান্বিত হতেন। তবে
শীয়াদের কিছু জাল, মিথ্যা ও বানোয়াট বর্ণনায় দেখা যায়। মুয়াবিয়া (রাদি) দু জন
গভর্ণর মুগিরা বিন শোবা (রাদি) ও মারওয়ান ইবনে হাকাম খুতবায় ওসমান (বাদি) জন্য
দোয়া এবং তার হত্যাকরির জন্য বরদোয়া করতের। এটাকেই শীয়াগন আলীর (রাদি) কে গালাগালি
হিসাবে বর্ণনা করেছেন। (ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:)
পঞ্চম অভিযোগ: “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” বইটিতে সাইয়েদ আবুল
আলা মওদূদী লিখেন, যিয়াদ ইবনে সুমাইয়্যার ব্যাপারটিও হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর এমন সব
কার্যাবলীর অন্যতম, যাতে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে
শরীয়াতের একটি সর্বসম্মত রতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন।
তায়েফে সুমাইয়্যা নাম্নী একজন দাসীর উদরে যিয়াদের জন্ম। লোকে বলে,
জাহেলী যমানায় হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর পিতা জনাব আবু সুাফিয়ান
সুমাইয়্যার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। তার ফলে সে অন্তঃসত্তা হয়। হযরত আবু সুফিয়ানও
একবার এদিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন যে, তাঁর বীর্যে যিয়াদের
জন্ম। যৌবন-প্রাপ্ত হয়ে তিনি উন্নত মানের ব্যবস্থাপক, প্রশাসক,
সেনাধ্যক্ষ এবং অনন্য সাধারণ যোগ্যতার অধিকারী প্রমাণিত হন। ইনি
হযরত আলী (রাঃ) -এর বিরাট সমর্থক ছিলেন এবং সহায়ক করার জন্য তাঁর পিতার ব্যভিচারের
সাক্ষ্য গ্রহণ করে প্রমাণ করেন যে, সে তাঁর পিতার অবৈধ
সন্তান। আর এরই ভিত্তিতে তিনি তাকে নিজের ভাই এবং আপন পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ
করেন। তাঁর এ কার্য নৈতিক দিক থেকে কত ঘৃণ্য, তা বলার
অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতেও এটা ছিল স্পষ্ট অবৈধ কাজ। কারণ শরীয়াতে
ব্যভিচারের মাধ্যমে কোন নসব (বংশধারা) প্রমাণিত হয় না। আল্লার রাসুলের স্পষ্ট
নির্দেশ রয়েছেঃ শিশু যার বিছানায় ভূমিষ্ঠ হয় তার; আর
ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে প্রস্তরখণ্ড। উন্মুখ মুমিনীন হযরত উম্মে হাবীবা এ জন্য তাকে
ভাই হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবঙ তার সাথে পর্দা করে চলেন। (আল-ইস্তীআব,
১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৬; ইবনুল
আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২০-২২১;
আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮। ইবনে খালদুন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭-৮)। [“খেলাফাত
ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৫০” আধুনিক প্রকাশনি, প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): যিয়াদ ইবনে
সুমাইয়্যার ব্যপারটি তাকী উসমানি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন যা সংক্ষেপে বলে বুঝান
সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, আবু সুফিয়ান জাহেলি যুগে প্রচলিত কোন এক বিবাহ পদ্দতিতে
বিবাহ করে সুমাইয়্যার সাথে মিলিত হয় এবং যিয়াদের জম্ম হয়। তিনি সন্তানের স্বীকৃতিও
প্রদান করেন। ইসলাম গ্রহনের পর জাহিলি যুগের সকল বিবাহ ইসলাম ভূক্ত হয়ে যায়। দশ জন
বিশিষ্ট সাহাবিদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি যিয়াদ কে ভাইয়ের মর্জাদা দান করেন। আলী
(রাদি) ও আয়েশা (রাদি) ও যিয়াদকে আবু সুফিয়ানে সন্তান করে স্বীকার করতেন। (ইতিহাসের
কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:)
ষষ্ঠ অভিযোগ:
“খেলাফাত ও
মুলুকিয়াত” বইটিতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেন, “হযরত মুআবিয়া তাঁর গবর্ণরদেরকে
আইনের ঊর্ধে স্থান দেন এবং তাদের বাড়াবাড়ির জন্য শরলীয়াতের বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা
গ্রহণ করতে স্পষ্টত অস্বীকৃতি জানান। তাঁর গবর্ণর আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে গাইলান
একবার বসরার মিম্বারে দাঁড়িয়ে খোতবা দিচ্ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি তাঁর দিকে কংকর
নিক্ষেপ করে। এতে তিনি তাকে গ্রেফতার করে তার হাত কেটে ফেলেন। অথচ শরীয়াতের বিধান
অনুযায়ী এটা এমন কোন অপরাধ ছিল না, যার জন্য কারো হাত কাটা যায়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর কাছে ফরিয়াদ করা হলে
তিনি বলেন, আমি বায়তুল মাল থেকে হাতের দিয়াত (ক্ষতিপূরণ)
আদায় করবো। কিন্তু গভর্ণর থেকে প্রতিশোধ (কিসাস) গ্রহণের কোন উপায় নেই। [ইবনুল
আসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৪৮। আল-বেদায়া,
৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭১।] [“খেলাফাত ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৫০” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): তকী উসমানি ইবনে কাশির ও ইবনে আসীরের বর্ণনা দিয়ে বলেন, মুয়াবিয়া
(রাদি), গবর্ণর আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে গাইলানের এই কাজেন জন্য বরখাস্থ করেন এবং
কিসাস না দিয়ে দিয়াত প্রদান করেন। কারন তিনি (গাইলান) সন্দেহ করে এই বিচার ফয়সালা
করে ছিলেন। অথচ মাওলানা মওদুদী লিখেন, “মুআবিয়া তাঁর গবর্ণরদেরকে আইনের ঊর্ধে
স্থান দেন”।(ইতিহাসের
কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:)
সপ্তম অভিযোগ: “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” বইটিতে সাইয়েদ আবুল
আলা মওদূদী লিখেন, কিন্তু রাজতন্ত্রের যুগে বিবেকের ওপর তালা লাগান হয়,
মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রশংসার জন্য মুখ খোল অন্যথায় চুপ থাকো –
এটাই তখন রীতিতে পরিণত হয়। যদি তোমার বিবেক এতই শক্তিশালী হয় যে,
সত্য ভাষণ থেকে তুমি নিবৃত্ত থাকতে না পারো তাহলে কারাবরণ, প্রাণদন্ড ও চাবুকের আঘাতের জন্য প্রস্তুত হও। তাই সে সময়ে যারা সত্য ভাষণ
এবং অন্যায় কাজে বাধা দান থেকে নিবৃত্ত হননি, তাদেরকে কঠোরতম
শাস্তি দেয়া হয়েছে। সমগ্র জাতিকে আতঙ্কিত করাই ছিল এর লক্ষ।
হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে আল্লার রাসূলের সাহাবী একজন সাধক ও ইবাদতগুযার এবং
উম্মাতের সৎ ব্যক্তিদের মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হযরত হুজর ইবনে আদীর
হত্যার (৫১ হিজরী) মাধ্যমে এ নতুন পলিসীর সূচনা হয়। হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে খোতবায় প্রকাশ্য মিম্বারে হযরত আলী (রাঃ)-এর লানত
(অভিসম্পাত) এবং গালিগালাযের সিলসিলা শুরু হলে সকল সাধারণ মুসলমানের হৃদয় ব্যথিত
হয়ে ওঠে। কিন্তু অতি কষ্ঠে সবরের পেয়ালা পান করে তারা চুপ করে থাকতেন। কুফায় হুজর
ইবনে আদী তা সহ্য করতে পারেননি। তিনি হযরত আলী (রাঃ)-এর প্রশংসা এবং হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-এর নিন্দা শুরু করেন। হযরত মুগীর (রাঃ) যতদিন কুফার গভর্ণর
ছিলেন, ততদিন তিনি ব্যাপারটি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু পরে বসরার
সাথে কুফাকেও যিয়াদের গভর্ণরীর অন্তর্ভৃক্ত করা হলে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু
হয়। যিয়াদ খোতবায় হযরত আলী (রাঃ)-কে গালি দিতেন, আর হুজর
(রাঃ) দাঁড়িয়ে তার জবাব দিতেন। এ সময় তিনি একবার জামার সালাতে বিলম্বের জন্যও
যিয়াদের সমালোচনা করেন। অবশেষে যিয়াদ ১২ জন সঙ্গী সহ তাঁকে গ্রেফতার করেন এবং তাঁর
বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেনঃ তিনি একটি গুপ্তবাহিনী গঠন করেছেন, খলীফাকে প্রকাশ্যে গালী দেন, আমিরুল মুমিনীনের
বিরেুদ্ধে লড়াই এর আহবান জানাচ্ছেন এবং আলী (রাঃ)-এর বংশধর ব্যতীত অন্য কারো জন্য
খেলাফত জায়েয নয় বলে দাবী করেছেন। তিনি শহরে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছেন এবং আমিরুল
মুমিনীনের গভর্ণরকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আবু তোরাব [হযরত আলী (রাঃ)] কে সমর্থন
করেন, তাঁর জন্য রহমত কামনা করেন এবং তাঁর বিরোধীদের থেকে
দূরে থাকেন। এ অভিযোগের স্বপক্ষে কতিপয় ব্যক্তির সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়। কাযী
শুরাইহকেও অন্যতম স্বাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু তিনি এক পৃথক পত্রে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ)-কে লিখে পাঠানঃ “আমি শুনতে পেলাম,
আপনার নিকট হুজর ইবনে আদীর বিরুদ্ধে যেসব স্বাক্ষ্য পেশ করা হয়েছে,
আমার নামও তাতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। তাঁর সম্পর্কে আমার সত্যিকার
সাক্ষ্য এই যে, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত
আদায় করে, নিয়মিত হজ্জ ও ওমরাহ করে, ভাল
কাজের নির্দেশ দান করে, অন্যায় কার্য থেকে বারণ করে, তিনি তাদের অন্তর্ভূক্ত। তাঁর রক্ত ও সম্পদ সম্মানার্হ-হারাম। আপনি ইচ্ছা
করলে তাঁকে হত্যা করতে পারেন অথবা ক্ষমা করে দিতে পারেন।”
এমনিভাবে এ
অভিযুক্তকে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) -এর নিকট
প্রেরণ করা হয়। তিনি তাকেঁ হত্য করার নির্দেশ দেন। হত্যার পূর্বে জল্লাদরা তাঁর
সামনে যে কথাটি পেশ করে তা হচ্ছে, তুমি আলীর সাথে সম্পর্ক
ছিন্ন করে তাঁর ওপর অভিসম্পাত বর্ষণ করলে তোমাকে মুক্তি দান, অন্যথায় হত্যা করার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি তা করতে
অসম্মতি জানিয়ে বলেন- “আমি মুখে এমন কথা উচ্চরণ করতে পারি না,
যা আমার রবকে অসন্তুষ্ট করে।” অবশেষে ৭ জন
সঙ্গী সহ তাকেঁ হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবনে হাসসানকে হযরত মুআ’বিয়া (রাঃ) যিয়াদের নিকট ফেরত পাঠান। তিনি যিয়াদকে লিখেন, একে নৃশংসভাবে হত্যা করো। যিয়াদ তাঁকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেন। [এ ঘটনার
বিস্তারিত বিবরণের জন্য তাবারী, ৪র্থ খন্ড, ১৯০-২০৭ পৃষ্ঠা, আল-ইস্তীআব, ১ম
খন্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড,
২৩৪-২৪২ পৃষ্ঠা। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম
খন্ড, ৫০-৫৫ পৃষ্ঠা এবং ইবনে খালদুন, ৩য়
খন্য, ১৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। [“খেলাফাত ও রাজতন্ত্র” পৃষ্ঠা নম্বর – ১৪১” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১।]
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): তকী উসমানি
উক্ত সমালোচনার জবাবে রেফারেন্সসহ হযরত হুজর ইবনে আদীর জীবনি বর্ণনা করেছেন। ইতিহাসের
কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (রাদি) এর ৮৫ পৃষ্ঠা পড়লে হুজর ইবনে আদীর মৃত্যু দন্ডের কারন
জানা যাবে। উক্ত কিতাবে তিনি লিখেন, “অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাকে সাহাবি বলে স্বীকার
করে না”। (বিদায়া
ওয়ান নিহায়া ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা -৩০। তিনি হাসান (রাদি) ও মুয়াবিয়া (রাদি) মধ্যকার
শান্তিচুক্তি মেনে নিতে পারেনি। তিনি এ ব্যাপারে হাসান (রাদি) কে ভত্সনা করেন। এবং
যুদ্ধের জন্য আহবান জানান। (ইবনে খালদুন)। তিনি সাবঈ চক্র দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন।
যার কারনে তিনি গবর্ণর মুগিরা বিন শুবা ও
যিয়াদ কে প্রকাশ্যে গাল মন্দ করত। যিয়াদ তাকে গোপনে ডেকে সংশোধনের চেষ্টা করেন।
(তাবাকত ৮/২১৮)। কিন্তু শীয়াদের খপ্পরে পড়ে সংশোধন হতে পারলেন না। তিনি রাষ্ট্রের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। (ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (বাজি:)
অস্টম অভিযোগ: “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” বইটিতে সাইয়েদ আবুল
আলা মওদূদী লিখেন, “মনোণয়ন দানের প্রাথমিক চিন্তাভাবনার পিছনে কোন সৎ অনিভূতি বা
উদ্দেশ্য ছিল না, বরং এক বুজুর্গ তার
ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের মতলবে আরেক বুজুর্গের ব্যক্তি স্বার্থ উসকে দিয়ে এ
প্রস্তাবের জম্ম দিয়েছেন। অথচ ভদ্রলোকেরা একবার ও ভেবে দেখলেন না যে, এভাবে গোটা
উম্মাহকে কোন রসাতলে তারা ঠেলে দিচ্ছেন। (উল্লেখ্য যে, প্রথম বুজুর্গ হলো মুগিরা
বিন শোভা আর দ্বিতীয় বুজুর্গ হল মুয়াবিয়া (রাদি)। আরোও অভিযোগ
করেন ইয়াযিতের মনোনয়নের ব্যপারে মুয়াবিয় (রাদি) এবং তার গবর্নর বিভিন্ন জন কে ঘুষ
প্রদান করেন।
তাকী উসমানীর
মন্তব্য (সংক্ষেপিত করা): তকি
উসমানি বলেন, ইয়াযিদের পরবর্তি পরিনতির আলোকে আহলে সুন্নাহ ওয়ল জামাত মনে করে,
মুয়াবিয়ার (রাদি) এর খলিফা নির্বাচন নির্ভুল ও কল্যানকর প্রমানিত হয়নি। তাই বলে, মুগিরা বিন শোভা ও
মুয়াবিয়া (রাদ) নিয়তের উপর হামলা করা ঠিক হয়নি।
(বিস্তারিত জানতেঃ ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুয়াবিয়া (রাদি)” বইয়ের ১০৫ পৃষ্ঠা দেখুন)।
বাংলাদেশের যে বিখ্যাত
আলেমে দ্বীন প্রথম এ ব্যাপারে বাংলায় কলম ধরেন তিনি হলেন মুজাহিদে আজম আল্লামা
শামছূল হক ফরিদপুরী (রহ:)। তিনি এ সম্পর্কে যে বই লিখেন তার নাম হল: “ভুল সংশোধন”। তার এ বই সম্পর্কে
জামায়েতের বাংলার প্রথম আমির বর্ষিয়ান নেতা একটি উক্তি তুলে ধরলেই বুঝবেন, তাহার
লিখিত “ভুল সংশোধন” বইটি পড়ার যোগ্য কি
না? অধ্যাপক গোলাম আজম (রহ:) এর লিখিত
ইকামাতে দ্বীন নামক বইয়ে বলেন, মাওলানা
মওদূদী লিখেছেন বলেই কোন কথা সঠিক বলে আমি গ্রহন করি না। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল সহকারে যেসব কথা তিনি
পেশ করেছেন তা আমার বিবেক বুদ্ধি দ্বারা যাচাই করেই গ্রহন করি। তাই যারা দলীল ও যুক্তির
ভিত্তিতে তাঁর সমালোচনা করেন তাদের কথা গ্রহন করতে আমি দ্বিধা করি না। কারন মাওলানা মওদূদী
(রঃ) কে আমি নির্ভুল মনে করি না। কিন্তু যারা ফতোয়ার
ভাষায় কথা বলেন, তারা মাওলানার ভুল সংশোধনের চেয়ে মানুষেকে বিভ্রান্ত
করাই তাদের উদ্দেশ্য বলে তাদের কথা আমি বিবেচনা যোগ্যই মনে করি না।
মাওলানা
মওদূদী (রঃ)-এর “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” নামক বই সম্পর্কে বাংলাদেশের
কয়েকজন আলেম জোরদার আপত্তি তুলেছেন। এর মধ্যে হযরত মাওলানা
শমসুল হক ফরিদপুরী (রঃ) এর লেখা “ভুল সংশোধন” নামক পুস্তিকাটিকে অবশ্যই আমি পড়ার যোগ্য বলে
আমি মনে করি। মাওলানা ফরিদপুরী (রঃ) মাওলানা
মওদূদী (রঃ) কে অত্যন্ত মহব্বত করতেন এবং আমাকেও খুব স্নেহ করতেন। তাঁর সাথে ঘনিষ্টভাবে
মিশবার দরুন আমি জানতাম যে “খেলাফত ও মুলুকিয়াত” সম্পর্কে
তার যথেস্ট আপত্তি আছে। তিনি মাওলানা মওদূদী (রঃ) এর
নিয়তের উপর হামলা করতেন না। এবং তাকে সাহাবায়ে কেরামের
বিরোধী বলেও মনে করতেন না। “খেলাফত ও
মুলুকিয়াত” লিখতে গিয়ে মাওলানা মওদূদী (রঃ) যেসব ঐতিহাসিকের
হাওয়ালা দিয়েছেন তাদের কয়েক জনকে মাওলানা ফরিদপুরী শিয়া বলে মনে করতেন এবং শিয়া
ঐতিহাসিকের মতামত গ্রহন করার ফলেই লেখক ভুল সিদ্ধান্তে পৌছেছেন বলে তিনি বিশ্বাস
করতেন।
মাওলানা ফরিদপুরী (রঃ) “খেলাফাত ও মুলুকিয়াত” বইটির সমালোচলায় যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাতে বুঝা যায় যে,তার অন্তরে বিদ্বেষ নেই এবং পূর্ন ইখলাসের ভিত্তিতে তিনি লিখেছেন। একথা “ভুল সংশোধন “ নামকরন থেকে স্পষ্ট। তিনি জনগনকে বিভ্রন্ত
করার উদ্দেশ্যে লেখেননি। মাওলানা মওদূদীর লেখায় যেখানে
তিনি ভুল মনে করেছেন সেখানেই সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। অবশ্য বইটির কোথাও কোথাও
এমন কিছু কথা আছে যা মাওলানা ফরিদপুরী (রঃ) এর স্বভাবসুলব শালীন ভাষার সাথে মিল
খায় না।
সে সব কথা অন্যের সংযোজন কিনা তা আল্লাহ পাকই জানেন। বইটির প্রকাশক শুরুতেই
কয়েকজন আলেমের অত্যন্ত অশালীন বক্তব্য যোগ করে দিয়েছেন। তাতে সন্দেহ হয় যে, বইটির সকল
বক্তব্য মাওলানা ফরিদপুরীর নয়।
যারা সুবিচারক ও সত্য তালাশ করতে ইচ্ছুক তাদেরকে অনুরোধ করছি তারা যেন, “খেলফত ও
মুলুকিয়াত” বইখানার সাথে মাওলানা ফরিদপুরী (রঃ) এর লেখা “ভুল সংশোধন” মিলিয়ে পড়ে দেখেন। যে সব আন্দোলন “ভুল সংশোধনে”
তোলা হয়েছে এর জবাবও মূল বই-এর শেষ ভাগে দেয়া হয়েছে। বইটি পড়ে যেখানে যেখানে
করেছে বলে পাঠকের ধারনা হয় সেসব কথা না গ্রহন করলেই হলো। কোন লেখকের সব কথাই সঠিক
হওয়া জরুরী নয়।
মাওলনা
মওদূদী (রহঃ) সাহাবি রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুমাদের সম্পর্কে যে যে ভুল সমালোচনা
করছেন বলে আল্লামা শামছূল হক
ফরিদপুরী (রহ:) মনে
করেছেন, তার সংশোধনগুলি ‘ভুল সংশোধন’ কিতাবে তুলে ধরেছেন। তার প্রধান প্রধান
সংশোধনগুলি উল্লেখ করছি।
(১) “ইতিহাসের কাঠ গড়ায় মুয়াবিয়া (রাদি)” নামক কিতাবে
মুফতি তাকী উসমানি সাহাবায়ে কেরামদের সমালোচনার যে সকল সংশোধনি দিয়েছেন। তার প্রায়
সবগুলিই ‘ভুল সংশোধন’ কিতাবে উল্লেখ করে, তিনিও মাওলানা মওদুদীর ভুল সংশোধন করার
চেষ্টা করেছেন।
(২) মুগিরা ইবনে শোভা (বাদি) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর নিয়তের উপর হামল করেছেন। (ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নম্বর
– ১৯)।
(৩) হযরত আলী (রাদি)-ই, হযরত ওসমান (রাদি) কে হত্যা
করেছেন। এই মর্মে সাক্ষি জোগারের জন্য মুয়াবিযা (রাদি) লোক নিয়োক করেন যা মুলত ভুল ধারনা মাত্র। (ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নম্বর
– ৬৪)।
(৪) রাসুল
(সা) দুই জন বিসিষ্ট সাহাবি তালহা (রাদি) ও জুবায়ের (রাদি) এদের কাজকে জাহেলি
যুগের কাজের সাথে তুলনা করেছেন। (ভুল সংশোধন পৃষ্ঠা নম্বর
– ৯৩)।
(৫) হযরত
ওসমান (রাদি) প্রতি স্বজন প্রীতির মত তোহমাদ বা অপবাদ দিয়েছেন।
মন্তব্যঃ ওসমান (রাদিঃ) হত্যা
কান্ড থেকে শুরু করে সাহেবায়ে কেরামদের (রা:) মধ্যে যে ইখতিলাফ শুরু হয় তা আজও
চলছে। জঙ্গে জামালের যুদ্ধ এবং সিফফীসের যুদ্ধ তারই বহিঃপ্রকাশ। আর এই সময় কার
ইতিহাস লেখা আরও কঠিন। তার পরও যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগন হাল ছাড়েনি। নিরপেক্ষ থেকে
কলম চালিয়েছেন। শিয়াদের মুহুর মুহুর আক্রমনেও তারা পরাজয় বরন করে নি। তার পরও সকলে
এ ব্যাপারে একমত যে, মুহাদ্দিসগন হাদিস যেভাবে সংরক্ষন করেছেন, ইতিহাস ঠিক
তেমনিভাবে সংরক্ষন করতে পারেনি। তাই পরবর্তি কালে যারাই ইতিহাস রচনা করছেন, তারা
নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেও থাকতে পারে নাই। মাওলানা মওদূদী তাদেরই একজন।
মুফতি তাকী উসমানি ও আল্লামা শামছূল হক ফরিদপুরী (রহ:) এর মতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর ভুলের প্রধান কারন হলঃ “তিনি যাদের
বর্ণায় “খেলাফাত ও
মুলুকিয়াত” সাজিয়েছেন
তাদের অধিকাংশ শীয়া বর্ণনাকারি। তিনি কোন কোন স্থানে নিজের মতামত তুলে ধরে সীমা লঙ্ঘন করেছেন”।
তবে
এ ব্যাপারে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর
বক্তব্য হলঃ “আমি বক্ষমান গ্রন্থে (খেলাফাত
ও মুলুকিয়াত) এ বিষয়ের প্রতি কঠোর
সমতর্কতা অবলম্বন করেছি যাতে রেফারেন্স ব্যতীত কোন বিষয় উল্লেখ করা না হয়। (খেলাফাত ও মুলুকিয়াত পৃষ্ঠা নম্বর - ২৮৬” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১)।
হযরত ওসমান (রাঃ) সম্পর্কে বলেনঃ সাইয়্যেদেনা হযরত ওসমান (রাঃ)
নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে যে কর্মধারা অবলম্বন করেছেন, তা কোন অসদুদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করেছেন, আমার
মনে (নাউযুবিল্লাহি) এমন কোন ধারণার উদ্রেকও হয়নি। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহর
একনিষ্ঠ এবং প্রিয়তম সাহাবীদের অন্যতম। ঈমান আনয়নের পর থেকে শাহাদাত লাভ কপর্যন্ত
তাঁর গোটা জীবন এ কথারই প্রমাণ বহন করে। হয়। (খেলাফাত ও মুলুকিয়াত পৃষ্ঠা নম্বর - ২৬২” আধুনিক প্রকাশনি,
প্রকাশ কাল ২০০১)।
একজন লোকের ভাল মন্দ দুটি
দিক থাকে। কিন্তু খেলাফাত ও মুলুকিয়াত কিতাবের পঞ্চম অধ্যায় এর “খেলাফত ও
রাজতন্ত্রের পার্থক্য” অধ্যায় পড়লে মনে হবে সাহাবি মুয়াবিয়া (রাদি) এর খেলাফতের
কোন ভাল দিক নেই। আবুল আলা মওদূদীর (রহঃ) রেফারেন্স দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু মুয়াবিয়া
(রাদিঃ) এর খেলাফতের কোন ভাল কি সত্যিই নেই? থাকলে তার জন্য একটা বাক্য ও কেন ব্যয়
করা হল না? যারা প্রকৃত ইতিহাস জানেন না, তারা এই অধ্যায় পড়লে মুয়াবিয়া (রাদিঃ)
উপর শতভাগ ভুল ধারনা করবে। তাইতো অধ্যাপক গোলাম আজম (রহ:) এর লিখিত “ইকামাতে দ্বীন”
নামক বইয়ে বলেন, মুয়াবিয়া সম্পর্কে মওদূদী
খেলাফাত ও মুলুকিয়াত কিতাবে যা লিখেছন তা আমি বিশ্বাস করিনা আবার বিশ্বাসের
যোগ্য ও মনে করি না।
সাহেবায়ে কেরামদের (রা:)
সমালোচনার ব্যাপারে “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের একটি আকিদা উল্লেখ করে শেষ করছি। সাহেবায়ে কেরামদের (রা:) সমালোচনার ব্যাপারে আল্লামা শামছূল হক ফরিদপুরী (রহ:) ‘ভুল সংশোধন’ কিতাবে যে আকিদার কথা
উল্লেখ করেছেন তা নিম্মরূপ:
সাহেবায়ে কেরামদের (রা:) মর্জাদা সম্পর্কে কুরআন হাদিসে বহু স্থানে
বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ:) তার প্রসিদ্ধ কিতার ফিকহুল আকবরে লিখেন,
“আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তরভুক্ত থাকিতে চাইলে, তাহার অন্তরে অকাট্য বিশ্বাস
সহকারে স্বীকার করিতে হইবে যে, আমরা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং এক জন সাহাবির গুনচর্চা ব্যতিত দোষ চর্চা করিব না।
অর্থাৎ যে কেহ একজন সাহাবির দোষ চর্চা করিবে, সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের
অন্তরভুক্ত থাকিতে না। সে হয় রাফেজিদের দলভূক্ত হইয়া যাইবে, না হয় খারেজি দলভুক্ত
হইয়া যাইবে, না হয় অন্য কোন গোমরা পথভ্রষ্ট দলভুক্ত হইয়া যাইবে। (ভুল সংশোধন ;
পৃষ্ঠা -৪২)।
অভিযোগকারীদের আপত্তি হলো মাওলানা মওদুদী তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকাতেই লিখেছেন, “ বরং কুরআন পড়ে আমার যা মনে এসেছে, তাই লিখে দিয়েছি”।
কিন্তু জামায়েতে ইসলামি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কুরআনের অনুবাদ পড়তে আরেকটা অসুবিধা হল শাব্দিক অনুবাদ। বিভিন্ন শব্দের শাব্দিক অনুবাদ করে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হলে যে মূল ভাষার সৌন্দর্য্য ও মর্ম সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যায়না এটা সকলেই জানেন। মূলত অনুবাদ করার ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম যে, অনুবাদক মূল ভাষা পড়ে যে কথাটা বুঝতে পারলেন অন্য ভাষায় ভাষান্তরের সময় ঠিক সেই কথাটিই সেই ভাষার শব্দ দিয়ে গেঁথে দিতে হবে। এ জন্য যদি প্রতিশব্দকে অবহেলাও করতে হয় তবুও বাক্যের মূল ধারা বজায় রাখবার জন্য উপযুক্ত শব্দই ব্যাবহার করাই বাঞ্চনীয়।
মাওলানা মওদুদী এটাই করেছেন। শাব্দিক অনুবাদ না করে আরবী কুরআন পড়ে যেটা বুঝতে পারলেন সেটাই অন্য ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। আর এ কথাই বলেছেন। কথাটা হলোঃ
”শাব্দিক অনুবাদের এই ত্রুটি ও অভাবগুলো দূর করার জন্য আমি মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ও ভাবার্থ প্রকাশের পথ বেছে নিয়েছি। কুরআনের শব্দাবলীকে ভাষান্তরিত করার পরিবর্তে কুরআনের একটি বাক্য পড়ার পর তার যে অর্থ আমার মনে বাসা বেঁধেছে এবং মনের উপর তার যে প্রভাব পড়েছে, তাকে যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি।”
উল্লেখ্য, তিনি কুরআনকে নিজের মত করে সাজিয়ে লেখেননি। কুরআনের অনুবাদকে মানুষের বোঝার মত করে লিখতে সচেষ্ট হয়েছেন।
যারা শুধু এটা উদ্ধৃত করেন, ”বরং কুরআন পড়ে আমার যা মনে এসেছে, তাই লিখে দিয়েছি” তারা আংশিক উদ্ধৃত করেন কি উদ্দেশ্যে? তারা কি এখানে তাঁকে ফাঁসাতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন না?
