আহলে হাদিস
আহলে হাদিস
উপমহাদেশে যতগুলি খাঁটি ইসলামি দল আছে তাদের মধ্যে আহল হাদিস অন্যতম,
যদিও তাদের অনুসারী কারও কারও মাঝে কিছু বাড়াবাড়ি লক্ষ করা যায়। সাধারনত দেওবন্দী
বা জামাতে ইসলামি তাদের পূর্ব সুরিদের আকিদা বিশ্বাসের উপর অটল থাকে। কিন্তু আহলে
হাদিস কুরাআন সুন্নার দলিল উপস্থাপন করলে পূর্ব সুরিদের আকিদা বিশ্বাস ত্যাগ করে
কুরাআন সুন্নার ভিত্তিক আকিদা গ্রহন করে, যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে। উপমহাদেশে
হানাফি মাযহাবের অনুসারিদের তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই কম।
আহলে হাদীস
বা আহল-ই-হাদীস একটি
ফার্সি শব্দ যার শাব্দিক অর্থ হল হাদিসের অনুসারী। আরবিতে তার
প্রতিশব্দ হল আসহাবুল হাদীস। আল কুরাআনে সুরা যুমার –এ (৩৯:২৩) আল্লাহ তায়াল নিজেই হাদিস
শব্দটি উল্লেখ করেছেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা হাদীস এর শব্দিক অর্থ তার বাণী বা
কুরআন কে বুঝিয়েছেন।
সাধারনত মুসলিমগন রাসূল (সাঃ) এর বাণী কে হাদীস বলে থাকে। অপর পক্ষে আহল শব্দটিও ফার্সি,
যার অর্থ অনুসারী (আরবি আহল অর্থ বংশধর)। মুলত মাযহাবের অনুসরণের বিরোধীতা করে, সরাসরি হাদিসের অনুসরন
করতে গিয়ে আহলে হাদীস নাম ধারন করে।
পারিভাষিক
অর্থঃ উপমহাদেশে যারা কুরআন এবং ছহীহ
হাদীসের নিরপেক্ষ অনুসারী বলে দাবি করে, তারাই নিজেদের আহলে হাদিস হিসাবে পরিচয়
দান করে। তারা আহলে হাদিস পরিচয় দিলেও তাদের বিরুদ্ধবাদীদের কেউ কেউ তাদের
ল-মাযহাবি বা গাইরে মুকাল্লিদ বলে থাকে। বাংলাদেশে কোথাও কোথাও তারা মুহাম্মদী বা
রফাইদানি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে তাদের ওয়াহাবি বলে চিহ্নিত করা হত। বর্তমানে কিছু কিছু আহলে হাদিস অনু্সারী, তাদের নিজেদের
কে সালাফি বলে পরিচয় দিচ্ছে।
সাধারনত জনগন আহলে হাদিস বলতে বুঝে, যারা কোন একক মাযহাবের
তাকলিদ করে না। রাসূল সাঃ এর ওফাতের বহু পরে প্রতিষ্ঠিত চার মাযহাব কোনটিকে একক
ভাবে অনুসরন করে না। সুফিবাদ ও শিয়া মতবাদের কঠোর
বিরোধিতা করে। তাদের সালাত আদায়ের পদ্ধতি প্রচলিত মাযহাবের নামায পড়ার পদ্ধতি
থেকে কিছুটা ভিন্ন। তারা নামাজে দন্ডায়মান অবস্থায় বুকে হাত বাঁধেন,
প্রথম দুই রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সজোরে আমিন বলেন, রুকু
যাওয়ার সময় ও রুকু থেকে উঠার সময় রফউল ইয়াদাইন (হাত উঠায়) করে থাকেন এবং তারা
নামায শেষে ইমামের নেতৃত্বে সম্মিলিত মোনাজাত করেন না। প্রচলিত মিলাদ কিয়ামের কঠোর
বিরোধীতা করে। শবে বরাত ও শবে মিরাজ পালন করে না। কোন প্রকারের খনম আদায় করে না
বরং এর বিরোধীতা করে থাকে ইত্যাদি।
তাদের আকিদা বিষয় আলোচনার পূর্বে তাদের সৃষ্টির ইতিহাস উল্লেখ
কবর (ইনশাআল্লাহ)। এ ক্ষেত্রে তাদের লেখা কিতাবাদী ও তাদের যারা চরমভাবে বিরোধীতা
করে (হানাফি মাযহাবের অনুসারি দেওবন্দী এবং ব্রেলভী) তাদের লেখা কিতাবাদী থেকে
সমান গুরুত্ব সহকারে লিখব, যদিও তাদের মধ্যো সম্পুর্ণ বিপরীত ধর্মী লেখা পাওয়া যায়।
আশা করি আল্লাহর রহমতে নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারব। আহলে হাদিসের
অনেক আলেম দাবি করেন থাকেন বিশ্ব বিখ্যাত বহু আলেম যেমনঃ
১.
খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (মৃঃ ১০১ হিঃ)২. মাকহুল বিন আব্দুল্লাহ সিন্ধী (মৃঃ ১১৩ হিঃ)
৩. আমর বিন মুসলিম বাহেলী (মৃঃ ১২৩ হিঃ)
৪. ইমাম আওযাঈ (মৃঃ ১৫৭ হিঃ)
৫. ইমাম মালেক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)
৬. ফযায়েল বিন আয়ায (মৃঃ ১৮৭ হিঃ)
৭. ইমাম শাফেঈ (মৃঃ ২০৪ হিঃ)
৮. ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ)
৯. আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন খালাক (মৃঃ ৩১১ হিঃ)
১০. ইমাম ইবনে খুযাইমা (মৃঃ ৩১১ হিঃ)
১১. আবুল হাসান আশআরী (মৃঃ ৩২৪ হিঃ)
১২. ইব্রাহীম বিন মুঃ দেবলী (মৃঃ ৩৪৫ হিঃ)
১৩. আবু আব্দুল্লাহ হাকিম নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)
১৪. ইমাম ইবনে হাযয আন্দালুসী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ)
১৫. ইমাম বায়হাকী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ),
এরা সহ অনেক আলেম আহলে হাদিস ছিল। (উত্সঃ মোঃ আব্দুল্লাহেল কাফী: আহলে হাদীস পরিচিত)।
“আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ” এর প্রতিষ্ঠাতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব দাবি করেনঃ
আবু হানীফা (রহ) (৮০-১৫০ হিজরী)
ইমাম মালেক (রহ) (৯৩-১৭৯ হিজরী)
ইমাম শাকেরী (রহ) ( ১৫০-২০৪ হিজরী)
আহমদ বিন হাম্বাল (রহ) ( ১৬৪-২৪১ হিজরী)
ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী)
ইমাম মুসলিম (২০৪-২৬১ হিজরী)
ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিজরী)
ইমাম আবু দাউদ (২০২-২৭৫ হিজরী)
ইমাম তিরমিজি (২০৯-২৭৯ হিজরী)
ইমাম ইবনে মাযাহ (২০৯-২৭৩ হিজরী)
ইমাম আলি ইবনে মাদানী (১৬১-২৩৪ হিজরী)
এই সকল জগত বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ সকলে আহলে হাদিস ছিল। (উত্সঃমুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের লেখা আহলে হাদীছ আন্দোলন কি এবং কেন? পৃষ্ঠা -৭ ও ৯)।
তাদের এ দাবির পিছনে
যৌক্তিক কারনও আছে। প্রথম ৪০০ হিজরির আগের আলেম সমাজ হাদিসের উপর গবেষনা করে
নিজেরাই মাসয়ালা দিতেন। তারা হাদিসের ব্যাপক খেদমত করে সংকলণ এবং সংরক্ষণের
ব্যাবস্থা করেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে হাদিসের মান যাচই বাচাই করে সহিহ, জঈফ ও জাল
নির্ণয় করেছেন। এই জন্য আহলে হাদিসের কঠিন বিরোধীতা কারি, দেওবন্দী অনেক আলেম বলে
থাকেন, যারা হাদিসের খেদমত করেছেন তাদের আহলে হাদীস বলতে আমদের কোন আপত্তি
নেই। কিন্তু আমভাবে কেউ আহলে হাদিস দাবি করতে পারেনা বা আহলে হাদিস নাম ধারন করতে
পারে না। আহলে হাদিসদের এ দাবির যৌক্তিক আছে কি নেই, তা বড় কথা নয়, তবে আহলে হাদিস
নামের যে সংগঠনটি ভারত উপমহাদেশে কাজ করে তাদের সৃষ্টি ১৯০৬ সালে। বাংলাদেশে
বর্তমানে আহলে হাদীসদের দুটি সংগঠনকে দেখতে পাওয়া যায়,
যারা ধর্ম প্রচারের কাজ করে থাকে। যথাঃ
০১। জমিয়তে আহলে হাদীস
০২। আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ
প্রথমটি “জমিয়তে আহলে হাদীস” যা ১৯৪৮ সালে আল্লামা
আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়েশীর মাধ্যমে
ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এবং দ্বিতীয়টি “আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ”
যা ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী
বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রতিষ্ঠা
করেন।
সুতারং বলা যায় আহলে হাদিস নামের যে সংগঠনটগুলি ভারত উপমহাদেশে
কাজ করছে তাদের জম্ম ১৯০৬ সালে আগে নয়। অপর পক্ষে যে সকল সংগঠন কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালিত হয়,
তারা সকলে এ দাবি করে পারেন যে, পূর্ববর্তী আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের (শীয়া বা
রাফেজি নয়) অনুসারি সকল আলের তাদের দলেন অন্তরভুক্ত ছিলেন। কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী
পরিচালিত সংগঠনগুলির এ দাবি কেউ প্রত্যাখান করতে পারবে না। কারন প্রথম ৪০০ হিজরির
আগের আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলেম সমাজ সঠিকভাবে কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ
করেছেন। এ হিসাবে আহলে হাদিসদের দাবি “উপরের বর্ণিত আলেম” তাদের দলভুক্ত সত্য
হিসাবে মেনে নেওয়া যায়। এমনিভাবে পূর্বে আলোচিত দেওবন্দী ও জামায়াতে ইসলামিও এ
দাবি করতে পারেন যে, তাদের দল বা সংগঠণও ঐ সকল আলেমদের অনুসারী।
কাজেই উপমহাদেশে আমরা যে আহলে হাদিসের কর্ম কান্ড দেখি আর শুনি
তাদের ইতিহাস ১৯০৬ সালের পরবর্তী সময় কালের। এই ইতিহাস টুকু জমিয়তে আহলে হাদীসের
নিজেস্ব ওয়েব সাইড (www.jamiyat.org.bd)
–এ বিশদভাবে তুলে ধরছেন, তারই কিছু অংশ
সংক্ষেপে উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।
জমিয়তে আহলে হাদীসের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
সর্বভারতীয় আহলে হাদীস সংগঠন প্রতিষ্ঠাঃ ১৯০৬ সালে ২২ ডিসেম্বর (৬ যুলকা’দা ১৩২৪ হিজরী) মিয়া নাযীর হুসাইন দেহলভী (রহঃ) এর কয়েকজন কীর্তিমান ছাত্র।
১। হাফেয আব্দুল্লাহ গাজীপুরী (১৮৪৪-১৯১৮)২। হাফেজ আব্দুল আযীয রহীমাবাদী (১৮৫৫-১৯১৮)
৩। শামসুল হক আযীমাবাদী (১৮৫৭-১৯১১)
৪। আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (১৮৬৫-১৯৩৫)
৫। আয়নুল হক ফলওয়ারী (১৮৬৯-১৮১৫) ও
৬। ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১৮৬৮-১৯৪৮)
প্রমুখ আলেম বিহারের ‘আরাহ’ জেলায় মাদ্রাসা আহমাদিয়াহ-র বার্ষিক সেমিনারে একত্রিত হন। তাঁরা উপস্থিত সুধীবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করে ‘অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স’ নামে একটি সর্বভারতীয় আহলে হাদীস সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
সভাপতি নির্বাচিত হন হাফেজ আব্দুল্লাহ গাজীপুরী, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ছানাউল্লাহ অমৃতসরী
এবং কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন শামসুল হক আযীমাবাদী (রহ)।
সংগঠনের
প্রতিষ্ঠা থেকে পাক-ভারত বিভক্ত সময়কালের
কর্মকান্ডঃ ১৯০৬ হতে
১৯৪৭
পর্যন্ত
৪০
বছরে
পবিত্র
করআন
তাফসীর
সহীহ
হাদীস
ইসলামী
বই-পত্র
ইত্যাদি
ব্যপকভাবে
বিনামূল্যে
বিতরণ
করা
হয়। এ সংগঠনটির
অধীনে
পরিচালিত
১২৩ টি
মাদরাসা
এবং
মাসিক, পাক্ষিক
ও সাপ্তাহিক
মিলে
৩০
টি
পত্রিকা
প্রকাশ
করা
হয়।
আয়োজন
করে
অসংখ্য
সভা-সমাবেশ, বাহন-মুনাযারা
ইত্যাদি।
কবর
পূজার
বিরুদ্ধে
মাওলানা
ছানাউল্লাহ
অমৃতসরী
বলিষ্ঠ
ভূমিকা
পালন
করেন।
এছাড়া
নিয়মিত
মুবালি্লগবৃন্দ
সারা
ভারতে
ব্যাপক
দাওয়াতী
কাজ
করেন।
আঞ্জুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা ও আসামঃ ১৯১৪
সালে বাঙ্গালী ও আসামী ছাত্ররা বাংলাভাষী মানুষের মাঝে তাওহীদ ও সুন্নাহর দাওয়াত সমপ্রসারণের
লক্ষ্যে পশ্চিম বঙ্গের কলিকাতায় ‘আঞ্জুনামে আহলে
হাদীস বাঙ্গালা ও আসাম’ নামে আহলে হাদিসের আর একটি শাখা প্রতিষ্ঠা হয়। যার সভাপতি নির্বাচিত হন
বর্ধমান জেলার কুলসোনার বিশিষ্ট আলেম মাওলানা নে’মাতুল্লাহ
(বাংলা ১২৬৬-১৩৫০) এবং সেক্রেটারী
নির্বাচিত হন হুগলী জেলার মাওলানা আব্দুল লতীফ (১৮৭৮-১৯৪৯), জয়েন্ট সেক্রেটারী নির্বাচিত হন বাংলাদেশের মাওলানা
আব্বাস আলী। তিনিই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম কুরআন মাজীদের পূর্নঙ্গ অনুবাদ প্রকাশ করেন।
১৯১৬ সালের ৯, ১০ ও ১১ মার্চ ‘অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস’ কনফারেন্সের কলকাতা অধিবেশনে মাওলানা হাফেজ আব্দুল্লাহ গাজীপুরী, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা আব্দুল আলীম রহীমাবাদী,
মাওলানা আবুল কাসেম বেনারসী প্রমুখ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতির
আঞ্জুমানে আহলে হাদীসকে ‘অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের’
প্রাদেশিক শাখার মর্যাদা দেওয়া হয়।
আঞ্জুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা
ও আসাম’ এর মুখপত্র ‘মাসিক আহলে হাদীস’
১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ‘মাসিক’
হিসেবে চলার পর ১৯২৭ সালে পত্রিকাটি সাপ্তাহিক হিসাবে অত্নপ্রকাশ করে।
তবে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পত্রিকা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি
দাওয়াত ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সমপ্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পত্রিকা ছাড়াও
বেশ কিছু মূল্যবান বই প্রকাশ করে আঞ্জুমান। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আঞ্জুমানের
তৎপরতা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসঃ ১৯৪৭ সালে
ভারত বিভক্তির ফলে সংগঠনটির কার্যক্রম শুধু ভারতীরা ভূখন্ডেই সীমিত হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে
কলকাতার মিসরীগঞ্জ জামে মসজিদে অবস্থিত জেনারেল কমিটির সভায় জমিয়তের সদর দফতর তৎকালীন
পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের)
পাবনায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেমতে ঐ বছর ৭ মার্চ পাবনা
জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র বাঁশবাজার আহলে হাদীস জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে জমঈয়তের নয়া
সদর দফতর উদ্বোধন করা হয়।
১৯৪৯ সালের ১২ ও ১৩ মার্চ রাজশাহী
শহরের উপকণ্ঠে নওদাপাড়ায় আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরায়শীর সভাপতিত্বে
অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমিয়তে
আহলে হাদীসের দ্বিতীয় কনফারেন্স। কনফারেন্সে আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল কুরায়শীকে
সভাপতি, মাওলানা কবীর উদ্দীন আহমদ রহমানী এবং মাওলানা মুহাম্মদ
হুসাইন বাসুদেবপুরীকে সহ-সভপতি এবং মাওলানা আব্দুর রহমান বিএবিটি
কে জমিয়তের জেনারেল সেক্রেটারী নির্ধরণ করা হয়।
১৯৫৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনায়
অনুষ্ঠিত জেনারেল কমিটির সভায় ‘নিখিল বঙ্গ
ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস’ এর নতুন নাম করণ করা হয়
‘পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীস’। ওই
সময় জমঈয়তের জেলা সংগঠন ছিল মাত্র ৪টি-পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া এবং খুলনা।
১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে জমঈয়তের
দপ্তর পাবনা হতে ঢাকায়, ৮৬ কাজী আলাউদ্দীন রোডে স্থানান্তর করা হয়।
১৯৬০ সালের ৪ জুন আল্লামা মুহাম্মদ
আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শীর ইন্তেকালের পর
১৫ জুন, জমিয়তের কার্যকরি কমিটির সভায় ড. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল বারী পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের সভাপতি
নির্বচিত হন এবং পরবর্তী জেনারেল কমিটির সভায় উক্ত নির্বাচন সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত
হয়।
রাজশাহী জোলার নবাবগঞ্জের একটি
আম্র বাগিচার ১৯৬৪ সালের ৩, ৪ ও ৫ এপ্রিল প্রফসর ড.
মুহাম্মদ আব্দুল বারী’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ
কনফারেন্স বিশেষ আকর্ষণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ।
পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়ত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন পশ্চিম পাক জমঈয়তের আমীর শায়খুল
হাদীস আল্লামা মুহাম্মদ ইসমাঈল গুজরানওয়াল, প্রচার সম্পাদক আলহাজ্জ
মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক হানাফী এবং কার্যকরী সংসদের অন্যতম সদস্য সারগোধার জামে মসজিদের
খতীব মাওলান মুহাম্মদ ইসহাক রহমান।
কনফারন্সের
তৃতীয় দিবসের শেষ অধিবেশনে সর্বস্মতিক্রমে ১৬টি জেলা জমঈয়ত হতে দুইশত পঞ্চাশ জন সদস্য
মনোনিত করে পূর্ব পাকিসরান জমঈয়তে আহলে হাদীসের জেনারেল কমিটি এবং ৩২ সদস্য বিশিষ্ট
নিম্নরূপ কার্যকরী সংসদ গঠিত হয়।
সভাপতি: ডক্টর মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল বারী
সহ-সভাপতি: মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাসুদেবপুরী
মাওলানা শামসুর হক সালাফী ও মাওলানা আফতাব আহমদ রহমানী
জেনালেল সেক্রেটারী: মাওলানা আব্দুর রহমান
অর্গানাইজিং সেক্রেটারী: মাওলানা বকশ নদভী
সহকারী সেক্রেটারী: মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী
সদস্য: ২৫ জন।
সভাপতি: ডক্টর মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল বারী
সহ-সভাপতি: মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাসুদেবপুরী
মাওলানা শামসুর হক সালাফী ও মাওলানা আফতাব আহমদ রহমানী
জেনালেল সেক্রেটারী: মাওলানা আব্দুর রহমান
অর্গানাইজিং সেক্রেটারী: মাওলানা বকশ নদভী
সহকারী সেক্রেটারী: মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী
সদস্য: ২৫ জন।
অনুমোদিত
জেলা জমঈয়াত এর তালিকা।
১। কুষ্ঠিয়া, ২। কুমিল্লা, ৩। খুলনা ৪। যশোর, ৫। চট্টগ্রাম, ৬। ঢাকা, ৭। দিনাজপুর, ৮। নোয়াখালী ৯। পাবনা, ১০। ফরিদপুর, ১১।বগুড়া, ১২। বরিশাল, ১৩। ময়মনসিংহ, ১৪। রংপুর, ১৫। রাজশাহী এবং ১৬। সিলেট।
১। কুষ্ঠিয়া, ২। কুমিল্লা, ৩। খুলনা ৪। যশোর, ৫। চট্টগ্রাম, ৬। ঢাকা, ৭। দিনাজপুর, ৮। নোয়াখালী ৯। পাবনা, ১০। ফরিদপুর, ১১।বগুড়া, ১২। বরিশাল, ১৩। ময়মনসিংহ, ১৪। রংপুর, ১৫। রাজশাহী এবং ১৬। সিলেট।
বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভু্যত্থানের পর পরই পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে
হাদীস এর নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় “বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস”। এবং
জমিয়তের অফিসগৃহ কাজী ৮৬ আলাউদ্দীন রোড থেকে ৯৮ নওয়াবপুর রোড স্থাপন করা হয়।
প্রায় একই সময়ে জমিয়ত উত্তর
যাত্রাবাড়ী মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া নামে একটি কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার চারবছর পর
১৯৭৬ সালে সালে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হদীসের চতুর্থ কেন্দ্রীয় কনফারেন্সের আয়োজন
করা হয় পাবনায়। উক্ত কনফান্সে ১৬টি জেলা জমিয়ত হতে দুইশত পঞ্চাশজন সদস্য নির্বাচিত
করে বাংলাদেশে জমিয়তে আহলে হাদীসের জেনারেল কমিটি এবং ৩২ সদস্য বিশিষ্ঠ কার্যকরী সংসদ
গঠন করা হয়।
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ জমঈয়তে
আহলে হাদীসের পঞ্চম কেন্দ্রেীয় কনফারেন্স রাজধানী ঢাকায় মহাসমরোহে পূর্ণ সাফল্যের
সাথে অনুষ্ঠিত হয়। এ কনফারেন্সে সাউদী আরব, কুয়েত, ভারত ও পাকিস্থানসহ দেশ-বিদেশের প্রোথিতযশা বহু উলামায়ে দীন ও ইসলামী পন্ডিতগণ অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এ
কনফারেন্স প্রফেসর ড. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল
বারী সভাপতি ও আলহাজ্ব আব্দুল ওয়াহহাব (কোষাধক্ষ্য),
আলহাজ্ব এডভোকেট মুহাম্মদ আয়েন উদ্দিন ও আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ আলী
সহ-সভাপতি, মাওলানা মুহাম্মদ মুহাম্মদ আব্দুস
সামাদ সাংগঠনিক সেক্রেটারী, মাওলানা মুহাম্মদ মুসলিম সহসেক্রেটারী,
মাওলানা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম অফিস সেক্রেটারী, সহ মোট ৫০ জন কার্যকরী সংসদের সদস্য নিয়ে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের পূর্ণাঙ্গ