এরপর মাওলানা মওদুদী আরো লেখেন- “আমার পক্ষ থেকে যতদূর সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব তা করেছি। কুরআন তার বক্তব্যকে নিজের ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যতটুকু স্বাধীনতা দেয় তার সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করিনি”। সত্যপন্থী ও নিরপেক্ষ পাঠকদের উচিৎ ভূমিকাটুকু খোলামন নিয়ে বিস্তারিত পড়া এবং তার উপর ভিত্ত করে সিদ্ধান্ত নেয়া।
০৩। ঈসা
আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে।
ইসলামি আকিদা ও
ভ্রান্ত মতবাদ কিতাবে মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন লেখেন, মাওলানা মওদূদী সুরা নিসার ১৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যায় ঈসা আলাইহিস
সালামের দুনিয়াতে পুনরায় আগমন অস্বীকার করেন। তিনি তার কিতাবের ৩৯৩ পৃষ্ঠায় উদৃতি এভাবে তুলে ধরেন।
“এখানে কুরআনুল করিমের মূল ভাবধারা অনুযায়ী যে কথাটি সামজ্ঞস্যপূর্ণ তা একমাত্র এটাই যে, ঈসা আলাইহিস সালাম কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এ কথা বলা থেকে রিরত থাকা। এবং তিনি মৃত্যু বরন করেছেন এ কথা বলা থেকেও রিরত থাকা।
এর পর তিনি লিখেনঃ মোওদুদী সাহের উপরোক্ত বক্ত্বব্য দ্বারা
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে স্বশরীরে আকাশে তুলে নেওয়া ও তার মুত্য বরণ না করা ও শেষ
যুগে তার অবতরণ সম্পর্কে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত আকিদাকে দ্বীধাগ্রস্থ
করে তুলছেন। অথচ বিষয়টি কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত।
এবার আসা যাক সুরা নিসার ১৮৭ আয়াতের
ব্যাখ্যায় ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী তাফহিমুল কুরআনে কি লিখেছেন। কুরআনের আয়াতসহ
তাফসির হুবহু তুলে ধরছি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَقَوۡلِهِمۡ
إِنَّا قَتَلۡنَا ٱلۡمَسِيحَ عِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ رَسُولَ ٱللَّهِ وَمَا
قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَـٰكِن شُبِّهَ لَهُمۡۚ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ
ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ لَفِى شَكٍّ۬ مِّنۡهُۚ مَا لَهُم بِهِۦ مِنۡ عِلۡمٍ إِلَّا
ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينَۢا (١٥٧) بَل
رَّفَعَهُ ٱللَّهُ إِلَيۡهِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمً۬ا (١٥٨)
অর্থঃ এবং তাদের “আমরা আল্লাহর রসূল মারয়াম পুত্র ঈসা
মসীহ্কে হত্যা করেছি”, এই উক্তির জন্য (তারা অভিশপ্ত হয়েছিল)। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা তাকে হত্যাও করেনি এবং শূলেও চড়ায়নি
বরং ব্যাপারটিকে তাদের জন্য সন্দিগ্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ আর যারা এ ব্যাপারে
মতবিরোধ করেছে তারাও আসলে সন্দেহের মধ্যে অবস্থান করছে৷ তাদের কাছে এ সম্পর্কিত
কোন জ্ঞান নেই, আছে নিছক আন্দাজ-অনুমানের অন্ধ অনুসৃতি৷ নিসন্দেহে তারা
ঈসা মসীহকে হত্যা করেনি৷ রং আল্লাহ তাকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ জবরদস্ত শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাময়৷
(সুরা নিসা ৪:১৫৭-১৫৮)।
১। “এবং তাদের “আমরা আল্লাহর রসূল মারয়াম পুত্র ঈসা মসীহ্কে হত্যা করেছি”।
এই আয়াত টুকুর ব্যাখ্যায় তিনি তাফহিমূল
কুরআনে লিখেন, তাদের অপরাধ করার দুঃসাহস এতই বেড়ে গিয়েছিল যার ফলে
তারা আল্লাহর রসূলকে রসূল জেনেও হত্যা করার পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং গর্ব করে বলেছিলঃ আমরা আল্লাহর রসূলকে হত্যা করেছি। ওপরে আমার দোলনার
ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছি তা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে,
ইহুদীদের জন্য
ঈসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতে সন্দেহ
করার কোন অবকাশই ছিল না। এ ছাড়াও তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে থেকে যে
উজ্জ্বল নিশানীগুলো প্রত্যক্ষ করেছিল (সূরা আলে
ইমরানের ৫ম রুকূ'তে ইতিপূর্বে এটি আলোচিত হয়েছে)
তা থেকে তিনি যে আল্লাহর রসূল এ বিষয়টি
সকল প্রকার সন্দেহের উর্ধে চলে গিয়েছিল। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে
তারা তাঁর সাথে যা কিছু করেছিল তা কোন
ভুল বুঝাবুঝির ভিত্তিতে করেনি বরং তারা ভালোভাবেই জানতো যে,
এই অপরাধ তারা এমন এক ব্যক্তির সাথে করছে
যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পয়গাম্বর হয়ে এসেছেন।
কোন জাতি এক ব্যক্তিকে নবী বলে জানার ও
মেনে নেয়ার পরও তাকে হত্যা করেছে, আপাতঃ দৃষ্টিতে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার বলে
মনে হয়। কিন্তু দুনিয়ার বিকৃত জাতিদের রীতিনীতি, কাজ-কারবার এমনি বিস্ময়করই হয়ে থাকে। যে
ব্যক্তি তাদের অন্যায় ও পাপ কাজের সমালোচনা করে এবং তাদের অবৈধ কাজে
বাধা দেয়, এমন
কোন ব্যক্তিকে তারা নিজেদের মধ্যে বরদাশ্ত করতে পারে না। নবী হলেও
এই ধরনের লোকেরা হামেশা অসৎ, দুশ্চরিত্র ও পাপাচারী জাতিদের হাতে কারাযন্ত্রণা ও
মৃত্যুদণ্ড ভোগ করে এসেছেন। তালমুদে লিখিত হয়েছেঃ বখতে নসর বায়তুল মাক্দিস জয় করে
সুলাইমানী হাইকেলে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলেন। যে স্থানে
কুরবানী করা হয় সে স্থানের ঠিক সামনে দেয়ালে এক
জায়গায় তিনি একটি তীরের নিশানী দেখলেন। তিনি
ইহুদীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের নিশানী ৷ ইহুদীরা জবাব দিল,
'' এখানে আমরা
যাকারিয়া নবীকে হত্যা করেছিলাম। তিনি আমাদের অসৎকাজের জন্য তিরস্কার করতেন।
অবশেষে তার তিরস্কারে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা তাকে হত্যা করেছি। ''
বাইবেলে ইয়ারমিয়াহ নবী সম্পর্কে বলা
হয়েছেঃ বনী ইসরাইলদের অসৎকর্মসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর হযরত ইয়ারমিয়াহ তাদের এই
মর্মে সতর্ক করে দিলেন যে, এসব বদ কাজের প্রতিফল হিসেবে আল্লাহ অন্য জাতিদের হাতে
তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন। এর জবাবে তার বিরুদ্ধে দোষারোপ করলোঃ ''এই ব্যক্তি 'কালদানী' জাতির সাথে হাত
মিলিয়েছে, তাদের সাথে যোগসাজশ করেছে। এই ব্যক্তি
জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।'' এই অভিযোগে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এমনকি হযরত ঈসা
আলাইহিস সালামের শূলে চড়াবার ঘটনার মাত্র দুই আড়াই বছর পূর্বে হযরত ইয়াহ্ইয়ার (আ) ব্যাপারটি ঘটে
গিয়েছিল। ইহুদীরা সাধারণভাবে তাকে নবী
বলে জানতো। অন্তত তাকে জাতির সবচাইতে সৎলোক হিসেবে মানতো। কিন্তু যখন তিনি
হিরোডিয়াসের (ইহুদী রাষ্ট্র প্রধান) দরবারের অন্যায়
ও অসৎকাজের সমালোচনা করলেন তখন আর তাকে
বরদাশত করা হলো না। প্রথমে তাকে কারারুদ্ধ করা হলো তারপর রাষ্ট্র প্রধানের
প্রেমিকার দাবী অনুযায়ী তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হলো।
ইহুদী জাতির এই অতীত রেকর্ডগুলো
পর্যবেক্ষণ করার পর একথা মোটেই বিস্ময়কর মনে হয় না
যে, তাদের ধারণা মতে তারা হযরত ঈসা মসীহকে (আ) শূলে চড়াবার পর বুকে ঠুকে একথা বলেছেঃ
''আমরা
আল্লাহর রসূলকে হত্যা করেছি।''
প্রকৃতপক্ষে তারা তাকে হত্যাও করেনি এবং শূলেও
চড়ায়নি বরং ব্যাপারটিকে তাদের
জন্য সন্দিগ্ধ করে দেয়া হয়েছে৷
এই আয়াত টুকুর ব্যাখ্যায় তিনি লিখেন,
এ আয়াতটি
দ্ব্যর্থহীনভাবে একথা প্রমাণ করে যে,
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলে চাড়াবার
আগেই উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। আর ঈসা মসীহ (আ) শূলবিদ্ধ হয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন বলে খৃস্টান
ও ইহুদীরা যে ধারণা পোষণ করে তা নিছক একটি ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআনে
ও বাইবেলের তুলনামূলক অধ্যয়ন করে আমরা জানতে পারি, সম্ভবত পীলাতুসের আদালতে হযরত
ঈসা আলাইহিস সালামকেই পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন সে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনিয়ে
দিল এবং ইহুদীরা ঈসা মসীহের মতো পূণ্যাত্মার প্রাণের চাইতে একজন দস্যূর প্রাণকে
অধিক মূল্যবান গণ্য করে নিজেদের সত্য বিরোধিতা ও বাতিল প্রীতির চূড়ান্ত প্রমাণটিও
পেশ করে দিলো, তখন কোন এক সময় আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। পরে ইহুদীরা যে
ব্যক্তিকে শূলে চড়ালো সে ঈসা ইবনে মারয়াম ছিল না। সে ছিল অন্য কোন ব্যক্তি। কোন অজ্ঞাত
কারণে তারা তাকে ঈসা ইবনে মারয়াম মনে করে নিয়েছিলেন। তবুও এতে তাদের অপরাধের পরিমাণ
হ্রাস হবে না। কারণ যাকে তারা কাঁটার টুপি পিয়েছিলেন,
যার মুখে থু থু
নিক্ষেপ করেছিল এবং যাকে লাঞ্ছনা সহকারে
শূলে চড়িয়েছিল তাকে তো তারা ঈসা ইবনে মারয়ামই মনে করছিল। ব্যাপারটি কিভাবে
তাদের কাছে সংশয়িত হয়ে গিয়েছিল তা জানার কোন
উপায় আমাদের আয়ত্বে নেই। যেহেতু এই
পর্যায়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহের কোন উৎস আমাদের জানা
নেই তাই ঈসা ইবনে মারয়াম ইহুদীদের
কবলমুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও তারা ঈসা ইবনে মারয়ামকেই
শূলবিদ্ধ করেছে বলে যে সংশয় পোষণ করছিল
নিছক ধারণা, আন্দাজ-অনুমান ও জনশ্রুতির ভিত্তিতে তার স্বরুপ নির্ধারণ করা
কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়।
আর যারা এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছে তারাও আসলে সন্দেহের মধ্যে অবস্থান
করছে৷ তাদের কাছে এ সম্পর্কিত কোন জ্ঞান নেই , আছে নিছক আন্দাজ-অনুমানের অন্ধ অনুসৃতি৷
এই আয়াত টুকুর ব্যাখ্যায় তিনি লিখেন, মতবিরোধকারী
বলে এখানে খৃস্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলে
চড়াবার ব্যাপারে তাদের কোন একটি সর্বসম্মত মত বা বক্তব্য নেই। এ ব্যাপারে তাদের
মধ্যে বহু মতের প্রচলন রয়েছে। তাদের এই অসংখ্য মতই প্রমাণ করে যে,
আসল ব্যাপারটি তাদের কাছেও সংশয়পূর্ণই রয়ে
গেছে। তাদের একদল বলেঃ যে ব্যক্তিকে শূলে চড়ানো হয়েছিল সে ঈসা মসীহ ছিল না। ঈসার
চেহারায় সে ছিল অন্য এক ব্যক্তি। ইহুদী ও রোমীয় সৈন্যরা তাকে লাঞ্ছনার সাথে শূলে
চড়াচ্ছিল। আর ঈসা মসীহ সেখানে কোনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে তাদের নির্বুদ্ধিতায় হাসছিলেন।
অন্য এক দল বলেঃ শূলদণ্ডে ঈসা মসীহকেই চড়ানো হয়েছিলো। কিন্তু শূলদণ্ডে তার
মৃত্যু হয়নি বরং নামিয়ে নেয়ার পর তার মধ্যে প্রাণ ছিল। আর একদল বলেঃ তিনি শূলে মৃত্যুবরণ
করেছিলেন আবার প্রাণ লাভ করেছিলেন। এরপর কমপক্ষে দশবার নিজের বিভিন্ন
'হাওয়ারী' দের সাথে সাক্ষাত করে তাদের সাথে আলাপ
করেছিলেন। চতুর্থ আর একদল বলেঃ শূলের ওপর ঈসার মানবিক দেহের মৃত্যু
ঘটেছিলো এবং তাকে দাফনও করা হয়েছিল। কিন্তু তার
মধ্যে খোদায়ীর যে আত্মা ছিল তাকে উঠিয়ে
নেয়া হয়েছিল। পঞ্চম দলটি বলেঃ মরার পর ঈসা মসীহ আলাইহিস সালাম এই জড়দেহসহ জীবিত হয়ে
গিয়েছিলেন এবং সশরীরেই তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়,
আসল সত্য ঘটনাটি তাদের জানা থাকলে সে
সম্পর্কে এতগুলো পরস্পর বিরোধী কথা ও মত তাদের মধ্যে প্রচলিত থাকতো না।
এই আয়াত টুকুর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এ প্রসংগে এটিই
হচ্ছে প্রকৃত সত্য। আল্লাহ সুস্পষ্ট
ভাষায় এটি ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে দৃঢ়তা সহকারে যে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা
হয়েছে তা কেবল এতটুকু যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করতে ইহুদীরা কামিয়াব হয়নি
এবং আল্লাহ তাকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন ওঠে কিভাবে উঠিয়ে
নেয়া হয়েছিল। কুরআনে এর কোন বিস্তারিত বিবরণ
দেয়া হয়নি। কুরআন যেমন একথা বলে না যে,
আল্লাহ তাকে এই জড়দেহ ও আত্মসহকারে
পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে আকাশ রাজ্যের কোথাও রেখে দিয়েছেন আবার তেমনি
একথাও বলে না যে, পৃথিবীতে তার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল কেবল তাঁর রূহটি ওপরে
উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাই কুরআনের ভিত্তিতে এর কোন একটি দিককে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ ও
অন্য দিকটিকে চূড়ান্তভাবে বর্জন করা যেতে পারে না। কিন্তু কুরআনের
বর্ণনাভংগী সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে একথা সুস্পষ্ট অনুভূত হয় যে,
উঠিয়ে নেবার ধরণ ও অবস্থা যাই হোক না কেন
ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে আল্লাহ অবশ্যি এমন কিছু ব্যাপার করে থাকবেন যা
নিসন্দেহে অস্বাভাবিক পর্যায়ের। তিনটি বিষয় থেকে এই অস্বাভাবিকতার পরিচয় পাওয়া
যায়।
এক: ঈসা আলাইহিস সালামকে এই জড় দেহ ও প্রাণ
সহকারে উঠিয়ে নেবার ধারণা খৃষ্টানদের মধ্যে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। আর
খৃস্টানদের একটি বড় দল যে হযরত ঈসাকে 'খোদা' বলে
ধারণা করতো এটিই ছিল তার একটি অন্যতম
কারণ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কুরআন দ্ব্যর্থহীন
ভাষায় শুধু যে এর প্রতিবাদই জানায়নি তাই
নয় বরং খৃষ্টানরা এ ঘটনাটির জন্য যে 'উঠিয়ে
নেয়া' (Ascension) শব্দটি ব্যবহার করে থাকে কুরআনেও হুবহু
সেই একই শব্দ ব্যবহার করেছে। কোন একটি আরো শক্তিশালী করে-এটা কুরআনের মতো দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উপস্থাপনকারী
কিতাবের রীতি ও মর্যাদার সাথে মোটেই খাপ খায় না।
দুই: যদি ঈসা আলাইহিস সালামকে উঠিয়ে নেয়া তেমন
ধরনের কোন উঠিয়ে নেয়া হতো যেমন প্রত্যেক মৃত্যুবরণকারীকে দুনিয়া থেকে
উঠিয়ে নেয়া হয়ে থাকে অথবা এই উঠিয়ে নেয়ার অর্থ যদি শুধু সম্মান ও মর্যাদার উন্নতি
হতো যেমন হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছে: (আর তাঁকে আমি উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করেছিলাম)
তাহলে এখানে কথাটা বলা অধিক যুক্তিযুক্ত
হতো। যেমন: 'নিসন্দেহে
তারা ঈসাকে হত্যা করেনি বরং আল্লাহ তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে নিয়েছেন।
তারপর তাকে স্বাভাবিক মৃত্যুদান করেছেন। ইহুদীর তাকে হত্যা করতে চাইছিল কিন্তু
আল্লাহ তাকে উন্নত মর্যাদায় দান করেছেন।
তিন: যদি এই উঠিয়ে নেয়াটা যেমন তেমন মামুলি
ধরনের উঠিয়ে নেয়া হতো, যেমন প্রচলিত নিয়মে কোন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা বলে
থাকি: ''আল্লাহ
তায়ালা তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন", তাহলে এর উল্লেখ করার পর আবার ''আল্লাহ মহাশক্তিধর ও জ্ঞানী"
এই বাক্যটি
বলা সম্পূর্ণ অসমিচীন ও অপ্রাসংগিক হয়ে
পড়তো। যে ঘটনায় আল্লাহর জবরদস্ত শক্তি ও জ্ঞানের অস্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে একমাত্র
তেমন কোন ঘটনার পরই এ ধরনের বাক্য উচ্চারণ করা উপযোগী ও সমিচীন হতে পারে।
এর জবাবে কুরআন থেকে কোন যুক্তি প্রমাণ
পেশ করতে চাইলে বড় জোর এতটুকু বলা যায় যে, সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ (رَّفَعَهُ)
শব্দটি ব্যবহার করেছেন (৫৫ আয়াত)। কিন্তু সেখানে ৫১ নং টীকায় আমরা একথা পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছি যে,
স্বাভাবিক মৃত্যু
অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার তেমন সুস্পষ্ট
নয়। বরং এ শব্দটি থেকে 'প্রাণ হরণ' এবং 'প্রাণ ও দেহ উভয়টি হরণ' করা অর্থ হতে পারে। কাজেই আমরা ওপরে যে
সমস্ত কারণ ও নিদর্শন বর্ণনা করেছি সেগুলো নাকচ করে দেবার জন্য এটি মোটেই
যথেষ্ট নয়। ঈসা আলাইহিস সালাম স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন বলে যারা দাবী জানিয়ে
আসছে তারা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে, প্রাণ ও দেহ হরণ করার ব্যাপার (رَّفَعَهُ)
শব্দটির ব্যবহারের আর কোন নজির আছে কি৷ কিন্তু মানব জাতির সমগ্র
ইতিহাসে প্রাণ ও দেহ হরণ করার ব্যাপারটি যখন
মাত্র একবারই সংঘটিত হয়েছে তখন এই অর্থে
মানুষের ভাষায় এ শব্দটির ব্যবহারের নজির দাবী করা একবারেই অর্থহীন। ভাষার মূল
আভিধানিক পরিসরে এ শব্দটির এ ধরনের অর্থ ব্যবহারের অবকাশ আছে কি না এখানে কেবল
এতটুকুই দেখা দরকার। যদি অবকাশ থেকে থাকে তাহলে একথা মানতে হবে যে,
কুরআন সশরীরে উঠিয়ে নেয়ার আকীদার
দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদ জানাবার পরিবর্তে এ শব্দটি ব্যবহার করে এই আকীদাটির সহায়ক
কারণ ও নির্দশনগুলোর সংখ্যা আরো একটি বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যথায় যেখানে পূর্ব থেকেই
সশরীরে উঠিয়ে নেবার আকীদা বর্তমান ছিল এবং যার ফলে ঈসাকে খোদায়ী শক্তির অধিকারী
মনে করার আকীদা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে, 'মৃত্যু-এর ন্যায় সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন শব্দ
ব্যবহার না করে 'ওফাত'-এর ন্যায় দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করার কোন কারণ ছিল না।
অসংখ্যা
হাদীসেও সশরীরে উঠিয়ে নেবার আকীদাকে আরো শক্তিশালী করেছে। এ হাদীসগুলোতে হযরত
ঈসা ইবনে মারয়াম আলাইহিস সালামের পুনর্বার দুনিয়ার আগমন ও দাজ্জালকে হত্যা করার
ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। (সূরা আহযাবের তাফসীরের
পরিশিষ্টে আমি এ ধরনের সমস্ত হাদীস একত্র
করে দিয়েছি)। এগুলো থেকে হযরত
ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় বার আগমনের ব্যাপারটি
অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যুর পর তিনি পুনর্বার জীবিত হয়ে এই মরজগতে
ফিরে আসবেন অথবা আল্লাহর এই বিশাল সাম্রাজ্যের কোথাও তিনি আছেন এবং সেখানে থেকে
আবার এই দুনিয়ার ফিরে আসবেন-এ দু'টির
মধ্যে কোন্টি এখন অধিকতর যুক্তিসংগত বলে মনে
হয়৷ যে কোন বিবকবান ব্যক্তি নিজেই এর মীমাংসা করতে পারেন।
মন্তব্যঃ তাফসিরের মাঝের অর্থ কাট করে এনে ভুল ব্যাখ্যা
করা হয়েছে। কাজেই অনেকের ভুল ভাঙ্গে আশা করছি।
০৪। কুরআন
ও ইসলাম সর্বযুগে সংরক্ষিত কি না, এ প্রসঙ্গে।
মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন তার
কিতাব, “ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” এ মাওলানা মওদূদী লেখা “কুরআনেন চারটি
মৌলিক পরিভাষা” যা আধুনিক প্রাকাশনীর ৮ম প্রকাশ, জুন ২০০২ এর ১২-১৩ পৃষ্ঠার উদৃতি তুলে ধরেন এভাবে।
কিন্তু
কোরআন অবতীর্ন হওয়ার সাময় এ শব্দগুলোর (ইলাহ, রব, দ্বীন ও ইবাদত) যে মৌল অর্থ
প্রচালিত ছিল, পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে তাকে। শেষ
পর্যন্ত এক- একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকথা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট
অর্থের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে পড়ে। এর এক পৃষ্ঠা পরে তিনি লিখেন, এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কোরআনের
তিন-চুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে
প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। (“ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” এর পৃষ্ঠা নম্বর ৩৯৬)।
এই উদৃতি
তুলে ধরার আগে তিনি ‘’কুরআন ও ইসলাম সর্বযুগে সংরক্ষিত কি না, এ প্রসঙ্গে” এই
শিরোনামে লিখেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে ইসলাম সর্ব যুগের মানিষের জন্য
ধর্ম এবং ইসলামের কিতার কুরআন সর্ব যুগের জন্য ধর্মীয় কিতার। সে মতে কিয়ামত পর্যান্ত
এই কিতাব হিফাজত ও সংরক্ষনের দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজেই নিয়েছেন এবং সর্ব যুগে
ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝার ও পেশ করার মত যোগ্য ব্যক্তিত্ব তৈরি করার ধারা অব্যহত
রেখেছেন। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন মুহুর্ত আসেনি ইসলাম তথা কুরাআন হাদিস সঠিকভাবে
বুঝার ও পেশ করার মত যোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলনা। বরং কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞান সমৃদ্ধ
একটি জামাত এবং হকপন্থী একটি দল সর্বদাই বিদ্যমান ছিল এবং থাকবে। কুরআনে কারীমে
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
إِنَّا
نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُ ۥ لَحَـٰفِظُونَ (٩)
অর্থঃ
আর এ বাণী, একে তো আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক৷
এ কথা সুষ্পষ্ট যে কুরআন শব্দ ও অর্থ সমন্বিত
একটি ঐশি কিতাব। শুধু শব্দের নাম কুরআন নয়। সুতারং সর্বযুগে সংরক্ষিত থাকার অর্থ হল
তার শব্দ ও অর্থ উভয় সংরক্ষিত
থাকা। আর এটা উপরের আয়াত দ্বারা প্রমানিত।
মাওলানা
মওদূদীর কাট করা বক্তব্য ও তার উপর মন্তব্য পড়ালাম। এবার একটু সম্পুর্ণ বক্তব্যটি
পড়া জরুরি মনে হচ্ছে। কারন কাট করা বক্তব্য পড়ে লেখকের সম্পূর্ণ মনোভাব বুঝা যাবে
না। তিনি তার উল্লেখিত বইয়ে লিখেন,
ইলাহ, রব, দীন ও ইবাদত -কোরআনের পরিভাষায় এ চারটি শব্দ মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী।
কোরআনের সার্বিক দাওয়াত এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই একক
রব ও ইলাহ। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, নেই কোন রব।
উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত -এ কেউ তাঁর শরীক নেই। সুতরাং তাঁকেই তোমাদের ইলাহ ও রব
মেনে নাও। তিনি ব্যতীত অন্য সকলের
উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করো। তাঁর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া অপর
কারো ইবাদাত করো না। দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যেই খালেস করো, অন্য সব দীনকে প্রত্যাখান করো।
এর
পর তিনি এই চারটি পরিভাষা সম্পর্কিত নয়টি আয়াত উল্লেখ করে বলেন,
উদাহরণ
স্বরূপ এ কয়টি আয়াত পেশ করা হলো। কোরআন অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তি প্রথম
দৃষ্টিতেই অনুভব করবে যে, কোরআনের সমগ্র আলোচনাই এ চারটি পরিভাষাকে
কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কোন্দ্রীয় চিন্তাধারা (Central
idea) এইঃ
আল্লাহ্
হচ্ছেন রব ও ইলাহ্ ।
আল্লাহ
ব্যতীত অন্য কারো রবুবিয়্যাত-উলুহিয়্যাতের অধিকার নেই।
সুতরাং
কেবল তাঁরই ইবাদাত করতে হবে।
দীন
হবে একনিষ্ঠ ভাবে তাঁরই জন্যে।
পরিভাষা
চুতষ্টয়ের গুরুত্ব
এটা
স্পষ্ট যে, কোরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্যে পরিভাষা চুতষ্টয়ের
সঠিক ও পরিপূর্ণ তাৎপর্য অনুদাবন করা একান্ত অপরিহার্য। ইলাহ শব্দের অর্থ কি,
ইবাদাতের সংজ্ঞা কি, দীন কাকে বলে- কোন
ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কোরআনই অর্থহীন হয়ে পড়েবে। সে
তাওহীদ জানতে পারবে না, শির্ক বুঝতে পারবে না, ইবাদাতকে একান্তভাবে আল্লাহ্ র জন্যে নিবেদিত করতে পারবে না, দীনকে করতে পারবে না আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট। অনুরূপভাবে কারো মানসপটে
যদি এ পরিভাষাগুলোর তাৎপর্য অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ থাকে, তাবে
তার কাছে কোরআনের গোটা শিক্ষাই অস্পষ্ট থাকবে। কোরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও
তার আকীদা ও আমল-বিশ্বাস ও কর্ম-উভয়ই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। সে মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই
বলবে আর তা সত্ত্বেও অনেককে ইলাহ বানাবে। ‘আল্লাহ ছাড়া আর
কোন রব নেই’। মুখে এ কথা ঘোষণা করলেও
কার্যত অনেকেই তার রব সেজে বসবে। সে একান্ত সদুদ্দেশ্যে বলবে, আল্লাহ ছাড়া আর
কারো ইবাদাত করি না, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আরো অনেক মাবুদের
ইবাদাতেই সে মশগুল থাকবে। সে একান্ত জোর দিয়ে বলবেঃ আমি আল্লাহর দীনে আছি,
‘অন্য কোনো দীনে আছে’ বলা হলে সে লড়তে উদ্যত
হবে কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক দীনের শিকলই তার গলায় ঝুলবে। কোন গায়রুল্লাহ্ র জন্যে
তার মুখ থেকে ‘ইলাহ’ ‘রব’ শব্দ তো কোন সময়ই বেরুবে না; কিন্তু যে অর্থের জন্যে
এ শব্দগুলি গঠিত, সে প্রেক্ষিতে তার অনেক ইলাহ ও রব থাকবে।
আর বেচারা জানতেও পারবে না যে , সে কার্যত আল্লাহ ছাড়াও বহু
রব- ইলাহ বানিয়ে রেখেছে। তাকে যদি বলা হয়ঃ তুমি অন্যের ‘ইবাদাত’
করছো, ‘ দীন’-এ শির্ক
করছো, তা হলে প্রস্তর নিক্ষেপ করার জন্যে ছুটে আসবে, কিন্তু ইবাদাত ও দীনের তাৎপর্যের বিচারে সে কার্যত অন্যের ইবাদাত করছে,
দীন পালন করছে। সে জানতেও পারবে নাঃ আমি যা করছি, আসলে তা অন্যের ইবাদত ভিন্ন কিছুই নয়। যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে,
তাকে গায়রুল্লাহর দীন ব্যতীত আর কিছুই বলা যায় না।
ভুল
ধারণার মূল কারণঃ
আরবে
যখন কোরআন পেশ করা হয়, তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ অর্থ কি,
রব কাকে বলা হয়। কারণ তাদের কথাবার্তায় এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতে
প্রচলিত ছিল । তারা জানতো এ শব্দগুলোর অর্থ কি, কি এর
তাৎপর্য। তাই তাদের যখন বলা হলো যে, আল্লাহ-ই একক রব ও ইলাহ,
উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতে আদৌ কারো হিসসা নেই, তারা তখন ঠিক ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। স্পষ্টতই তারা বুঝতে পেরেছিল, অন্যের জন্যে কোন্ জিনিসটি নিষেধ করা হচ্ছে আর আল্লাহ্ র জন্যে কোন
জিনিসটি করা হচ্ছে নিদিষ্ট। যারা বিরোধিতা করছিল, গায়রুল্লার
উলুহিয়্যাত-রুবুবিয়্যাত অস্বীকৃতির আঘাত কোথায় কোথায় লাগে, তা
জেনেশুনেই তারা বিরোধিতা করেছিল। এ মতবাদ গ্রহণ করে আমাদেরকে কি বর্জন করতে হবে আর
কি গ্রহণ করতে হেব তা জেনেশুনেই তারা ঈমান এনেছিলো। অনুরূপভাবে ইবাদাত ও দীন শব্দও
তাদের ভায়ায় প্রচালিত ছিলো পুর্ব হতে। তারা জানতো, আব্দ কাকে
বলে, উবদিয়্যাত কোন্ অবস্থার নাম। ইবাদাতের উদ্দেশ্য কোন্
ধরনের আচরণ, দীনের তাৎপর্য কি? তাই
তাদের যখন বলা হলো, সকলের ইবাদাত ত্যাগ করে আল্লাহ্ র ইবাদাত
করো, সকল দীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দীনে দাখিল হও,
তখন কোরআনের দাওয়াত বুঝতে তাদের ভুল হয় নি। এ শিক্ষা আমাদের জীবন
ব্যবস্থায় কোন্ ধরনের পরিবর্তন চায়, শোনামাত্রই তারা তা
বুঝতে পেরেছিলো।
কিন্তু কোরআন অবতীর্ন হওয়ার সাময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচালিত ছিল, পরবর্তী
শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে তাকে। শেষ পর্যন্ত এক- একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ
ব্যাপকথা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে পড়ে। এর এক কারণ ছিলো আরবী
ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব, দ্বিতীয় কারণ ছিলো ইসলামী সমাজে
যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে, তাদের কাছে ইলাহ, রব, দীন, ইবাদাতের সে অর্থ
অবশিষ্ট ছিলো না, যা কোরআন নাযিল হওয়ার সময় অমুসলিম সামজে
প্রচলিত ছিলো। এ কারণে পরবর্তী কালের অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থে অধিকাংশ কোরানিক
শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অথ্যের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তী
কালের মুসলমানরা বুঝতো। যেমনঃ
ইলাহ
শব্দকে মূর্তি ও দেবতার প্রায় সমার্থক করা হয়েছে। লালন-পালন কর্তা বা
পরওয়ারদেগার-এর প্রতিশব্দ করা হয়েছে রবকে, ইবাদাতের অর্থ
করা হয়েছে পূজা-উপাসনা, ধর্ম, মযহাব
এবং রিলিজিয়ান (Religion) -এর সমার্থজ্ঞাপক শব্দ করা হয়েছে
দীনকে। তাগুত- এর তর্জমা করা হয়েছে মূর্তি বা শয়তান।
ফল
দাঁড়ালো এই যে, কোরআনের মৌল উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে
কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো । কোরআন বলছে, ‘আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইলাহ
বানাবে না।’ লোকে মনে করছে, আমারা
মূর্তি ও দেবতাকে ত্যাগ করেছি। সুতরাং কোরআনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেছি। অথচ ইলাহ এর
অর্থ আরও যেসব ব্যাপারে প্রযোজ্য, তারা সে সবকে আঁকড়ে ধরে
রয়েছে। গায়রুল্লাহকে যে ইলাহ বানাচ্ছে সে খবরও তাদের নেই। কোরআন বলছেঃ আল্লাহ ছাড়া
আর কাউকে রব স্বীকার করো না। লোকে বলছেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে আমরা পরওয়ারদেগার
বলে স্বীকার করি না; সুতরাং আমাদের তাওহীদ পরিপুর্ণ হয়েছে। অথচ
আরো যে সকল অর্থে রব শব্দ ব্যাবহৃত হয়, সে প্রেক্ষিতে
অধিকাংশ ব্যক্তিই আল্লাহর পরিবর্ততে অন্যান্যের রুবুবিয়্যাত স্বীকার করে নিয়েছেন।
কোরআন বলছেঃ তাগুত-এর ইবাদাত ত্যাগ করে শুধু আল্লাহর ইবাদাত কর। লোকেরা বলছেঃ আমরা
মুর্তি পূজা করি না শয়তানের ওপর লানত করি, কেবল আল্লাহকেই
সিজদা করি, সুতরাং আমরা কোরআনের এ দাবীও পূর্ণ করেছি। অথচ
পাথরের মুর্তি ছাড়া অন্যান্য তাগুতকে তারা আঁকড়ে ধরে আছে, পূজা
ব্যতীত অন্যান্য রকমের যাবতীয় ইবাদাত গায়রুল্লার জন্যে নিদিষ্ট করে রেখেছে। দীনের
অবস্থাও তাই। আল্লাহর জন্যে দীনকে খালেস করার অর্থ মনে করা হয় শুধু এই যে, মানুষ ‘ইসলাম ধর্ম’ কবুল করবে,
হিন্দু বা ইহুদী-খৃস্টান থাকবে না। এ ভিত্তিতে ‘ইসলাম ধর্মের সকল ব্যক্তিই মনে করে আমি দীনকে আল্লাহর জন্যে খালেস করে
রেখেছি। অথচ দীন-এর ব্যাপকতর অর্থের দৃষ্টতে এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী, যাদের দীন আল্লাহর জন্যে খালেছ নয়।
ভুল
দারণার ফল
এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার
তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কোরআনের তিন-চুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা বরং তার
সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও
মানুষের আকীদা-আমল-বিশ্বাস ও কর্মে যে সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটা তার অন্যতম
প্রধান কারণ। সুতরাং কোরআনুল করীমের মৌল শিক্ষা এবং তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা
একান্ত জরুরী ।
ইতিপূর্বে
অনেক নিবন্ধে আমি এসব শব্দের তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ যাবৎ আমি
যা আলোচনা করেছি, একদিকে তা সকল ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের
জন্যে যথেষ্ট নয়, অপরদিকে তা দ্বারা লোকদের পূর্ণ তৃপ্তি হতে
পারে না। কারণ অভিধান ও কোরআনের আয়াত উল্লেখ ছাড়া লোকেরা আমার সকল ব্যাখ্যাকেই
নিজস্ব মত বলে মনে করে। যারা আমার সাথে একমত নন, আমার মত
অন্তত তাদের পরিতৃপ্তির কারণ হতে পারে না। আলোচ্য গ্রন্থে এ চারটি পরিভাষার
পরিপূর্ণ অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অভিধান ও কোরআনে প্রমাণ
পাওয়া যায় না এমন কোন কথাই আমি এ গ্রন্থে বলবো না।
মন্তব্যঃ সমালোচনা করলে অনেক কথাই বলা যায়। উক্ত লেখার দ্বারা “কুরআন ও ইসলাম সর্বযুগে সংরক্ষিত’’ এমন শীরোনামে সামলোচনা করা ঠিক হয়নি
কারন মাওলানা মওদূদী বুঝাতে চেয়েছেন কালের আবর্তনে কিভাবে ইসলামের কিছু পরিভাষার অর্থ মুসলিমদের
কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, কুরআন নয়। কারন মওদুদী সাহেব বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত এক একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকথা
হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে পড়ে’ এখানে আল কুরআনের
ব্যাপকতা হারানোর কথা বলা হয় নি। তার চারটি শব্দের ব্যাপকতা হারান কথা বলা হয়েছে।
এতে কুরআন ও ইসলাম অসংরক্ষিত বলা হয় নি বরং উম্মতের নৈতিক অধপতের প্রতি ইঙ্গিত করা
হয়েছে। সে কেউ এ কথা বুঝতে পারবে যে, একজন মুসলিম কবরে সিজদা করেও নিজেকে তাওহীদ
বাদী ভাবছে কারন সে তাওহীদের ব্যাপকতা বুঝেনি। আর বলতে আমি শির্কি কাজ করলাম কই? আমি কি মুর্তি পুজা
করছি যে শির্ক বলছেন। তৎকালিন সাহাবি (রাঃ) নয়, মুসরিকগনও জানত ইমান আসলে
গাইরুল্লাহ ইবাদাত করা যাবে না। বিপদে আপদে গাইরিল্লাহ নিকট সাহায্য চাওয়া চলবে
না। অথচ তাওহীদবাদী মুসলিম একথা বুঝল না। অপর পক্ষে মাওলানা মওদূদী যে সময় এই কথা
লিখেন তখন ভারতের মাজারগুলি দেখলে আর পুজার মন্ডপ দেখলে বুঝা যাবে না, এদের মধ্য
কোন পার্থক্য আছে কি। অথচ তাওহীদ আর শির্কি এক হতে পারে না। তাই মুসলিমদের এহেন
অবস্থা দেখে তিনি বলেন, কোরআন
অবতীর্ন হওয়ার সাময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচালিত ছিল, পরবর্তী শতকে
ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে তাকে। শেষ পর্যন্ত এক- একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ
ব্যাপকথা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে পড়ে। কাজেই এখানে কুরআন “কুরআন ও ইসলাম সর্বযুগে
সংরক্ষিত প্রশ্ন করা অবান্তর। এখানে মানুষের বুঝ ও আমলের পরিবর্তণ কে বুঝান হচ্ছে।
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)
ইসলামের দৃষ্টিতে দলাদলি-৩০
জামায়াতে
ইসলামি
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।
গ। যে সকল অভিযোগ
একেবারে অমূলক।
১। এ অভিযোগ মাওলানা মওদুদীর রচিত কোন গ্রন্থেই
পাওয়া যায় না।
তার বিরোধীগন তাহার
বিরুদ্ধে এমন কিছু অভিযোগ করে যা একেবারে
অমূলক। মাওলানা বশিরুজ্জামান, “সত্যের আলো”
নামক বইয়ে মাওলানা মওদুদীর বিরুদ্ধে আনিক অভিযোগের কোনটি স্বীকার
করেছেন, কোনটা অস্বীকার করেছেন আবার কোনটাকে একেবারে অমূলক বলেছেন। যেমন তিনি দাবি
করেন ফিতনায়ে মওদুদীয়ত নামক চটি বইয়ে বলা হয়েছেঃ
গুনাহের ব্যাপারে আমিরের
অনুগত্য করতে হবে। (ফিতনায়ে মওদুদীয়ত পৃষ্ঠা-১৮)।
হযরত উসমান (বাঃ) এর মধ্যে
খেলাফতের যোগ্যতা ছিল না। (ফিতনায়ে মওদুদীয়ত পৃষ্ঠা-২১)।
আবু হানিফা কোন চরিত্রবান
কিংবা ফাসিক ফাজির ব্যক্তি ছিলেন আমি জানি
না। তার সম্পর্কে বর্ণিত বর্ণনাগুলোইবা কতটুকু অকাট্য। (ফিতনায়ে মওদুদীয়ত পৃষ্ঠা-২১)।
এ বোখারী শরীফের দেবতা
কতদিন বগণদাবা করে ফিরবে। (ফিতনায়ে মওদুদীয়ত পৃষ্ঠা-১৪১)।
ফেরেশতা প্রায় ঔ জিনিস যাকে
গ্রীক, ভারত ইত্যাদি দেশের মুশরিকরা দেবী দেবতা স্থির
করেছে।” (মিস্টার মওদুদীর নিউ ইসলাম : তাজদীদ ও ইহইয়ায়
দ্বীন, ১০ পৃষ্ঠা)।
মাওলানা বশিরুজ্জামান বলেন,
এ অভিযোগ মাওলানা মওদুদীর রচিত কোন গ্রন্থেই পাওয়া যায় না। অথচ “ফিতনায়ে মওদুদীয়ত”
লেখক শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া (রহঃ) এর মত ব্যক্তিসম্পন্ন আলেমের নামে
চালিয়ে দিয়েছেন।
২। এ অভীযোগের অধিকাংশই কাট
সাট করা বা মুল বক্তব্য আড়াল করে রাখা হয়েছে।
এমন আরও অনেক অমূলক অভীযোগ
মাওলানা মওদুদীর বিরুদ্ধ করা হয়েছে যার অধিকাংশই কাট সাট করা বা আগের-পিছের
বক্তব্য গোপন করা হয়েছে। অথবা কোন মাজার পুজারির লেখা দেখে নেট থেকে কপি পেষ্ট করা
হয়েছে। যার কোন ভিত্তি নেই অথবা কপি পেষ্ট কারিও তাহকিক করে আসল সত্য উদঘটনের
চেষ্টা করেনি। এমনই কিছু অভিযোগ তুলে ধরলামঃ
আবুল আলা মওদুদী নাকি বলেছেন,
০১. “কোরআন করিম হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু নাজাত বা
মুক্তির জন্য নয়।” (তাফহিমাত, ১ম খন্ড,
৩১২ পৃষ্ঠা)।
০২. “সাহাবায়ে কেরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগন অনেকে মনগড়া হাদিস বর্ণনা করেছেন।”
(তরজমানুল কোরআন ৩৫ সংখ্যা) ঙ/৩)
০৩. “সাহাবায়ে কেরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমগনের
মধ্যে জাহেলিয়াতের বদ-স্বভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটে।” (তাফহীমাত ২য় খণ্ড, ১৫৫ পৃষ্ঠা)।
০৪. “হযরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু
খিলাফতের দায়িত্ব পালনে সম্পুর্ণ অযোগ্য ছিলেন”। (তাজদীদ ও
ইয়াহইয়ায়ে দীন: পৃষ্ঠা ২২)।
০৫. “নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ওফাতের সময় ব্যাক্তি সম্মানের
কু-মনোবৃত্তি হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু কে
পরাভূত করেছিল। (তরজুমানুল কুরআন, রবিউস
সানি ৩৫৭ হিজরী)।
০৬. “হযরত উসমান রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু এর মাঝে
সজন-প্রীতির বদগুণ বিদ্যমান ছিল। (খেলাফত ও মুলকিয়াত,
পৃষ্ঠা ৯৯)।
০৭. “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু স্বীয়
খেলাফত কালে এমন কিছু কাজ করেছেন যাকে অন্যায় বলা ছাড়া উপায় নেই। (খেলাফত ও মুলকিয়াত, পৃষ্ঠা ১৪৬/১৪৩)।
০৩। ব্রেলভীদের মণগড়া আকিদার কিছু
অমুলক অভিযোগ।
এমনই
কিছু অমুলক অভিযোগ ব্রেলভীগন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
প্রতি করে থাকে, যা ইসলামের দৃষ্টতে সঠিক কিন্তু
তাদের আকিদা বিরোধী। তেমনই কিছু অভিযোহ
তাদের দেওয়া কিছু রেফারেন্সসহ উল্লেখ করা হলঃ
০১। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নন। রাসূল না অতি মানব,
না মানবীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত। তিনি যেমন খোদার ধন-ভান্ডারের মালিক নন, তেমনি খোদার অদৃশ্যের জ্ঞানেরও
অধিকারী নন বলে সর্বজ্ঞ নন।
তিনি পরের কল্যাণ বা অকল্যাণ সাধন তো দূরে নিজেরও কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে অক্ষম। তিনি কোন কিছু
হালাল বা হারাম করতে পারেন না। (লন্ডনের
ভাষণ, পৃষ্টা: ৩-১৯,
কৃত: আবুল আলা মওদূদী, অনুবাদ:
আখতার ফারূক, জুলকরনাঈন প্রেস, ৩৮, বানিয়া নগর, ঢাকা)।
০২। আজমীর
শরীফে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করা জেনার গুনাহের চেয়েও মারাত্নক!
“যারা মনষ্কামনা পূর্ণ করার জন্য আজমীর অথবা সালায়ে মসউদের কবরে বা
এই ধরনের অন্যান্য স্থানে যায়, তারা এত বড় গুনাহ করে যে,
হত্যা ও জিনার গুনাহ তার তুলনায় কিছুই নয়।” (তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দীন বাংলা অনুবাদের নাম ইসলামী রেনেঁসা আনোদালন, আবুল আলা মওদূদী পৃষ্ঠা: ৭২ । অনুবাদ:
আবদুল মান্নান তালিব। আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা। )
০৩। প্রিয়
নবীর সুন্নাত ফাতেহাকে পূজার সাথে তুলনা! “একদিকে মুশরিকদের ন্যায় পূজা আর্চনার পরিবর্তে ফাতেহাখানী, যেয়ারত, নজর-নিয়াজ, উরস, চাদর চড়ানো, তাজিয়া করা
এবং এই ধরনের আরও অনেক ধর্মীয় কাজ সম্বলিত একটি নতুন শরীয়ত তৈরি করা হয়েছে।”
(তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দীন বাংলা অনুবাদের নাম ইসলামী রেনেঁসা আনোদালন,
আবুল আলা মওদূদী পৃষ্ঠা ৬, অনুবাদ: আবদুল মান্নান তালিব, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা।)
ফিকহি
মাসয়ালা মাসায়াইলের মতভেদ সমূহঃ
সবাই জানেন
উপমহাদেশের অনেক আলেমদের সাথে মওদুদীর আকিদার পাশাপাশি কিছু ফিকহি মাসয়ালা
মাসায়াইলে মতভেদ হয়েছে। আমরা বিষয় ছিল আকিদা সম্পর্কে, কাজেই সম্পুর্ণ লেখার কোথাও
কোন ফিকহি বিষয় স্থা্ন পায়নি। এই লেখায় তার একটু ব্যতিক্রম করে শুধু
বিরোধপূর্ণ ফিকহি মাসয়ালা মাসায়াইলে
শিরোনামসহ মাওলানা মোওদুদীর কিছু উক্তি উল্লেখ করব।
০১। ইসলামি দাড়ির সীমা
নির্ধারন সম্পর্কে।
দাড়ি রাখা নিয়ে মওদূদী
ও উপমহাদেশের আলেমদের মাঝে কোন মত পার্থক্য নেই। পার্থক্য আছে শুধু দাড়ির সীমা কত
টুকু এ বিষয়ে। রাসায়েল ও মাসায়েল প্রথম খন্ডে আবুল আ’লা মওদূদীর দাড়ি পরিমান সম্পর্কে যে মতামত
প্রদান করেন, তার উপর ভিত্তি কর উপমহাদেশের অনেক আলেম মওদূদীর অনেক সমালোচনা করেন।
তিনি তার “তরজমানুল কুরআন” পত্রিকার মাধ্যমে তার
জবাবও প্রদান করেন। তিনি দাড়ির
পরিমান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:
দাড়ি রাখার
ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন পরিমান নির্দষ্ট করেন নি। শুধু এ
নির্দেশ দিয়েছেন যে দাড়ি রাখতে হবে। ফাসিক লোকদের ফ্যাসন থেকে যদি আপনি দুরে থাকতে
চান, তা হলে এটুকু দাড়ি রাখুন যে,
সমাজের সাধারন
পরিভাষায় তাকে দাড়ি রাখা বলে গন্য করা যায়। (আপনার মুখে যেন
এতটুকু দাড়ি না থাকে যা দেখে মনে করা হয় যে আপনি কয়েক দিন দাড়ি কামাননি) তা হলেই শরীয়ত প্রনেতার উদ্দেশ্য আপনার দ্বারা সম্পাদিত
হয়েছে বলে ধরা হবে, চাই তা দ্বারা
ফকিহদের দেয়া শর্ত পূরন হোক কিংবা না হোক। (রাসায়েল ও
মাসায়েল প্রথম খন্ড )।
সমালোচনাকারি আলেমদের মন্তব্য হল: দাড়ি এক মুষ্টি বা চার আংগুল পরিমান লম্বা রাখতে হবে। একমুষ্টির কম রাখা বা একেবারে তা মুণ্ডিয়েফেলা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম এবং কবীরা গুনাহ। এছাড়া সাহাবা, সালাফেসালেহীন এবং ফক্বীহগণের দাড়ি রাখার নিরবছিন্ন আমল এবং তাদের বিভিন্ন উক্তিসমূহের দ্বারাও এক মুষ্টি পরিমাপ লম্বা দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং এর বিপরীত করা হারাম সাব্যস্ত হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে আজমা‘ঈন, তাবেয়ী, তাবে-তাবেঈ, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, চার মাযহাবের সকল ইমাম
ওবুযুর্গবৃন্দ দাড়ি এক মুষ্টির চেয়ে বেশি বা কমপক্ষে একমুষ্টি রাখাকে ওয়াজিব কিংবা আবশ্যিক সুন্নাহ বলেছেন।
হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়, আবু যুর‘আ
রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আবু
হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার দাড়ি মুঠ করে ধরতেন। এরপর এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত
অংশ কেটে ফেলতেন। (মুসান্নাফ
ইবন আবী শাইবা ২৫৯৯২ ও ২৫৯৯৯)।
‘আবদুল্লাহ
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যখন হজ্ব কিংবা ওমরা করতেন,
তখন দাড়ি মুঠো করে ধরতেন এবং মুঠোর বাহিরের যা বেশী হত তা কেটে ফেলতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৪৩)।
জাবের
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা হজ্ব ও ওমরা ছাড়া সবসময় দাড়ি লম্বা রাখতাম। (আবু দাউদ, হাদীস
নং ৪১৫৫)।
আবুল আ’লা মওদূদীর কে
প্রশ্ন করা হয়: দাড়ি পরিমান
নির্ধারিত নেই বলে তরজমানুল কুরআনে যা কিছু লেখা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমার
সংশয় রয়েছে। কারন বড় বড় আলিমদের এ
ব্যাপারে সর্বসম্মত ফতোয়া রয়েছে যে. দাড়ি এক মুষ্টির লম্বা হবে। যার পরিমান এর
চেয়ে কম সে ফাসিক। দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে এই সম্মিলিত এবং সর্বসম্মত ফতোয়া
প্রাত্যাখ্যান করছেন।
তিনি
জবাব দেন: এ ফতোয়াদানকারী আলিমকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত যে , দাড়ির পরিমান নির্ধারিত
পক্ষে তাদের কাছে কি দলিল আছে? বিশেষ করে তারা ফিসক শব্দের কি অর্থ করেন, যার ভিত্তিতে
তাদের নির্ধারিত পরিমান যারা রাখে না তাদের ফাসিক বলা যেতে পারে? এ সকল বড় বড়
আলিমদের জন্যে আমার নিদারুন আফসস হয়, যারা নিজেরাই শরিয়তের সীমা বুঝে না। এবং এমন
সর ফতোয়া দিয়ে বসের যাতে সরাসরি শরিয়তের সীমা লংঘিত হয়। শরীয়ত প্রনেতা দাড়ির
ব্যাপারে কোন সীমারেখা নির্ধারণ করে দেননি। আলিমগন যে সীমারেখা নির্ধারণের চেষ্টা
করছেন, তা একটা গভেষনা লব্ধ জিনিস মাত্র। আর গভেষনা লব্ধ বিধান কখন এ মর্জাদা লাভ
করে না, যা কুরআন হাদিস প্রদত্ত বিধানের। কাউ কে ফাসিক বলতে হলে কেবল কুরআন
সুন্নাহর বিধানের বিরোধী কাজের জন্যেই ফাসিক বলা যেতে পারে। গভেষনা লব্ধ বিধানের
(চাই সেটা যত বড় আলিমের গভেষনাই হোক না কেন) খেলাপ কাজ করা কখন ফাসিকি সঙ্গায় পড়ে
না। অন্যথায় এটাকে ফাসিকি কাজ বলে আখ্যায়িত করার অর্থ কেবল এই হতে পারে যে,
শরীয়তের গবেষক ও মুজতাহিদদের মর্জাদাও তাই, যে মর্জাদা স্বয়ং শরীয়ত প্রণেতার। (রাসায়েল
ও মাসায়েল প্রথম খন্ড পৃষ্ঠ -১১৬)।
দাড়ি
রাখা সম্পর্কে অন্য আর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,
দাড়ি
রাখা কেবলমাত্র সুন্নতই নয়, বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাড়ি রাখার
হুকুম দুয়েছেন এবং কামিয়ে ফেলতে নিষেধ করেছেন। কাজেই দাড়ি রাখা আলেম ওলামাদের কাজ
এবং সাধারন মুসলমানদের এ ব্যাপারে রাখা বা না রাখার স্বাধীনতা আছে এধরনের কথা একটি
সম্পুর্ণ অনৈলামিক চিন্তা ভাবনার ফসল। বিশেষ করে কেন মুসলমান ব্যাক্তি যদি দাড়ি
কামানো পছন্দ করে থাকে তবে বুঝতে হবে তার
মধ্যে ইসলামিক রুচির পরিবর্তে কাফের সুলভ অনৈলামিক রুচি লালিত হচ্ছে। বড়ই অবাক
লাগে এবং দু:খ হয়। কারন মুসলমাদের দাড়ি রাখার হুকুম দিয়েছেন তাদের নবী ও মহান পথ প
প্রদর্শক মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অনিরূপভাবে
শিখদের ধর্মগুরুও তাদের দাড়ি রাখার হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু শিখরা তাদের ধর্মগুরুর
নির্দেষের অমর্জাদা করেনি, যেমন মুসলিমগন তাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর অবমানা করছে। (রাসায়েল ও মাসায়েল চতুর্থ খন্ড পৃষ্ঠ -৫০)।
মন্তব্য: এখানে আবুল আ’লা মওদূদীর সাথে অন্যদের
পার্থক্য দাড়ি রাখা নিয়ে নয় বরং দাড়ির পরিমাপ (সাইজ) নিয়ে। উপমহাদেশের আলিমদগনের দাবি হল, সর্বসম্মত ফতোয়া রয়েছে যে, দাড়ি এক মুষ্টির
লম্বা হবে। আবুল আ’লা মওদূদীর দাবি দাড়ি এক মুষ্টির লম্বা হবে এটা একটা ইসতিহাদ মাত্র, কাজেই এর
দ্বারা শরীয়তের সীমা নির্ধারন করা যায় না। এটি একটি ফিকহি মাসায়ের এতে দ্বিমত