কমিটি গঠণ করা হয়।
তাদের বিরুদ্ধবাদীদের মতেঃ
উপমাহাদেশ আহলেহাদিসদের চরম
বিরোধী হানাফি মাজহাবভুক্ত দেওবন্দী আলেম সমাজ। তারা তাদের বিভিন্ন লিখুনি
দ্বারা আহলে হাদিসদের মুকাবেলা করে থাকে। তাই তা আকিদার ক্ষেত্র হোক বা মাসয়ালা মাসায়েলের ক্ষেত্রে
হোক। তারা আহলে হাদিসদের উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রষণ করে থাকে। যেমন
দেওবন্দীদের কওমী মাদ্রাসার বোর্ড, বেফাকুল মাদারিসিন আরাবিয়া বাংলাদেশ এর
সিলেভাজভূক্ত কিতার “ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত” নামক কিতাবে আহলে হাদিসদের উৎপত্তি
ইতিহাস তুলে ধরছেন এভাবে।
“মাযাহেরে হক্ব”
কিতাবের স্বনামধন্য লেখক নওয়াব কুতুব উদ্দীনস সাহেবের বর্নণা মতে
১২৪৬ হিজরির পর হিন্দুস্থানে গায়রে
মুকাল্লিদ ফির্কার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর অগ্রনী ভুমিকায় ছিলেন মৌলভী আব্দুল হক্ব
বেনারসী (মৃত- ১২৭৫ হি)। তাকেই গায়রে মুকাল্লিদ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে গন্য করা হয়।
সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহঃ এর তাক্বলীদ বিরোধী ভুমিকা বনাম ফ্যাসাদের পথ গ্রহনেন
জন্য তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। তিনি আইম্মায়ে দ্বীনের তাক্বলীদ করা অস্বীকার
করেন। তিনি ফোকাহায়ে কেরামদের বিরুদ্ধে বিশেষত ইমাম আবু হানিফার (রহঃ) এর বিরুদ্ধে
জনমনে বিদ্ধেষের বীজ বপণ করেন। এ মর্মে হারামাইনর তদানীন্তন উলামায়ে কিরাম ও
মুফতীগণের নিকট এ ব্যপারে ফতওয়া তলব করলে সেখান কার চার মাজহাবের মুফতিগণসহ আবেদ
সিন্ধির ন্যায় অন্যান্য উলামাগণ এরূপ লোকদের গোমরা ও অন্যদের কে গোমরা কারি বলে
ফতওয়া প্রদান করেন। (ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত, পৃষ্ঠ নম্বর ৪৩৭, মাওলানা হেমায়েত
উদ্দিন, প্রকাশ কাল ২০১০)।
এই
ধারার অনেক আলেম আবার এভাবে উৎপত্তি ইতিহাস তুলে ধরেনঃ সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ,
মাওলানা ইসমাইল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই রহ. পাঞ্জাবে আগমন করার
পরপরই কতিপয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীর সমন্বয়ে চার মাযহাবের ইমামগণের তাক্বলীদ
অস্বীকারকারী নতুন ফিরক্বাটির বা আহলে হাদীস এর সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়। যারা
হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. এর মুজাহিদ বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্য ছিল।
এদের মূখপাত্র ছিল মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃত- ১২৭৫ হি) । তার এ ধরনের অসংখ্যা
ভ্রান্ত কর্মকান্ডের কারনে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. ১২৪৬ হিজরীতে মৌলভী আব্দুল
হক্ব বেনারসীকে মুজাহিদ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করেন। তখনই গোটা ভারতবর্ষের সকল
ধর্মপ্রান জনগণ, বিশেষ করে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. এর খলীফা
ও মুরীদগণ হারামাইন শরীফাইনের তদানীন্তন উলামায়ে কিরাম ও মুফতীগণের নিকট এ
ব্যপারে ফতওয়া তলব করেন। ফলে সেখানকার তৎকালীন চার মাযহাবের সম্মানিত মুফতীগণ ও
অন্যান্য উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও তার
অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করেন। (মাওলানা কুতুব উদ্দীন, তুহফাতুল আরব ওয়াল আজমের খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১৬)।
ইসলামি
আকিদা ও ভ্রান্ত নামক কিতাবে আরোও লিখেন, গায়রে মুকাল্লিদগনের মধ্য প্রসিদ্ধ
ব্যক্তিত্ব নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান সাহেবের যুগ পর্যান্ত নিজেদের পরিচয়
“মুওয়াহহিদীন” (তাওহীদপন্থী) বলে পরিচয় দিতেন। কখন তারা নিজেদেরকে “মুহাম্মাদী” বলে পরিচয় দিতেন। তাদের এই পরিচয় গ্রহণের
পশ্চাতে একটা কারন এত ছিল যে, বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে ওহাবী বলে পরিচয় দিত। তখন
তারা নিজেদের “মুহাম্মাদী” বা
“মুওয়াহহিদীন” (তাওহীদপন্থী) পরিচয় দিতে শুরু করে। ১৮১৮ সালে সর্ব প্রথম তানা নিজেদের আহলে হাদিস
পরিচয় দিতে শুরু করে। এর পরও অনেকে তাদের ওহাবী বলে আখ্যায়িত করে। পরবর্তীতে তারা “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ করার জন্য চেষ্টা করে। (ইসলামি
আকিদা ও ভ্রান্ত-৪৩৮)।
এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদদের তৎকালীন
মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয়
এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও
বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের নিকট তাদের জন্য “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। এ
দরখাস্তগুলোর প্রতি উত্তর সহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন “এশায়াতুস সুন্নাহ” পত্রিকায় (পৃ:২৪-২৬, সংখ্যা:২, খ:১১) প্রকাশ করা হয় যা পরে সাময়ীক
নিবন্ধ আকারেও বাজারজাত করা হয়। আহলে হাদিস সমালোচোকদের মতে ঐ আবেদনে ইংরেজদের
আনিগত্য স্বীকার করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ওহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম
ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের
মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না যারা আপনাদের আনুগত্যতা ও কল্যাণই
প্রত্যাশা করে। যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি পত্রে এর স্বীকৃতিও
রয়েছে।
দরখাস্ত
মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্য “ওহাবী”
শব্দের পরিবর্তে “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ করে দেন এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তদের “আহলে হাদীস” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে
দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়। সর্বপ্রথম পাঞ্জাব
গভর্নমেন্ট সেক্রেটারী মি: ডব্লউ. এম. এন (W.M.N) বাহাদুর
চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ (১৩০৪ হিঃ) ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র
প্রেরণ করেন।
বর্তমানে অনেক আহলে হাদিস অনুসারী নিজেকে
সালাফী হিসাবে পরিচয় দেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর আগেও উপমহাদের অনেকে
আহলে হাদিস অনুসারী নিজেকে সালাফী হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। এমনি মাদ্রাসার নামও
রেখেছের সালাফি শব্দটির সাথে মিল রেখে। কারণ আমরা জানি আহলে হাদিস অনুসারীগন
নির্দিষ্ট একক কোন ইমামের তাক্বলীদ করে না। অপর পক্ষে সালাফীগণ ও নির্দিষ্ট একক
কোন ইমামের তাক্বলীদ করে না। তাই শুরু তারা নয়, বর্তমানে অনেকেই মনে করে ‘আহলে
হাদিস’ আর ‘সালাফী’ মুদ্রার এপিট আর ওপিট মাত্র। স্থান ও কালের আবর্তে শুধুই তাদের
নামের ভিন্নতা মাত্র তবে এলমের গভীরতা প্রতিকুল পরিবেশের জন্যও তাদের মধ্য সামান্য
পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যেমন এক ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে হাদিসদের ভিন্ন ভিন্ন
জামাত কাজ করছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি বাংলাদেশে বর্তমানে “জমিয়তে আহলে হাদীস”
এবং “আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ” নামে দুটি
সংগঠন কাজ করছে। তাদের ভাষ্যমতে, তারা সৌদী আরব, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমান,
কুয়েত, কাতার. আরব
আমিরাতসহ মধ্যপ্রাশ্চ্যে তাদের ‘সালাফী’, সুদান ও মিশরে ‘আনসারুস
সুন্নাহ’, ইন্দনেশিয়ায় “মুহাম্মদী” আর ভারত উপমহাদেশে ‘আহলে হাদীছ’ নামে পরিচিত। অপর পক্ষে ইরানসহ
মধ্যপ্রাশ্চ্যে তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদের “ওহাবী” বলে চিহ্নিত করে থাকে। পূর্বেই
দেখেছি আহলে হাদিস অনুসারিদের মতে তাদের যে সংগঠনটি ভারত উপমহাদেশে কাজ করে তাদের সৃষ্টি
১৯০৬ সালে। আর দেওবন্দী আলেমদের মতে কাগজে কলমে তারে সৃষ্টি ১৮১৮ সালে। কিন্তু
মধ্যপ্রাশ্চ্যে তথা সৌদীআরব সালাফীদের আবির্ভাব ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সালমান বিন আলী আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খৃঃ)
রাহিমাহুল্লাহ এর হাত ধরে। মধ্যপ্রাশ্চ্যের সালাফী আন্দলনের ৫০/৬০ বছর পর ভারত
উপমহাদেশে ‘আহলে হাদীছ আন্দোলন
শুরু হয়। মধ্যপ্রাশ্চ্যে তথা সৌদিআরবে সালাফী আন্দলন শুরু হয়েছিল মূলত কালের
আবর্তে ইসলাম তথা মুসলিমদের মধ্য যে শির্ক ও বিদআত প্রবিষ্ট করে ছিল তা চিরতরে দুর
করার এজেন্ডা নিয়ে। এই শির্ক ও বিদআতে বিরুদ্ধে তারা কঠোর ও অনমণীয় মনভাব প্রষণ
করে এবং তারই ধারাবাহিকতায় তারা কুরআন ও সহিহ সুন্নাত আলোকে ফতোয়া দিতে থাকে, তাই
তারা নির্দিষ্ট একক কোন ইমামের তাক্বলীদ থেকে বের হয়ে আসে এবং চার ইমামের সকলকেই
হক জেনে শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে অনুসরণ করে। যদিও তাদের অধিকাংশ “হাম্মলী”
মাজহাবের অনুসারী ছিল।
যেমন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল
ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ এর ছেলে আব্দুল্লাহর, তার কিতাব “আদ দুরারুস সারিয়্যা ফিল
আজরুরাতিল নাজদীয়া” কিতাবের প্রথম খন্ডের ২২৭ পৃষ্ঠায় লিখেন,
আমরা ফুরিয়ী বা শাখাগত মাসয়ালা মাসায়েলের ক্ষেত্রে ইমাম
আহম্মদ ইবনে হাম্মলের অনূসরণ করি। আর যারা চার ইমামের কোন এক ইমামের অনুসরণ করে
আমরা তাদের ব্যাপারে কোন আপত্তি করি না। হ্যা, চার ইমামের বাইরে কোন মাজহাবের
অনুসরন করা কে আমরা জায়েয মনে করি না কেননা তাদের মাজহাব সুসংরক্ষিত নেই। যেমনঃ
রাফিজী, জায়দিয়া, ইমামিয়া ইত্যাদি। এদের আমরা স্বীকার করি না, কারণ এরা ফাসেক। কাজেই
চার ইমামের অনুসরণে কোন আপত্তি নেই বরং আমরা বাধ্য করি চার ইমামের কোন এক ইমামের
অনুসরণ করতে। তাই আমরা ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্মলকে অনুসরণ করি, কারন আমরা মুজতাহীন
নই, ইজতেহাদ করার ক্ষমতা আমাদের নেই কিন্তু কথিপয় মাসয়ালার ক্ষেত্রে যদি আমরা ষ্পষ্ট
ও সহিহ দলিল পাই, তখন আমরা আমাদেন মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাবের মাসয়ালা গ্রহণ
করি। অর্থাৎ যে ইমামের মতামত অধিক শক্তিশালী আমরা তার মতামত গ্রহণ করি।
চার ইমামের ইজতেহাদকে
একসাথে এনে ষ্পষ্ট, সহিহ এবং শক্তিশালী দলিলের ভিক্তিতে যারা কুরআন সুন্নাহ অনুসরণ
করে তাদের কে সালাফী বলা হয়।
অপর পক্ষে উপমহাদের আহলে হাদিসের অনুসারীরাও দাবি করে থাকে
তারাও কোন নির্দিষ্ট ইমামের অনুসরন করে না। তাদের কে উপমহাদের অনেক আলেম এ জন্য
তাদের বিরোধিতা করে তাদের বলেছেন, গাইরে মুক্বাল্লিদ বা লা মাজহাবী। উদাহরণ হিসাবে
বলা যায়, দেওবন্দী
ঘরানার বিশিষ্ট আলম হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) তার কিতাব “আশরাফুল
জওয়াব” যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত, ৯১ পৃষ্ঠায় ওয়াহ্হবী সম্পর্কে এক
প্রশ্নের উত্তরে দেন। যার শিরোনাম ছিলঃ “হকপন্থিদের
ওহাবী বলা বানোয়াট কথা”। তিনি লিখেন, বিদআতীরা বলে আমরা ওয়াহ্হবী। কিন্তু অন্তর্নিহিত কারন আজ পর্যান্ত
বুঝে আসল না। কেননা ওয়াহ্হবী বলা হয় ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হবের সন্তানদের কিংরা তার অনুসারীদের।
ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হবের জীবনি সংকলিত রয়েছে। তা পাঠ করলে প্রত্যেকেই অবগত লাভ করতে
পারে যে, তিনি আমাদের অনুসারী বুজুর্গদের অন্তরভুক্ত নন কিংবা আমরা তার
উত্তরপুরুষেও সামিল নই। অবশ্য
বর্তমানের গায়রে মুকাল্লিদ এক হিসাবে ওয়াহ্হবী সম্প্রদায়ভিক্ত হতে পারে, যেহেতু
তাদের আকিদা বিশ্বাস ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হবের ধ্যান ধারনার সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ণ।
আমাদের বরং হানাফী বলাই সঙ্গত। কারন শরীয়তের উসূল কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে রাসূল,
ইজমায়ে উম্মত এবং মুজতাহিদের কিয়াস এ চারটিতে সীমিত। এর বাইরে অপর কোন উত্স নেই।
মুজতাহিদ আছেন অনেক। কিন্তু ইজমায়ে উম্মতের ভিত্তিতে প্রমানিত যে, এ চারটি
মাজহাবের আওতামুক্ত অপর কোন মাজহাবের উপস্থিতি অবৈধ। অধিকন্ত এটাও স্থিরীকৃত যে, এ
চার মাজহাবের মধ্য হতে বহুল প্রচলিত মাজহাবের