থাকতে পারে, ইসতিহাদ ভুল হলেও নেকির আশা করা যায়। তবে উম্মতের ইজমা না হলেও
অধিকাংশ আলেমদের মতে দাড়ি এক মুষ্টির লম্বা হবে।
০২. সেহরী ও ইফতারের সময় সীমা নির্ধারনের প্রসঙ্গে।
এ প্রষঙ্গে
আবুল আ’লা মওদূদীর বলেন, আজকাল লোকেরা সেহরী ও ইফতারে উভয় ব্যাপারে অত্যধিক সতর্কতার
কারণে কিছু অযথা কড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু শরীয়াত ঐ দু'টি সময়ের এমন কোন সীমানা নির্ধারণ করে দেয়নি যে তা থেকে কয়েক
সেকেণ্ড বা কয়েক মিনিট একদিক ওদিক হয়ে গেলে রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রভাত কালে
রাত্রির কালো বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা ফুটে ওঠার মধ্যে যথেষ্ট সময়ের অবকাশ রয়েছে।
ঠিক প্রভাতের উদয় মুহূর্তে যদি কোন ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায় তাহলে সংগতভাবেই সে
তাড়াতাড়ি উঠে কিছু পানাহার করে নিতে পারে।
এই মাসায়েলের
ব্যাপারে তাকে ফতোয়ার বানে জরজরিত করা হয়। এটি এটি মতভেদ পূর্ণ মাসায়েল গুলির
মধ্যে অন্যতম একটি মাসায়ের কাজেই তার পূর্ণ বক্তব্যটি একটু দেখেনি।
মহান
আল্লাহ বলেন,
أُحِلَّ
لَڪُمۡ لَيۡلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآٮِٕكُمۡۚ هُنَّ لِبَاسٌ۬
لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٌ۬ لَّهُنَّۗ عَلِمَ ٱللَّهُ أَنَّڪُمۡ كُنتُمۡ
تَخۡتَانُونَ أَنفُسَڪُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡ وَعَفَا عَنكُمۡۖ فَٱلۡـَٔـٰنَ
بَـٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا ڪَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ
حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ
مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ وَلَا
تُبَـٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَـٰكِفُونَ فِى ٱلۡمَسَـٰجِدِۗ تِلۡكَ حُدُودُ
ٱللَّهِ فَلَا تَقۡرَبُوهَاۗ كَذَٲلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ ءَايَـٰتِهِۦ لِلنَّاسِ
لَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ (١٨٧)
রোযার সময় রাতের
বেলা স্ত্রীদের কাছে যাওয়া তোমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে ৷ তারা তোমাদের পোশাক
এবং তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানতে পেরেছেন, তোমরা চুপি চুপি নিজেরাই
নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলে৷ কিন্তু তিনি তোমাদের অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন এবং
তোমাদের ক্ষমা করেছেন। এখন তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে রাত্রিবাস করো এবং যে স্বাদ
আল্লাহ তোমাদের জন্য বৈধ করে দিয়েছেন তা গ্রহণ করো৷ আর পানাহার করতে থাকো। যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক
চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। তখন এসব কাজ ত্যাগ করে রাত পর্যন্ত
নিজের রোযা পূর্ণ করো৷ আর যখন তোমরা মসজিদে ই’তিকাফে বসো তখন স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা, এর ধারে কাছেও যেয়ো
না। এভাবে
আল্লাহ তাঁর বিধান লোকদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, আশা করা যায় এর ফলে
তারা ভুল কর্মনীতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে ৷ (সুরা বাকারা ২:১৮৭)।
তাফহিমূল
কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতের ১৯৪ নম্বর টিকায় বলেন,
রাত
পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করার অর্থ হচ্ছে, যেখানে রাতের সীমানা শুরু হচ্ছে
সেখানে তোমাদের রোযার সীমানা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সবাই জানেন, রাতের সীমানা
শুরু হয় সূর্যাস্ত থেকে। কাজেই সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করা উচিত। সেহরী ও
ইফতারের সঠিক আলামত হচ্ছে, রাতের শেষ ভাগের যখন পূর্ব দিগন্তে প্রভাতের শুভ্রতার সরু রেখা
ভেসে উঠে ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন সেহরীর সময় শেষ হয়ে যায়। আবার যখন দিনের
শেষ ভাগে পূর্ব দিগন্ত থেকে রাতের আঁধার ওপরের দিকে উঠতে থাকে তখন ইফতারের সময় হয়।
আজকাল লোকেরা সেহরী ও ইফতারে উভয় ব্যাপারে অত্যধিক সতর্কতার কারণে কিছু অযথা
কড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু শরীয়াত ঐ দু'টি
সময়ের এমন কোন সীমানা নির্ধারণ করে দেয়নি যে তা থেকে কয়েক সেকেণ্ড বা কয়েক মিনিট
একদিক ওদিক হয়ে গেলে রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রভাত কালে রাত্রির কালো বুক চিরে
প্রভাতের সাদা রেখা ফুটে ওঠার মধ্যে যথেষ্ট সময়ের অবকাশ রয়েছে। ঠিক প্রভাতের উদয়
মুহূর্তে যদি কোন ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায় তাহলে সংগতভাবেই সে তাড়াতাড়ি উঠে কিছু
পানাহার করে নিতে পারে। হাদীসে বর্ণিত
হয়েছে, রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যদি তোমাদের কেউ সেহরী খাচ্ছে এমন সময়
আযানের আওয়াজ কানে এসে গিয়ে থাকে তাহলে সংগে সংগেই সে যেন আহার সে যেন আহার ছেড়ে
না দেয় বরং পেট ভরে পানাহার করে নেয়। অনুরূপভাবে ইফতারের সময়ও সূর্য অস্ত যাওয়ার
পর অযথা দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার প্রতীক্ষায় বসে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। নবী
আল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য ডোবার সাথে সাথেই বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে
ডেকে বলতেন, আমার শরবত আনো। বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, হে আল্লাহর
রসূল! এখনো
তো দিনের আলো ফুটে আছে। তিনি জবাব দিতেন, যখন রাতের আঁধার পূর্বাকাশ থেকে উঠতে
শুরু করে তখনই রোযার সময় শেষ হয়ে যায়।
মন্তব্যঃ এটি একটি
মতভেদ পূর্ন ফিকহি মাসয়ালা। এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক মত আছে। বিতর্ক এড়িয়ে কুরআন
সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী মতামত গ্রহন করা বুদ্ধিমানের কাজ। কোনটি কুরআন সুন্নাহর
অধিক নিকটবর্তী মত যিনি তাও বুঝেন না, তিনি যে আলেন কে কুরআন সুন্নাহর অধিক
নিকটবর্তী দেখবেন তার মতামত গ্রহন করবেন। মাওলানা মওদুদীর এই মাসায়েলেন পক্ষে,
মাওলানা বশীরুজ্জামান “সত্যের আলো” নামক কিতাবে অনেক আলেমেন মতামত কোট করে
প্রমানের চেষ্টা করেছেন যে, মওদুদীর বর্ণিত মাসায়েলই সঠিক। তবে এর বিপরীত মতামতও
আছে।
০৩.
সিজদার আয়াত পড়ে বা শুনে বিনা অজুতে সিজদা প্রদান প্রসঙ্গে।
তাফহিমুল
কুরআনেন সূরা আরাফেন ২০৬ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবুল আলা মওদুদী বলেন,
কুরআন
মজীদে চৌদ্দটি স্থানে সিজদার আয়াত এসেছে। এ আয়াতগুলো পড়লে বা শুনলে সিজদা করতে হবে, এটি ইসলামী
শরীয়াতের একটি বিধিবদ্ধ বিষয়,এ ব্যাপারে সবাই একমত।তবে এ সিজদা ওয়াজিব হবার ব্যাপারে
বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা, (র) তেলাওয়াতে সিজদাকে ওয়াজিব বলেন।
অন্যান্য উলামা বলেন এটি সুন্নত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক সময়
একটি বড় সমাবেশ কুরআনে পড়তেন এবং সেখানে সিজদার আয়াত এলে তিনি নিজে তৎক্ষণাৎ সিজদা
করতেন এবং সাহাবীগণএর যিনি যেখানে থাকতেন তিনি সেখানেই সিজদানত হতেন। এমনকি কেউ
কেউ সিজদা করার জায়গা না পেয়ে নিজের সামনের ব্যক্তির পিঠের ওপর সিজদা করতেন।
হাদীসে একথাও এসেছে, মক্কা বিজয়ের সময় তিনি কুরআন পড়েন। সেখানে সিজদার আয়াত এলে
যারা মাটির ওপর দাঁড়িয়েছিলেন তারা মাটিতে সিজদা করেন এবং যারা ঘোড়ারও উটের পিঠে
সওয়ার ছিলেন তারা নিজেদের বাহনের পিঠেই ঝুঁকে পড়েন। কখনো নবী (সা) খুতবার মধ্যে
সিজদার আয়াত পড়তেন, তখন মিম্বার থেকে নেমে সিজদা করতেন তারপর আবার মিম্বরের ওপর
উঠে খুতবা দিতেন।
অধিকাংশ
আলেমের মতে নামাযের জন্যে যেসব শর্ত নির্ধারিত এ তেলাওয়াতের সিজাদার জন্যও তাই
নির্ধারিত। অর্থাৎ
অযুসহকারে কিবলার দিকে মুখ করে নামাযের সিজদার মত করে মাটিতে মাথা ঠেকাতে হবে। কিন্তু
তেলাওয়াতের সিজদার অধ্যায়ে আমরা যতগুলো হাদীস পেয়েছি সেখানে কোথাও এ শর্তগুলোর
স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। সেখান থেকে তো একথাই জানা যায় যে, সিজদার আয়াত
শুনে যে ব্যক্তি যেখানে যে অবস্থায় থাকে সে অবস্থায়ই যেন সিজদা করে - তার অযু থাক বা না থাক, কিবলামুখী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হোক বা না হোক, মাটিতে মাথা রাখার সুযোগ পাক বা না পাক তাতে কিছু আসে যায় না।
প্রথম যুগের আলেমদের মধ্যেও আমরা এমন অনেক লোক দেখি যারা এভাবেই তেলাওয়াতের সিজদা
করেছেন। ইমাম বুখারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর
(রা) সম্পর্কে
লিখেছেন, তিনি
অযু ছাড়াই তেলাওয়াতের সিজদা করতেন। কাতহূল বারীতে আবু আবদুর রহমান সুলামী সম্পর্কে
বলা হয়েছে, তিনি
পথ চলতে কুরআন মজীদ পড়তেন এবং কোথাও সিজদার আয়াত এলেই মাথা ঝুঁকিয়ে নিতেন। অযু
সহকারে থাকুন বা থাকুন এবং কিবলার দিকে মুখ ফিরানো থাক বা না থাক, তার পরোয়া
করতেন না। এসব কারণে আমি মনে করি, যদিও অধিকাংশ আলেমদের
মতটিই অধিকতর সতর্কমূলক তবুও কোন ব্যক্তি যদি অধিকাংশ আলেমের মতের বিপরিত আমল করে
তাহলে তাকে তিরস্কার করা যেতে পারে না। কারণ অধিকাংশ আলেমদের মধ্যে এমনসব লোকও পাওয়া গেছে যাদের
রীতি ছিল পরবর্তীকালের অধিকাংশ আলেমদের থেকে ভিন্নতর।
মন্তব্যঃ
০৪।
খোলা তালাক সম্পর্তে মতভেদ।
মহান
আল্লাহ এরশাদ করেন,
ٱلطَّلَـٰقُ
مَرَّتَانِۖ فَإِمۡسَاكُۢ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ تَسۡرِيحُۢ بِإِحۡسَـٰنٍ۬ۗ وَلَا
يَحِلُّ لَڪُمۡ أَن تَأۡخُذُواْ مِمَّآ ءَاتَيۡتُمُوهُنَّ شَيۡـًٔا إِلَّآ أَن
يَخَافَآ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا يُقِيمَا
حُدُودَ ٱللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡہِمَا فِيمَا ٱفۡتَدَتۡ بِهِۦۗ تِلۡكَ
حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَعۡتَدُوهَاۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ
فَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمُ ٱلظَّـٰلِمُونَ (٢٢٩)
অর্থঃ তালাক দু’বার। তারপর সোজাসুজি স্ত্রীকে রেখে দিবে অথবা ভালোভাবে বিদায় করে দেবে৷ আর তাদেরকে যা কিছু দিয়েছো বিদায় করার সময় তা থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তবে এটা স্বতন্ত্র, স্বামী-স্ত্রী যদি আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না বলে আশংকা করে, তাহলে এহেন অবস্থায় যদি তোমরা আশংকা করো, তারা উভয়ে আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করতে পারবে না, তাহলে স্ত্রীর কিছু বিনিময় দিয়ে তার স্বামী থেকে বিচ্ছেদ লাভ করায় কোন ক্ষতি নেই। এগুলো আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা, এগুলো অতিক্রম করো না৷ মূলত যারাই আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবে তারাই জালেম। (সুরা বাকারা ২:২২৯)।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফহিমুল কুরআনে বলেন, খোলা তালাকের পর স্ত্রীলোকটির জন্য ইদ্দত মাত্র এক হায়েজ বা এক ঋতুকাল। মূলত এটা কোন ইদ্দত নহে, বরং স্ত্রীলোকটি গর্ভবতী কি না তা যাচাই করার জন্যই এ ইদ্দত পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন পুনরায় অন্যত্র বিয়ে হওয়ার পূর্বে স্ত্রী লোকটি গর্ভবতী কি না সে সম্পর্কে
পূর্ন নিশ্চিত লাভ করা যায়। (তাফহিমুল কুরআন ১ম খন্ড, উত্সঃ সত্যের আলো)। অর্থঃ তালাক দু’বার। তারপর সোজাসুজি স্ত্রীকে রেখে দিবে অথবা ভালোভাবে বিদায় করে দেবে৷ আর তাদেরকে যা কিছু দিয়েছো বিদায় করার সময় তা থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তবে এটা স্বতন্ত্র, স্বামী-স্ত্রী যদি আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না বলে আশংকা করে, তাহলে এহেন অবস্থায় যদি তোমরা আশংকা করো, তারা উভয়ে আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করতে পারবে না, তাহলে স্ত্রীর কিছু বিনিময় দিয়ে তার স্বামী থেকে বিচ্ছেদ লাভ করায় কোন ক্ষতি নেই। এগুলো আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা, এগুলো অতিক্রম করো না৷ মূলত যারাই আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবে তারাই জালেম। (সুরা বাকারা ২:২২৯)।
আবুল আলা মওদুদী “স্বামী স্ত্রীর অধিকার” নামক বইয়ে এ প্রসঙ্গে বলেন,
ইসলামী শরীয়তে পুরুষের যেমন তালাক দেয়ার আইনগত অধিকার দিয়েছে। এবং সে তার এ অধিকার স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত প্রয়োগ করতে পারে। ঠিক তেমনি স্ত্রীকেও খোলা করার অধিকার দিয়েছে। পুরুষের সম্মতি ব্যতীত আদালত তার এ অধিকার আদায় করে দিতে পারে।
বাংলায় অনুদিত বাকারার এই আয়াতের বোল্ড করা অংশের ব্যাখ্যায় তাফহিমুল কুরআনের ২৫২ টিকায় লিখেন, শরীয়াতের পরীভাষায় একে বলা হয় 'খুলা' তালাক। অর্থাৎ স্বামীকে কিছু দিয়ে স্ত্রী তার কাছ থেকে তালাক আদায় করে নেয়া। এ ব্যাপারে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঘরোয়াভাবেই যদি কিছু স্থিরীকৃত হয়ে যায় তাহলে তাই কার্যকর হবে। কিন্তু ব্যাপারটি যদি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে আদালত কেবল এতটুকু অনুসন্ধান করবে যে, এই ভদ্রমহিলা তার স্বামীর প্রতি যথার্থই এত বেশী বিরূপ হয়ে পড়েছে কিনা যার ফলে তাদের দু'জনের এক সাথে ঘর সংসার করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সঠিক অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হবার পর আদালত অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোন বিনিময় নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। এই বিনিময় গ্রহণ করে স্বামীর অবশ্যি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। স্বামী ইতিপূর্বে যে পরিমাণ সম্পদ তার ঐ স্ত্রীকে দিয়েছিল তার চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বিনিময় হিসেবে তাকে ফেরত দেয়া সাধারণত ফকীহগণ পছন্দ করেননি।
'খুলা' তালাক 'রজঈ' নয়। বরং এটি 'বায়েনা' তালাক। যেহেতু স্ত্রীলোকটি মূল্য দিয়ে এক অর্থে তালাকটি যেন
কিনে নিয়েছে, তাই এই তালাকের পর আবার রুজু
করার তথা ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার স্বামীর থাকে না। তবে আবার যদি তারা পরস্পরের প্রতি
সন্তষ্ট হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়, তাহলে এমনটি করা
তাদের জন্য সম্পূর্ণ বৈধ।
অধিকাংশ ফিকাহ শাস্ত্রবিদের মতে 'খুলা' তালাকের ইদ্দতও
সাধারণ তালাকের সমান। কিন্তু আবুদ দাউদ,
তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ইত্যাদি হাদীসগ্রন্থে এমন বহুতর হাদীস উদ্ধৃত
হয়েছে যা থেকে জানা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ঋতুকালকে এর ইদ্দত গণ্য করেছিলেন। হযরত উসমান (রা) এই অনুযায়ী একটি
মামলারও ফায়সালা দিয়েছিলেন। (ইবনএ কাসীর,১ম খণ্ড, ২৭৬ পৃষ্ঠা)।
মন্তব্যঃ আবুল
আলা মওদুদী কথার সার সংক্ষেপ হলঃ
১) খোলা তালাকের পর স্ত্রীলোকটির জন্য ইদ্দত মাত্র এক হায়েজ বা এক ঋতুকাল।
২) পুরুষের সম্মতি ব্যতীত আদালত স্ত্রীও খোলা করার
এ অধিকার আদায় করে দিতে পারে।
** আলেম সমাজ
খোলা তালাকের ইদ্দতের ব্যপারে একমত নহেন। অধিকাংশ সাহবায়ে কেরাম এবং ইমাম ছাওরি,
ইমাম আহমদ ও কুফাবাসিদের কত হল খোলা
তালাকের ইদ্দতের সময় কাল তিন হায়েজ। অপর পক্ষে পক্ষে সাহবায়ে কেরাম উল্লেখ যোগ্য
অংশ মত হল খোলা তালাকের ইদ্দতের সময় কাল এক হায়েজ। এবং ইমাম ইসহাক বলেন,
কেই যদি এ মত (ইদ্দতের সময় কাল এক হায়েজ)
কে গ্রহন করে তাহলে দলিলের দিক দিয়ে এটাই
শক্তিশালি। (তিরমিজি, খোলা আধ্যায়, উত্সঃ সত্যের
আলো)।
**
ইমাম আবু হানিফা রহঃ, ইমাম আহমদ রহঃ ও ইমাম শাফেয়ী রহঃ এদের সকলেন মত হল পুরুষের সম্মতি ব্যতীত
স্ত্রী খোলা করার অধিকার নাই। এবং কোন
হাকিম বা কাজি এ অধিকার আদায় করে দিতে পারেনা। খোলা একমাত্র স্বামীর সম্মিতির উপর
নির্ভর করে নতুবা নয়। কিন্তু ইমাম মালিক, ইমাম আওজায়ী এবং ইমাম ইসহাক ভিন্নমত পোষণ
করেন।
আবুল
আলা মওদুদীসহ উপমহাদেশের
অধিকাংশ আলেমই হানাফি মাজহাব ভুক্ত। কাজেই আমরা বলতে পারি এ বিরোধপূর্ণ ফিকহি
মাসায়েল বলতে গিয়ে তিনি ব্যাপক সমালোচনার
স্বীকান হন।
০৫। মুতা বিবাহ (কনট্রাক্ট মেরিজ
বা সীমিক সময়ের জন্য চুক্তিতে বিবাহ) জায়েয, না জায়েয সম্পর্কে মওদূদীর অবস্থান।
মাওলানা মাওদূদী ১৯৫৫ মাসিক
তরজউমাতুর কুরআনে লিখেন, মানুষের অনেক সময় এমন
অবস্থার সম্মুখেন হয় যে, তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব হয় না। সে জেনা অথবা মোতার
মধ্যে কোন একটা গ্রহন করতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থা্য় তার পক্ষে জেনার চেয়ে মোতা করে
নেয়া ভাল। (তরজুমানুল কুরআন আগষ্ট ১৯৫৫ সাল সংখ্যা)।
তার এ বক্তব্য থেকে কোট করে
অনেকে বলেছেন তিনি বলেছেন মুতা বিবাহ জায়েয মনে করেন।
তার এ কথার প্রতিবাদ উঠলে তিনি
এর তিন মাস পরে তরজুমানুল কুরআন নভেম্বর ১৯৫৫ সাল সংখ্যায় ব্যাপারটি পরিস্কার
করেন। যা হুবহু তাফহিমুল কুরআনের সূরা মুমিনূনের ৫-৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যার সাত
নম্বর টিকায় উল্লেখ করেন।
মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِفُرُوجِهِمۡ حَـٰفِظُونَ
(٥) إِلَّا عَلَىٰٓ أَزۡوَٲجِهِمۡ أَوۡ مَا
مَلَكَتۡ أَيۡمَـٰنُہُمۡ فَإِنَّہُمۡ غَيۡرُ مَلُومِينَ (٦) فَمَنِ ٱبۡتَغَىٰ وَرَآءَ ذَٲلِكَ
فَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمُ ٱلۡعَادُونَ (٧)
অর্থঃ নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, নিজেদের স্ত্রীদের ও অধিকারভুক্ত বাঁদীদের ছাড়া, এদের কাছে (হেফাজত না করলে) তারা তিরষ্কৃত হবে না, তবে যারা এর বাইরে আরো কিছু চাইবে তারাই হবে সীমালংঘনকারী। (সুরা
মুমিনূন ৫-৭)।মোওদূদী কৃত ব্যাখ্যঃ কোন কোন মুফাসসির মুতা' বিবাহ হারাম হবার বিষয়টিও এ আয়াত থেকে প্রমাণ করেছেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যে মেয়েকে মুতা' বিয়ে করার হয় সে না স্ত্রীর পর্যায়ভুক্ত, না বাঁদীর। বাঁদী তো সে নয় একথা সুস্পষ্ট, আবার স্ত্রীও নয়। কারণ স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করার জন্য যতগুলো আইনগত বিধান আছে তার কোনটাই তার ওপর আরোপিত হয় না। সে পুরুষের উত্তরধিকারী য় না, পুরুষও তার উত্তরাধিকারী হয় না। তার জন্য ইদ্দত নেই, তালাকও নেই, খোরপোশ নেই এবং ঈলা, যিহার ও লি'আন ইত্যাদি কোনটিই নেই। বরং সে চার স্ত্রীর র্নিধারিত সীমানার বাইরে অবস্থান করছে কাজেই সে যখন ''স্ত্রী'' ও ''বাঁদী'' কোনটার সংজ্ঞায় পড়ে না তখন নিশ্চয়ই সে 'এর বাইরে আরো কিছু'র মধ্যে গণ্য হবে। আর এ আরো কিছু যারা চায় তাদেরকে কুরআন সীমালংঘনকারী গণ্য করেছে। এ যুক্তিটি অনেক শক্তিশালী। তবে এর মধ্যে একটি দূর্বলতার দিকও আছে। আর এ দূর্বলতাটি হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুতা' হারাম হবার শেষ ও চূড়ান্ত ঘোষণা দেন মক্কা বিজয়ের বছরে। এর পূর্বে অনুমতির প্রমাণ সহী হাদীসগুলোতে পাওয়া যায়। যদি একথা মেনে নেয়া যে, মুতা' হারাম হবার হুকুম কুরআনের এ আয়াতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল আর এ আয়াতটির মক্কী হবার ব্যাপারে সবাই একমত এবং এটি হিজরতের কয়েক বছর আগে নাযিল হয়েছিল, তাহলে কেমন করে ধারণাকরা যেতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয় পর্যন্ত একে জায়েয রেখেছিলেন৷ কাজেই একথা বলাই বেশী নির্ভূল যে, মুতা' বিষয়ে কুরআন মজীদের কোন সুস্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যেম নয় বরং নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের মাধ্যমেই হারাম হয়েছে। সুন্নাতের মধ্যে যদি এ বিষয়টির সুস্পষ্ট ফায়সালা না থাকতো তাহলে নিছক এ আয়াতের ভিত্তিতে এর হারাম হোয়ার ফায়সালা দেয়া কঠিন ছিল।
মুতা'র আলোচনা যখন এসে গেছে তখন আরো দু'টি কথা স্পষ্ট করে
দেয়া সংগত বলে মনে হয়।
একঃ এর হারাম হওয়ার বিষয়টি স্বয়ং
নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেই প্রমাণিত। কাজেই হযরত উমর (রা) একে হারাম করেছেন, একথা বলা ঠিক নয়। হযরত উমর (রা) এ বিধিটির প্রবর্তক বা রচয়িতা ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন কেবলমাত্র এর প্রচারক
ও প্রয়োগকারী। যেহেতু
এ হুকুমটি রসূলূল্লাহ
(সা) তার আমলের শেষের দিকে দিয়েছিলেন এবং সাধারণ
লোকদের কাছে এটি পৌছেনি তাই হযরত উমর (রা) এটিকে সাধারণ্যে প্রচার ও আইনের সাহায্য কার্যকরী করেছিলেন।
দুইঃ শীয়াগণ মুতা'কে সর্বতোভাবে ও শর্তহীনভাবে
মুবাহ সাব্যস্ত করার যে নীতি অবলম্বন করেছেন কুরআন ও সুন্নাতের কোথাও তার কোন অবকাশই
নেই। প্রথম যুগের সাহাবা, তাবেঈ ও ফকীহদের মধ্যে
কয়েকজন যারা এর বৈধতার সমর্থক ছিলেন তারা শুধুমাত্র অনন্যেপায় অবস্থায় অনিবার্য পরিস্থিতিতে
এবং চরম প্রয়োজনের সময় একে বৈধ গণ্য করেছিলেন। তাদের একজনও একে বিবাহের মতো শর্তহীন
মুবাহ এবং সাধারণ অবস্থায় অবলম্বনযোগ্য বলেননি। বৈধতার প্রবক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী
উল্লেখযোগ্য হিসেবে পেশ করা হয় হযরত ইবনে আব্বাসের (রা) নাম। তিনি নিজের মত এভাবে ব্যক্ত করেছেন, “এ হচ্ছে মৃতের মতো,
যে ব্যক্তি অনিবার্য ও অনন্যোপায় অবস্থার শিকার হয়েছে তার ছাড়া আর কারোর
জন্য বৈধ নয়”।
আবার তিনি যখন দেখলেন তার এ বৈধতার
অবকাশ-দানমূলক ফতোয়া থেকে লোকেরা অবৈধ স্বার্থ উদ্ধার করে যথেচ্ছভাবে মুতা'
করতে শুরু করেছে এবং তাকে প্রয়োজনের সময় পর্যন্ত মুলতবী করছে না তখন
তিনি নিজের ফতওয়া প্রত্যাহার করে নিলেন।
ইবনে আব্বাস ও তার
সমমনা মুষ্টিমেয় কয়েকজন তাদের এ মত প্রত্যাহার করেছিলেন কিনা এ প্রশ্নটি যদি বাদ দেয়াও
যায় তাহলে তাদের মত গ্রহণকারীরা বড় জোর "ইযতিহার''তথা অনিবার্য
ও অন্যন্যেপায় অবস্থায় একে বৈধ্য বলতে পারেন। অবাধ ও শর্তহীন মুবাহ এবং প্রয়োজন
ছাড়াই মুতা' বিবাহ করা এমন কি বিবাহিত স্ত্রীদের উপস্থিতিতেও মুতা-বিবাহিত স্ত্রীদের সাথে যৌন সম্ভোগ করা এমন একটি সেচ্ছাচার যাকে সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ন
রুচিবোধও কোনদিন বরদাশত করেনা। ইসলামী শরীয়াত ও রসূল বংশোদ্ভূত ইমামদেরকে এর সাথে জড়িত মনে
করার তো কোন প্রশ্নই উঠে না। আমি মনে করি, শীয়াদের মধ্য থেকে কোন ভদ্র ও রুচিবান ব্যক্তিও
তার মেয়ের জন্য কেউ বিবাহের পরিবর্তে মুতা'র প্রস্তাব দেবে এটা
বরদাশত করতে পারেনা। এর অর্থ এ দাড়ায় যে, মুতা'র বৈধ্যতার জন্য
সমাজে বারবনিতাদের মতো মেয়েদের এমন একটি নিকৃষ্ট শ্রেণী থাকতে হবে যাদের সাথে মুতা'
করার অবাধ সুযোগ থাকে। অথবা মুতা' হবে শুধুমাত্র গরীবদের
কন্যা ও ভগিনীদের জন্য এবং তা থেকে ফাইদা হাসিল করার অধিকারী হবে সমাজের ধনিক ও সমৃদ্ধশালী
শ্রেণীর পুরুষেরা। আল্লাহ
ও রসূলের শরীয়াত থেকে কি এ ধরনের বৈষম্যপূর্ন ও ইনসাফবিহীন আইনের আশা করা যেতে পারে৷
আবার আল্লাহ ও তার রসূল থেকে কি এটাও আশা করা যেতে পারে যে, তিনি এমন কোন কাজকে
মুবাহ করে দেবেন যাকে যে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে নিজের জন্য অমর্যাদাকর এবং
বেহায়াপনা মনে করে৷
মন্তব্যঃ
তার সম্পুর্ন ব্যাখ্যা পড়লে অভিযোগের সত্যতা মিলবে না। কাজেই কোন আলেম ওয়ালামাদের
সম্পর্কে অভিযেগর আগে বিষয়টি খতিয়ে দেখা জরুরি, তা না হলে আমদের একটা ভুলেন জন্য
হাজার হা্জার মুসলিম ভ্রান্ত হয়ে যাবে। যার দ্বায়ভার আমাদেরই নিতে হবে। আর
কিয়ামতের কঠিন ময়দানে মহান আল্লাহর কাছে জবাব দিহিতো আছেই। কাজেই প্রতিটি কাজের
জন্য মহান আল্লাহর কে ভয় করা উচিৎ।
৬।
আল্লাহে আইন জেনা শাস্তি কে জুলুম বলার অপবাদ।
তিনি তার তাফহীমুল কুরআনে আল্লাহ প্রদত্ত রজম বা বিবাহিত নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হলে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলার শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রে বলেন,
“যে ক্ষেত্রে নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, সে ক্ষেত্রে যেনার কারণে (আল্লাহ পাকের আদেশকৃত) রজম শাস্তি প্রয়োগ করা নিঃসন্দেহে জুলুম।” (নাঊযুবিল্লাহ) (তাফহীমাত, ২য় খণ্ড, ২৮১ পৃষ্ঠা, মিস্টার মৌদূদির নিউ ইসলাম)।
যারা কুরআনের আইন
কে বর্বরোচিত আইন বলে আখ্যায়িত করে তাদের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি ১৯৩৯ সালের মার্চ
মাসের মাসিক তরজুমানুল কুরআসনে এক দীর্ঘ আলোচনা রাখেন। যা পর্বতিতে তাফহিমুল
কুরআনের ২য় খন্ডে “হাত কাটা ও শরয়ী শাস্তি” শিরোনামে সন্নিবেশিত করা হয়।
মাওলানা মোওদূদী
(রহঃ) তার লেখায় বলেনঃ সর্ব প্রথম এ সামগ্রিক নীতিমালাটি ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার
যে, হাত কর্তনের শাস্তি এবং অন্যান্য শরয়ী শাস্তি এমন স্থানে কার্যকর করার জন্য
নিদির্ষ্ট করা হয়েছে যেখানে রাষ্ট্রের আইন কানুন ও বিধি বিধান ইসলামে সমর্থিত
পন্থায় পরিচালিত। ইসলামের মুলনীতি ও আইন কানুন পরস্পর অবীন্ন ও অবিচ্ছেদ্য। এটা
মোটেই পরিশুদ্ধ নয় যে,
কিছু সংখ্যক মুলনীতি ও বিধি বিধান কার্যকর হবে আর কিছু সংখ্যক পরিত্যাজ্য রাখা
হবে। উদাহরন সরূপ ব্যভিচারী ও মিথ্যা অপবাদকরীর শাস্তি ধরা যেতে পারে। বিয়ে, তালাক এবং শরয়ী পর্দার ব্যপারে ইসলামি আইন কানুন এবং যৌনগত চরিত্রের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা উল্লেখিত শাস্তির সাথে গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ব্যভিচারি ও মিথ্যা অপবাদকারীর জন্য এরকম কঠোর শাস্তি শুধুমাত্র ঐ সামাজের উদ্দেশ্যেই নির্ধারিত করেছেন, যে সমাজে মহিলারা সাজসজ্জা ও আকর্ষণীয় অবস্থায় চলাফেরা করে না। যে সমাজে উলংগ-অর্ধ উলংগ ছবি এবং প্রেম প্রীতির কিচ্চা কাহিনী ও যৌন উত্তেজনাকে সর্বদা সঞ্চারিত ও আন্দোলিত করার মত কোন রং-তামাসা প্রচলণ নেই, যেখানে বিয়ের জন্য পূর্নসহজতা বিরাজমান, এ ছাড়া যেখানে বিয়ে বিচ্ছেদ, তালাক ও খোলা তালাক সম্পর্কিত ইসলামি আইন কানুন সঠিকভাবে কার্যকর। স্বাভাবিক নিয়মানিযায়ী এমন ভারসাম্যপূর্ণ ইসলামি আইন কানুন প্রতিষ্ঠত সমাজই এর পূর্ণ দাবিদার যে, এখানে তার সংরক্ষন ও হেফাজতের জন্য কঠিন শাস্তি নির্দিষ্ট করা হোক। এ ছাড়া যখন জায়েয পন্থায় যৌনগত আকাঙ্খা চরিতার্থ করা সুযোগ করে দেয়া হয়েছে এবং সামাজিক অবস্থাকে দুষ্টামীর সহজাতও অসাধানণ উত্তেজনাপূর্ণ মাধ্যমগুলো থেকে পবিত্র করে দেয়া হয়েছে, তখন এ অবস্থায় এত বড় শাস্তি কোন ক্রমেই বেইনসাফী নয়। এ অবস্থায় যৌন অপরাধ শুধুমাত্র যেমন লোকের দ্বারা সম্ভব, যারা সীমাতিরিক্ত খারাপ স্বভাবের এবং যাদের ব্যতীত গত্যস্তর নেই।
তিনি আরও বলেন,
কিন্তু যেখানকার অবস্থা এর থেকে ভিন্নতর যেখানে নর নারীর সমাজ সহাবস্থানে রাখা হয়েছে, যেখানে স্কুল. কলেজ, অফিস আদালত, ক্লাব ও পার্কে যুবক যুবতীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, উঠাবসা ও মেলামেশার অবাধ সুযোগ রয়েছে। যেখানে চারদিকে যৌন উত্তেজনা ও সুড়সুড়ীপূর্ণ মাধ্যম বিস্তৃত এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ব্যতীত যৌন উত্তেজনা প্রশমনের সকল প্রকান সুযোগ বিরাজমান এবং যেখানে চারিত্রক মানদন্ড এতই নিম্মস্তরের যে, অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনকে দোষনীয় মনে করা হয় না। এমন স্থানে ব্যভিচার ও মিথ্যা অপবাদের জন্য শরয়ী শাস্তি কার্যকর করা নিঃসন্দেহে জুলুম। কারন এমন সমাজে সাধারণ প্রকৃতি, মধ্যম চরিত্র এবং পরিশুদ্ধ মস্তিস্কপূর্ণ ব্যক্তি পক্ষেও ব্যভিচার থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। আর এমতবস্থা কোন অপরাধে লিপ্ত হোওয়ায় এ ফলাফল বের করার জন্য যথেষ্ট নয় যে, এ ব্যক্তি অস্বাভাবিক ধরনের চারিত্রিক দোষে দোষী। রজম এবং বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রকৃত পক্ষে এ রকম দুর্গন্ধময় সামাজের জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট করেননি।
মন্তব্যঃ অনেকে তার এই কথাকে পুর্বাপর উল্লেখ না করে শুধু “যে ক্ষেত্রে নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, সে ক্ষেত্রে যেনার কারণে রজম শাস্তি প্রয়োগ করা নিঃসন্দেহে জুলুম’’ এতটুকু উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, আল্লাহর বিধান জেনার শাস্তি রজম এবং বেত্রাঘাত প্রয়োগ করাকে মওলানা মওদূদী জূলুম বলেছেন। কেউ কেউ সরাসরি এমন লিখেন মওলানা মওদূদী দৃষ্টিতে আল্লাহ তায়ালা জুলুম করেছেন। (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ প্রথমত তিনি আল্লাহকে জুলুমকারী বলেন কি। তিনি আইন প্রয়োগকারীদের বলেছেন। তা ছা্ড়া বাকি লেখাটা তার নিজস্ব একটা ইজতে হাত।
৭। দুই সহোদর বোন কে একসাথে বিবাহ করা জায়েয প্রসঙ্গে।
মওলানা মওদূদী উপর আর একটা অভিযোগ হল, তিনি সহোদর বোনকে একসাথে বিয়ে করা জায়েয বলেছেন। অথচ মাহান আল্লাহ একাজ কে কুরআনে হারাম বলেছেন।
আসল ব্যপার হল মওলানা মওদূদীতকে জনৈক ব্যক্তি একদেহীভুত যমজ দুই মেয়ের বিবাহ সম্পর্কে প্রশ্নে করেন তারই উত্তর দিতে গিয়ে তিনি উক্ত মন্তব্য করেন। তা হলে প্রশ্ন উত্তরের পর্বটা দেখে নেওয়া যাক।
প্রশ্নঃ বাহোওয়ালপুরে দুটি একদেহীভুত যমজ বোন আছে, জম্মলগ্ন থেকে যাদের কাঁধ, পার্শ্বদেশ ও কোমলরের হাড় জোড়া ছিল। কোনক্রমেই তাদেরকে আলাদা করা সম্ভব ছিল না। জম্মের পর থেকে এখন যৌবনে পদার্পণ পর্যান্ত তারা চলাফেরা করছে। তাদের একই সঙ্গে ক্ষুদা লাগে একই সঙ্গে পেশাব পায়খানবর প্রোয়জন হয়। এমন কি তাদের একজন কোন রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে অন্যজনও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এখন প্রশ্ন হল, এক জন পুরুষের সাথে তাদের দু বোনের বিয়ে হতে পারে কি না? স্থানীয় আলেমগন একজনের পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে আপত্তি করেন। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি?