অনুসরণ করাই বিধেয়। কাজেই এ উপমহাদোশে যেহেতু ইমাম বু হানীফা (রহঃ) এর মাজহাব অধিক
প্রচলিত তাই তারই অনুসরণ করি। অবশ্য ওয়াহ্হবী বাখ্যা প্রাপ্তিতে আমরা বড় একটা
বিষন্নচিত্ত নই। কিন্ত এটুকু বলে রাখি,
কিয়ামতের দিন এ মিথ্যা অপবাদের জবাব অবশ্যই দিতে হবে।
যেহেতু আহলে হাদিস অনুসারিগন দাবি করে আমরা সালাফি আবার
উপমহাদেশের সংখ্যা গরিষ্টের অধিকারি দেওবন্দী আলেমগণ ও বলেন তারা সালাফি বা
ওয়াহ্হবী। অপর পক্ষে ব্রেলভীদের বিশ্বাস দেওবন্দী, জামাতে ইসলামি, আহলে হাদিস সকলেই সালাফি বা
ওয়াহ্হবী। তা হলে বুঝা গেল আহলে হাদিস আসলে শতভাগই সালাফিদের মতাদর্শী। তাই আমরা
এখন সালাফীদের সম্পর্কে জানব।
সালাফীদের প্রতিষ্ঠাতা মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল
ওয়াহ্হাব বিন সালমান বিন আলী আত-তায়মী (১৭০৩-১৭৬১ খৃঃ) রাহিমাহুল্লাহ। পূর্বে যেমন
কোন ফির্কা বা দলের আলোচনায় সেই দলের প্রতিষ্ঠাতার জীবন পর্যালোচনা করেছি এবার ও
তার ব্যতিক্রম করব না। তাই সালাফীদের প্রতিষ্ঠাতা মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল
ওয়াহ্হাব এর জীবনি আলোচণ করলেই সালাফী আন্দলনের সাথে পরিচিত লাভ করতে পারব। (ইনশাআল্লাহ)।
শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব
রাহিমাহুল্লাহ
জন্ম ও প্রতিপালনঃ
ইসলামে ইতিহাসে যুগে যুগে বহু
মুজাদ্দিদ আগমন করেছেন। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্ম দ্বারা সমহিমায় মুসলিমদের
হৃদয় স্থান দখল করে আছেন। তাদের মধ্যে ইরাকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, সিরিয়াতে ইমাম
আহমাদ ইবনে তায়মিয়া ও হাফিজ ইমাম ইবনে কাসির, মিসরে ইয্ বিন আব্দুস সালাম, মরক্কো ও স্পেনে ইমাম
শাত্বেবী, ইয়ামনে ইমাম ছান‘আনী ও ইমাম
শাওকানি, ভারত উপমহাদেশে শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও মুজাদ্দেদে আলফে সানি প্রমুখ মহান মুজাদ্দিদ
প্রত্যেকেই হক্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ নিজ স্থান থেকে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত
হয়েছিলেন। বাতিল
ফির্কা এবং পথভ্রষ্ট জাতীর আক্বীদাসমূহের বিরুদ্ধে
সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং ইসলামের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন।
সৌদি আরবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঠিক তেমনই একজন মুজাদ্দিদের আবির্ভাব হয়। আর তিনি
হলেন শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মান বিন আলী বিন
মুহাম্মাদ আত্ তামীমী (রঃ)। ১১১৫ হিজরী মোতাবেগ ১৭০৩ সালে, বর্তমান রাজধানী
রিয়াদের পশ্চিম উত্তরে “নজদ অঞ্চলের উয়াইনা”
শহর এক আলেম পরিবারে আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মানের ঔরসে তার ছেলে মুহাম্মদের জন্ম হয়।
আরব দেশের নিয়মানুযায়ী এ নাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব বলে বর্ণিত হয়। তার দাদা
শাইখ সোলায়মান ছিলেন ঐ সময়ের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন। পবিত্র হজ্জ্বের সময় তার লেখা “আল
মানাসিক” বইটি এখনোও হাম্বলী মাজহাবের অনুসারীরা অনুসরণ করে থাকেন। তার চাচা
ইব্রাহী ইবনে সোলায়মান ছিলেন একজন উচ্চ মাপের আলেম। চাচাত ভাই আব্দুর রহমান ইবনে
সোলায়মান ছিলেন মস্তবড় ফিকাহবিদ ও সাহিত্যিক। তার
পিতা আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মান ছিলেন
একজন বিশিষ্ট ফিকাহবিদ তিনি দীর্ঘ দিন পর্যান্ত উয়াইনা ও হুরাইমালার বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। শিশুকালে তিনি
স্বীয় পিতার নিকট প্রতিপালিত হন। যেহেতু তাঁর পিতা, চাচা এবং দাদাসহ পরিবারের অনেকেই বিজ্ঞ আলেম ছিলেন তাই বলা যায় তিনি একটি
দ্বীনি পরিবেশে প্রতিপালিত হন। সে সময় শাইখের পরিবারের আলেমগণ শিক্ষকতা, ফতোয়া দান, বিচারকার্য পরিচালনা ইত্যাদি
গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি দায়িত্ব পালন করতেন। এ সমস্ত বিষয় দ্বারা সম্মানিত শাইখ
শিশুকালেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
জম্মের সময় হিজাজের অবস্থাঃ
বর্তমান সৌদিআরবের পবিত্র মক্কা, মদীনা, জিদ্দা ও তায়েফসহ
পশ্চিম অঞ্চলকেই হিজাজ বলা হয়। মুসলিম বিশ্বের চরম শোচনীয় অবস্থার বিষাক্ত ছোবল
থেকে এ অঞ্চলটিও মুক্ত ছিল না। শির্ক ও বিদআত মূলক কার্যক্রম এখানেও ব্যাপকভাবে
প্রসার লাভ করেছিল। বস্ততঃ এখানে অবস্থিত ইসলামের প্রান পুরুষ ও সাহাবায়ে
কিরামদেনর কবরগুল কেন্দ্র করে শির্ক বিদআত চলতে থাকে। মক্কা মুকার্রমায় রয়েছে
খাদিজা রাজিঃ এ কবর। তায়ফে আছে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের কবর। মদীনায় আছে বিশ্ব
নবী মুহম্মাদ সাঃ এর কবর। এখান আছে রাসূল সাঃ প্রিয় চাচা হামজা বজিঃ কবরসহ উহুদে
প্রায় ৭০ জন শাহাদাত বরণকারিদের কবর। আর জান্নাতু বাকিতে রয়েছে অসংখ্যা সাহাবি
রাজিঃ কবর। এ সকল কবরগুল কেন্দ্র করে শির্ক বিদআত মহা উৎসব চলতে থাকে। যিয়ারতে এসে
এ সকল কবরে সিজদাহ দিত, কবর বাসিদের ডাকত, সাহায্য প্রার্থণা করত, বরকত হাসিলের
চেষ্ট করত। তা ছাড়া রোগ মুক্ত, বিপদ মুক্তি ও অক্যাণ দূর করার জন্য কাকুতি মিনতি
করা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। (শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহ্হাব (রহঃ) জীবন ও
কর্ম, পৃষ্ঠা-৫৭, প্রকাশনিঃ বাংলাদেশ ইসলামি সেন্টার, প্রকাশ কাল২০০৯)।
জম্মের সময় নজদের অবস্থাঃ
মধ্য আরবের প্রাচীন উচ্চভূমি অঞ্চল ‘নাজদ’। ইসলামের
শুরু থেকেই আববাসীয় শাসনামল পর্যান্ত এখানে ইসলামে সুবাতাশ বইছিল। অহী নাজিলের সময়
যত দুর অতিক্রম করছিল পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মত নাজদ ও শিরক বিদ‘আতের ভয়াবহ আগ্রাসনের শিকার হয়। বিশেষত আববাসীয় শাসনামলের পতনের পর থেকে
অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যান্ত এখানে অহীর পরিবর্তে চলে আসে জাহেলী যুগের ধ্যান ধারনা
শির্ক মিশ্রিত ইবাদাত। তখন এখানে মুসলমানদের এমন অবস্থা ছিল যে, কোন মুমিন ব্যক্তি তা
সমর্থন করবে না। বস্তু পূজা শুরু হয়েছিল ব্যাপক ভাবে,