তিনি উত্তরে বলেনঃ এ মেয়ে দুটির ব্যাপারে চারটি পন্থা অবলম্ভন করা যেতে পারে।
১. দুজনের বিয়ে দুটি পৃথক পৃথক পুরুষের সাথে দেয়া যেতে পারে।
২. তাদের এক জন কে কোর পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়া যেতে পারে এবং অন্য জনকে বঞ্চিত করা যেতে পারে।
৩. দুজনের বিয়ে একজন পুরুষের সাথে দেয়া যেতে পারে।
৪. দুজনকে চিরকালের জন্য বিয়ে থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে।
এর মধ্যে প্রথম দুটি এমন সুষ্পষ্ট অবৈধ, অযৌক্তিক ও অবাস্তব যে, এর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি ও প্রমানের অবতারণা কারার প্রয়োজন নেই। এখন শেষ পন্থা দুটি সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। এ পন্থা বাস্তবানিগ। কিন্তু এ দুটির একটি পন্থা সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন যে, যেহেতু এর ফলে একই সময়ে দুই সহদরকে বিয়ে করা হয় এবং কুরআনে এটিকে হামাম করা হয়েছে, তাই অবশ্য সর্বশেষ পন্থাটিকে কার্যকর করতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে ওলামাদের এ কথাটি যথার্থ মনে হয়। কারন মেয়ে দুটি যমজ বোন এবং কুরআনে সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যার্থহীন ভাষায় একই সময়ে দুই বোন কে বিয়ে করা হারাম গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু এখানে দুটি প্রশ্ন দেখা দেয়।
১. এ মেয়ে দুটিকে চিরকাল যৌন সম্পর্ক রহিত এবং বিয়ে থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য করা কি জুলুম নয়?
২. এ দুটি মেয়ে জম্মগতভাবে যে বিশেষ ও আস্বাভাবিক অবস্থার সাথে জড়িত, কুরআনে এ হুকুম কি সত্যিই তাদের সাথে সম্পৃক্ত?
আমার মনে হচ্ছে , আল্লাহ তায়ালার এ ফরমানটি এ বিশেষ অবস্থাটির জন্যে নয়, বরং যে সাধারণ অবস্থায় দুটি বোন জম্মগ্রহণ করে সেই অবস্থার জন্যে এ ফরমানটি প্রদত্ত হয়েছে। এবং সাধারণ অবস্থায় যদি এক ব্যক্তি একই সময় দু সহদর বোনকে বিয়ে করে তাহলে এ নির্দেশ অমান্য করা হবে, নতুবা নয়। আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হচ্ছে, তিনি সাধারণ অবস্থার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন এবং বিশেষ ও অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য নির্দেশ না দিয়ে সামনে অগ্রসর হন। এ ধরনের অবস্থার সম্মখীন হলে সাধারণ নির্দেশ অবিকল তার উপর প্রয়োগ করার পরিবর্তে নির্দেশের রূপকল্পটি বাদ দিয়ে তার উদ্দেশ্যকে সঙ্গত পদ্ধতিতে পূর্ণ করাই ফিকহি জ্ঞানের পরিচায়ক।
মন্তব্যঃ আশ করি বিষয়টি পরিস্কার। যারা প্রথমে সমালোচনা করেছেন তারা আমানতের খেয়ানত করেছেন। পরবর্তিতে যারা তাদের রেফারেন্সে বলেছেন বা লিখেছেন তারা ভুল করেছেন। সেই সাথে তাহকিক না করার অপরাধে তারাও অপরাধী এবং মাওলানা মওদূদীর (রহঃ) প্রতি জুলুম করেছেন
৮। অনেকে বিভিন্ন লেখান অভিযোগ করে থাকেন মাওলানা মওদূদী (রহঃ) সিনেমা দেখাকে জায়েয বলেছেন।
মাওলানা মওদূদী (রহঃ) সিনেমা দেখা জায়েয বলেছেন ঠিকই কিন্তু প্রচলিত সিনেমা বলতে যা বুজায় তাকে নয়। তাকে জনৈক ছাত্র সিনেমা দেখা সম্পের্কে প্রশ্ন করে যা ১৯৫২ সালের আগষ্ট মাসে তরজমানুল কুরআনে প্রকাশিত হয়। আশ করি প্রশ্ন উত্তরটি দেখলে ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্নঃ আমি একজন ছাত্র। জামায়াতে ইসলামীর বইপত্র আমি সব পড়েছি। আল্লাহর ফজলে এর ফলে আমার চিন্তা ও কর্মের মধ্যে সুষ্পষ্ট বৈপ্লবিক পরিবর্তণ সাধিত হয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফীর ব্যাপারে আমি বহু দিন ধরে বিপুল আর্কষণ অনুভব করছি। এ সম্পর্ক অনেক তথ্য ও সংগ্রহ করেছি। আমার চিন্তা ও মতবাদের মধ্যে পরিবর্ত আসার পর আমি শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্ভব হলে এ শিল্পটাকে দ্বীনি ও নৈতিক ক্ষেত্রে কাজে লাগবার আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করে। মেহের বানী করেও ইসলামে এর কোন অবকাশ আছে কিনা জানাবেন। জবাব যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে চলচ্চিত্রের পর্দায় নারীর ভুমিকা দেখাবার কোন জায়েয পদ্দতি সম্ভবপর কিনা তাও জানাবেন।
উত্তরঃ ইতিপূর্বে কয়েকবার আমি এ অভমত ব্যক্ত করেছি যে, সিনেমা আসলে কোন না জায়েয বস্তু নয়। তবে তার নাজায়েয ব্যবহার তাকে নাজায়েয করে দেয়। সিনেমার পর্দায় যে সকল ছবি দেখান যায় তা আসলে ছবি নয় বরং পরছায়া, যেমন আয়নার মধ্যে পরছায়া দেখা যায়। কাজেই তা হারাম নয়। ফিল্মের মধ্যে যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, তা যতক্ষন না কোন কাগজ বা অন্য কোন জিনিসের উপর ছেপে নেয়া না হয়, ততক্ষন তাকে ছবি বলে আখ্যা দেয়া যায় না। তাকে তেমন কোন কাজে ব্যবহার করাও যেতে পারে না যা থেকে বিরত থাকান জন্যই শরীয়তে ছবিকে হারাম গন্য করা হয়েছে। এ সব কারনে আমার মতে সিনেমা আসলে মুরাহ।
এবার এ শিল্পটি শেখার ব্যাপারে বলা যায়, এ ক্ষেত্রে এমন কোন কারণ নেই যার ভিত্তিতে আপনাকে এ থেকে বিরত থাকতে বলব। এ ব্যাপারে আগ্রহ থাকলে আপনি এটা শিখতে পারেন। বরং ভালো ও কল্যান মুলক কাজে একে ব্যবহার করার নিয়ত থাকলে অবমশ্যই এটাকে আয়ত্ব করে ফেলুন। কারন এটা আল্লাহর বিভিন্ন শক্তির অন্তরগত একটা বড় শক্তি। আমরা অন্যান্য প্রাকুতিক শক্তিগোলোন সাথে একেও সত্যের সেবা ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাই। আল্লাহ যতগুলি জিনিস সৃষ্টি করেছেন সবই মানুষের কল্যাণে ও সত্যের সেবার উদ্দেশ্যে পয়দা করেছেন। এর চাইতে বড় দুর্ভাগ্য কি হতে পারে যে, শয়তানের দোসরা একে শয়তানী কাজে খুব ভালভাবে ব্যাবহার করছে আর আল্লাহর বান্দারা একে আল্লাহর কাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছে।
ফিল্মকে ইসলামি োও কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার ব্যাপারে বলা যেতে পারে যে, অশ্লীলতা, নগ্নতা, অপরাধপ্রবনা ওযৌন আবেদন মুক্ত চিত্র এবং সততা, সৎবুত্তি ও কল্যাণ কামিতার শিক্ষা দেয়াই যে সব চিত্রের আসল উদ্দেশ্য তেমন ধরনের কোন সামাজিক, নৈতিক, সংস্কারমুলক ঐতিহাসিক চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে বাহ্যত কোর দোষ দেয়া যায় না। কিন্ত গভিরভাবে পর্যবেক্ষন করলে এর মধ্যে বড় বড় দুটি দোষ দেখা যায়। এ দোষ দুটির সশোধন কোনক্রমেই সম্ভব নয়।
১. নারীর চরিত্র বিবর্জিত কোন সামাজিক চিত্র নির্মাণ করা আত্যন্ত কঠিন কাজ। আর চিত্রের মধ্যে নারী চরিত্র রাখতে হলে দুটি অবস্থায় সম্ভবপর। একটি হচ্ছে, এ চিত্রে নারীই অভিনয় করবে আর দ্বীতীয়টি হচ্ছে, নারীর ভুমিকায় কোন পুরুষ অভিনয় করবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এর কোনটিই জায়েয নয়।
২. কোন সামাজিক নাটক ছাড়া সঞ্চায়িত হতে পারেনা। আর অভিনয়ের মধ্যে একটি বিরাট নৈতিক ত্রুটি ও ক্ষতি রয়েছে। অভিনেতা দিনের পর দিন বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে করতে অবশেষে নিজের ব্যক্তিগত চনিত্র সম্পূর্ণ না হলেও বেশীরভাগ হারিসে বসে। এভাবে চরচ্চিত্রায়িত নাটকগুলোকে আমরা সমাজ সংস্কার ও ইসলামী শিক্ষার প্রচার প্রসারে ব্যয় করতে চাইলেও সেখানে অবশ্যই আমাদের এক দল লোককে এ উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে তৈরি করতে হবে। তারা অভিনেতার পেশা গ্রহণ করে নিজেদের ব্যক্তিগত চরিত্র বিসর্জণ দিতে প্রস্তত হবে। অর্থাৎ অন্য কথায় বলা যায়, তারা নিজেদেন ব্যক্তিত্বকে কোরবান করে দিবে। আমি জানিনা, সমাজের কল্যাণেন স্বার্থে অথরা অন্য কোন পবিত্রতর ও উন্নততর স্বার্থে কোন মানুষের কাজ থেকে তার ব্যক্তিত্বকে কোরবানী বা বিসর্জণ দেবার দাবি কেমন করে করা যেতে পারে। ধন, প্রান, আরাম আয়েশ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতি প্রত্যেকটি বস্তুই কোরবান করা যেতে পারে এবং পবিত্রতর ও উন্নততর উদ্দেশ্যে এগুল কোরবানী করা উচিৎ। কিন্তু পূর্বোক্ত কোরবানীটি অন্য কারোর জন্য দাবী করা তো দুরের কথা আল্লাহ নিজের জন্য ও নিজে দাবি করেনি।
এসব কারনে আমার মতে সিনেমা শক্তিকে চলচ্চিত্রয়িত নাটকের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে না।তারপর প্রশ্ন দেখা দেয় এ শক্তিটিকে আর কোন কাজে ব্যয় করা যেতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমার জবাব হচ্ছে, নাটক ছাড়া আরও বহু বিষয় রয়েছে যেগুল ফিল্মে দেখা যেতে পারে। নাটকের তুলনায় এগুলি আনেক বেশী উপকারী ও কল্যাণমুখিও। যেমনঃ
ভৌগোলিক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা দেশের মানুষকে পৃথিবীর এবং এর বিভিন্ন অংশের ও এলাকার অবস্থান এমন ব্যাপক ও বিস্তারিত জ্ঞান দান করতে পারি যার ফলে মনে হবে যেন তারা সারা দুনিয়া সফর করে এসেছে। অনুরুপ ভাবে আমরা বিভিন্ন জাতির ও বিভিন্ন দেশের জনগনের জীবনের অসংখ্যা দিক তাদের সামনে তুলে ধরতে পারি। যা থেকে তারা অনেক শিক্ষা গহণ করতে পারবে এবং তাদের দৃষ্টি ভংগি হয়ে উঠবে ব্যাপকতর।
সৌর বিজ্ঞানের অদ্ভুত বিস্ময়কর আবিস্কার ও পর্যবেক্ষেণগুল আমরা এমন আর্কষণীয় পদ্দতিতে তুল ধরতে পারি যা একরার দেখার পর লোকেরা যৌন আবেদনমূলক ফিল্মের কথা ভুলে যাবে। আবার এ ফিল্মগুলি এত বেশী শিক্ষণীয় করা যেতে পারে যার ফলে মানুষের মনে তাওহীদ ও আল্লাহর ভয় চিরকালের জন্য দাগ কেটে বসে যাবে।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগকে আমরা সিনেমার পর্দায় এমনভাবে পেশ করতে পারি যার ফলে জনগণ তার মধ্যে বিপুল আকর্ষণ অনুভব করবে এবং তাদের বিজ্ঞানের জ্ঞান আমাদের দেশের লোকদেরকে বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটের পর্যায়ে উন্নীত করবে।
আমরা পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য রক্ষা ও নাগরিক দায়িত্বের শিক্ষা দিতে পারি বড়ই আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে। এর ফলে আমাদের গ্রামীণ ও শহুরে জনগনের তথ্য জ্ঞানের পরিসরই কেবল বেড়ে যাবে না বরং তারা পৃথিবীতে মানুষের মত বাচতে শিখবে। এ প্রসঙ্গে দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোর ভাল ভাল ও প্রয়োজনীয় নমুনাও আমরা লোকদের দেখাতে পারি। এ সব থেকে তারা নিজেদের ঘর গৃহস্থালী, পল্লী ও সমাজ জীবনকে সুষ্ঠু ও সুশৃংখভাবে পরিচালিত করার শিক্ষা পাবে।
সিনেমার মাধ্যমে আমরা বয়স্ক শিক্ষার কাজ ও হাতে নিতে পারি। এ কাজটিকে আমরা এত বেশী আকর্ষণীয় করতে পারি যার ফলে অশিক্ষিত জনতা আর ঝামেলা মনে করবে না।
এর মাধ্যমে আমরা জনগণকে যুদ্ধ শিক্ষা দিতে পারি, সিভিল ডিফেন্স, গেরীলা যুদ্ধ, শহরের পথে ঘাটে ও গলিতে প্রতিরক্ষামূলক ও বিমান আক্রামণ থেকে প্রতিরক্ষার এমন শিক্ষা দিতে পারি যার ফলে নিজের দেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে তারা স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া স্থল, বিমান ও নৌযুদ্ধের যথার্থ চিত্রও তাদের সামনে তুলা ধরা যেতে পারে।
এ ধরনের আরো বিভিন্ন ক্ষেত্র সিনেমাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু প্রথম অবস্থায় রাষ্ট্রীয় শক্তি ও তার উপায় উপকরণ এর পেছনে না থাকলে এর মধ্যে কোনটাই সফলকাম হতে পারে না। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে প্রেম ও যৌন আবেদনমূলক চলচ্চিত্রগুল প্রথমেই বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এ মাদক নেশা জবরদস্তি না ছাড়াতে পারলে অন্য কোন পানীয় তাদের মুখে রুচবেনা। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনটি হচ্ছে প্রথম অবস্থায় শিক্ষামূলক ও কল্যাণধর্মী ফিল্ম নির্মাণ করতে হবে। তারপর যখন ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ফিল্ম সফলকাম হবে, তখনই বেসরকারী পুজি এগিয়ে আসবে। (তরজমানুল কুরআন আগষ্ট ১৯৫২)।
মন্তব্যঃ ফতোয়াতি আমার কাছে খুবই যুগোপযোগী মনে হয়েছে। পূর্বাপর উল্লেখ না করে শুধু এতটুকু বলা যে, মাওলানা মওদূদী (রহঃ) সিনেমা দেখাকে জায়েয বলেছেন। তাহলে আমার মতে আমানতের খেয়ানত হবে। সেই সাথে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাধ রটানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।
0 Comments
Thanks for your comment