মানুষেরা কবর পূজা শুরু করেছিল, গাছ পূজা,
পাথর পূজা, গুহায় পূজা অথবা পীরদের পূজা করত।
জাদু এবং গণকদেরও অনেক বিস্তার লাভ করেছিল। মানুষদের মাঝে যে অনইসলামিক কাজের
ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে এবং কেউ এগুলোকে নিষেধ করছিল না, কেউ
মানুষকে আল্লাহ্র পথে ডাকছিলও না। এমনই এক ক্রান্তি লগ্নে
ইসলামের মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ জম্ম হয়। তিনি
অহীর নাজিলের দেশে আবার অহী ফিরিয়ে আনেন, যা প্রায় বিদায় নিয়েছিল। এই মহান মুজাদ্দিদ
কেবল নজদে রাসূল (সাঃ) -এর আনিত কুরআন সুন্নাহ পুনরুজ্জীবনই ঘটাননি বরং তা ছড়িয়ে
দিয়ে ছিলেন বিশ্বময় এবং যার সুফল আজ আরব বিশ্বসহ সকলে ভোগ করছে। এরই ফলোশ্রুতিতে
তখন অহির প্রাণকেন্দ্রে কুরআন সুন্নাহ উপর ভিত্তিশীল একটি বৃহত্তর আরব রাষ্ট্র
গঠনে সক্ষম হয়েছিল। বৈশিষ্ট্যগত কারণে এ আন্দোলনকে সালাফী আন্দোলন আন্দোলন বলে
আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু ঐতিহাসিকগনসহ অনেক এই আন্দোলনের নাম দেন ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন’। যে আন্দোলনের ফলে তাওহীদের
দেশে ফিরে এল তাওহীদ, সে আন্দোলের নাম কি? তা জানা অবশ্যই দরকার।
তাহলে মুহম্মম বিল আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ এর এই
সংস্কার আন্দোলনের নাম কি?
প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বা তাঁর অনুগামীদের
মধ্য থেকে কেউ তাদের আন্দোলনে কোন নাম রাখেনি। তারা কখনও দাবি করেন নি যে, আমরা সালাফী
বা ওয়াহ্হাবী।
তাই বলা যায় শুরু দিকে এ আন্দোলনের বিশেষ কোন নাম ছিল না। যারা এর সাথে
সম্পৃক্ত তাদের এক মাত্র ধ্যান ধারনা ছিল সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথে কুরআন
সুন্নাহর নির্ভেজান দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু তারা সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত
পথের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আহবানকারী ছিল, তাই তাদের নাম পরবর্তীতে ‘সালাফী আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে।
এই আন্দলনের সুচনা কারির নাম ছিল মুহাম্মাদ যার পিতা ছিল
আব্দুল ওয়াহ্হাব। তার
নামের সাথে সম্পৃক্ত না করে, তার পিতার নামের সাথে সম্পৃক্ত অনেকে এর নাম দিলেন “ওয়হ্হবী
আন্দোলন”।
প্রখ্যাত
ঐতিহাসিক, গোলাম
আহমদ মোর্তজা রচিত “চেপে
রাখা ইতিহাস” পুস্তকের
১৮০ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়।
ইংরেজদের
কারসাজিতে ছেলেদের পরিবর্তে বাপের নামেই ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তাঁদের রাখা
এ নাম হল ওয়াহ্হাবী। ‘তিনি ১৭৯ নং
পৃষ্ঠায় আরো লিখেছেন, ‘“ওয়াহ্হাবী” নেতাদের
“ওয়াহ্হাবী” বলা
মানে তাঁদের শ্রদ্ধা করা তো নয়ই বরং নিশ্চিতভাবে গালি দেয়াই হয়, যেহেতু
সে মহান বিপ্লবীরাই তাঁদেরকে “ওয়াহ্হাবী” নামে
আখ্যায়িত করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন।’
যাহোক পরবর্তী ঐতিহাসিকরা ভুলক্রমে হোক কিংবা
বিদ্বেষবশতঃ হোক এ আন্দোলনকে ‘ওয়হ্হবী আন্দোলন’ নামে পরিচিত করে তুলেছেন। যারা এ
আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত, বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কে ‘ওয়াহ্হবী’ বলে ডাকে। এটা মূলতঃ এ আন্দোলনের বিরোধীদের পক্ষ থেকে গালি স্বরূপ
ব্যবহার করা হয়।
‘জাস্টিস আব্দুল মওদূদ
“ওহাবী আন্দোলন” পুস্তকের ১১৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের ধর্মীয়
শিক্ষা ও মতবাদের আলোচনায় প্রথমেই বলে রাখা ভাল, আরবদেশে ওহাবী নামাঙ্কিত
কোনো মাযহাব বা অস্তিত্ত নেই। এ সংজ্ঞাটির প্রচলন আরবদেশের বাহিরে এবং এ
মতানুসারীদের বিদেশী দুশমন, বিশেষত তুর্কীদের ও
ইউরোপিয়দের দ্বারা ‘ওহাবী’ কথাটির অর্থ এবং তাদের মধ্যেই প্রচলিত।
হাসান বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ এ সম্পর্কে বলেন,
‘ওয়াহ্হাবিয়্যাহ বিশেষণটি এ আন্দোলনের অনুগামীরা সৃষ্টি করেনি। বরং
তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পৃথক করার জন্য এটা ব্যবহার করে, যেন মানুষ তাদের
সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে এবং শ্রোতারা মনে করে যে, এ আন্দোলন
প্রচলিত বড় বড় চারটি মাযহাবের বিপরীতে পঞ্চম একটি মাযহাব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তবে
এ আন্দোলনের কর্মীরা নিজেদেরকে ‘সালাফী’ এবং তাদের দাওয়াতকে ‘সালাফী দাওয়াত’ বলে আখ্যায়িত করাকেই অধিক পসন্দ করতেন।’’ (হাসান বিন
আব্দুল্লাহ আলে শায়েখ, প্রবন্ধ : আল-ওয়াহ্হাবিয়াহ ওয়া
যাঈমুহা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব, গৃহীত; বৈরূত :
দারুল মা‘রিফাহ, ৩য় প্রকাশ, পৃঃ ৮/৮২১)।
এই ঐতিহাসিক ‘ভুল’
অথবা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ “ওয়হ্হবী
আন্দোলন” নামটি সারাবিশ্বে আজও পাকাপোক্তভাবে বিদ্যমান। ফলে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বের যে দেশেই ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলন তথা নিখাদ তাওহীদের
দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবানকারী আন্দোলন পরিদৃষ্ট হয়, সেখানেই
বিরুদ্ধবাদীরা তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও বিচ্ছিন্ন দল হিসাবে দেখানোর জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ ট্যাগ লাগিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার
অপচেষ্টা চালায়।
Quintan Wiktorowicz আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রশাসনের কাউন্টার টেরোরিজম উপদেষ্টা থাকা কালিন সময় তাঁর গবেষণা পেপার Anatomy of the Salafi Movement-এ লিখেছেন,
Quintan Wiktorowicz আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রশাসনের কাউন্টার টেরোরিজম উপদেষ্টা থাকা কালিন সময় তাঁর গবেষণা পেপার Anatomy of the Salafi Movement-এ লিখেছেন,
‘সালাফী মতবাদের
বিরোধীরা প্রায়ই এ মতবাদকে বহিরাগত প্রভাবজাত মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে সম্বোধন করে। তাদের উদ্দেশ্য এই
মতাবলম্বীদেরকে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের অনুসারী’
হিসাবে পরিগণিত করা। সাধারণতঃ যেসব দেশে সালাফীগণ সংখ্যায় স্বল্প
এবং স্থানীয় অধিবাসীরা ধীরে ধীরে তাদের মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, সেসব দেশে তাদেরকে ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। (
Quintan Wiktorowicz, "Anatomy of the Salafi Movement" in
"Studies in Conflict & Terrorism" USA, Vol. 29, Issue. 3 (2006),
P. 235.)।
শাইখের প্রথামিক শিক্ষাঃ
দশ বছরে পদার্পণ করার পূর্বেই পবিত্র
কোরআন মুখস্থ করেন। নিজ পিতার যিনি হাম্বলী মাযহাবের একজন বিশেষ আলেম ছিলেন, তার
নিকট হতে হাম্বলী মাজহাবের ফিকাহ শিখেন। তারপর বিভিন্ন ওস্তাদের নিকট হাদিস ও
তাফসীর শাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি উয়ায়নাতেই স্বীয় পরিবারের পিতা ছাড়া অন্য
আলেমদের থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিশুকালেই তার মধ্যে বিরল ও অনুপম মেধার
আলামত পরিলক্ষিত হয়। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর,
বুঝশক্তি ছিল খুবই তীক্ষ এবং চিন্তাশক্তি ছিল খুবই গভীর। তার মেধা
দেখে পিতা পর্যান্ত আচর্য হতেন। এ কারণেই তিনি অল্প বয়সেই ইলম অর্জনের প্রতি
আগ্রহী হয়ে উঠেন। শৈশব কালেই তিনি সুদৃঢ় ঈমান ও দ্বীন পালনের প্রতি বিশেষ যত্মবান
ছিলেন। ছোট বেলাতেই তিনি তাফসীর, হাদীছ এবং বিজ্ঞ আলেমদের
কিতাবগুলো প্রচুর অধ্যয়ন করতেন। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের
সুন্নাত এবং সালফে সালেহীনদের আছারই ছিল শাইখের জ্ঞান অর্জনের মূল উৎস। দর্শন,
সুফীবাদ, মানতেক ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে শাইখ
ছিলেন সম্পূর্ণ দূরে। কারণ তিনি যেই পরিবার ও পরিবেশে প্রতিপালিত হন, তা ছিল বিকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা, পাপাচার এবং
কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তরুন বয়সেই হজ্জ্ব আদায় করেন এবং দুই মাস মদীনা
অবস্থান করেন।
বিবাহ ও সন্তানাদিঃ
১১৫৩ হিজরিতে পিতার মৃত্যুর পর তিনি উয়াইনাতে
গমন করেন এবং সেখান কার শ্বাষক উসমান ইবনু হামাদ ইবনু মামারের ফুফু এবং যুবরাজ
আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ এর কন্যা জাওহারাকে বিবাহ করেন। কোন কোর জীবনি লেখক তার
পূর্বের বিবাহের কথা বলেছেন যার কোন ভিত্তি নেই। তার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে কথা
বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। শাইখ
এর ছেলেরা হলঃ হুসাইন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (যিনি বিচারক ও শিক্ষক এবং
নিয়মিত ক্লাস নিতেন), আলী ইবনু মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ( যিনি আলিম ও
দ্বীনদার বিচারকের দায়িত্ব আসলে পালন করেনি), আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ বিন
আব্দুল ওয়াহ্হাব (যিনি আলিম ও বিচারক ছিলেন), ইব্রাহীম ইবনু মুহাম্মাদ বিন আব্দুল
ওয়াহ্হাব (শিক্ষক ও বড় মাপের আলিম) এবং হাসান ইবনু মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব
(যিনি তার পিতার লেখা কিতাবুদ তাওহীদের ব্যাখ্যাসহ অন্যান্য কিতার লেখেন)। শাইখ এর
মেয়ে দুজনের একজন হল আব্দুল আজিজ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু সউদের স্ত্রী । অপর জন হলের
তার বাবার শিষ্য সংস্কার আন্দেলনের পৃষ্ঠপোষক বিশষ্ট আলিম শাইখ হামাদ ইবনে
ইব্রাহীম। (উত্সঃ(শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহ্হাব (রহঃ) জীবন ও কর্ম,
পৃষ্ঠা-৬১, প্রকাশনিঃ বাংলাদেশ ইসলামি সেন্টার, প্রকাশ কাল-২০০৯)।
শাইখের উচ্চা শিক্ষা ও ভ্রমণঃ
উয়ায়নার আলেমদের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত করার
পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হিজায ভ্রমণ করেন। যৌবনে পদার্পন করে তিনি
হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে গমণ করেন। হজ্জ শেষে মদীনায় গিয়ে তিনি শাইখ
আব্দুল্লাহ বিন ইবরাহীম বিন সাইফ নামক প্রখ্যাত আলেমের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন।
অতঃপর তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধির নিকট ইলমে হাদীছের জ্ঞান
অর্জন করেন। পরে তিনি ইরাকের বসরায় গমণ করেন এবং সেখানকার শাইখ মাজমুয়ীর নিকট
তাওহীদ ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। সেখানে থাকা অবস্থাতেই তিনি
শির্ক ও বিদআত বিরোধী প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করেন। ফলে বসরার বিক্ষুদ্ধ বিদআতীরা
তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেয়। কোন কোন লেখক তার বাগদাদ গমন ও সেখানা বিবহ বন্ধনে
আবদ্ধ হবার কথা লিখেন এ সকল বিবরণ ঐতিহাসিকভাবে সমর্থিত নয়। বস্তত্ব তিনি বসরার
বাইরে বাগদাদ, সিরিয়া ও মিশরে কখনও গমন করেনি। (উসমান ইবনু বিশর, উনওয়ান আল মাজদ
ফী তারিখে নজদ পৃষ্ঠা -২৬-২৭)।
বসরা থেকে ফিবে হুরাইমালা ও উয়াইনায়
বসবাস এবং দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশঃ
ইরাকের বসরা থেকে ফিরে এসে শাইখ
প্রথমে তিনি হুরাইমালা শহরে প্রত্যাবর্তন করেন। এবং ইসলামের সঠিক আকিদা প্রচার
করতে থাকেন। তাওহীদের সঠিক ব্যাখ্যা যা সুফিবাদের প্রভাবে বিলীন প্রায় তা
পুরঃরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। দীর্ঘ দিনের চলে আসা শির্ক বিদআতের মুল উত্পাটনের
চেষ্টা চালান যদিও একাজ মোটেও সহজ ছিল না। তার পরও তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে জাহিল
মুর্খ মানুষের আকিদা কবর মাজারে সিজদাহ দেওয়া, মিথ্যা মাবুদের নিকট ধর্ণা দেওয়ার,
গাইরুল্লাহ নামে মানত এবং জবাই দেওয়ার পরিবর্তে একক আল্লাহর প্রতি সকল ইবাদাত খাস
করার তাওহীদি দাওয়াত প্রদান করতে থাকেন। যখই
শাইখ ইসলামে অনুমদিত কবর জিয়ারতের মত একটি সত্কর্মে যে সব বিদআত অনুপ্রবেশ
করে ছিল তার বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেন, তখনই তার বিরুদ্ধে বিরোধীতা শুরু হয়ে
যায়। তার বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন তাকে কষ্ট দিতে থাকে। এমনকি তার পিতা জনরোষের
আশংকায় তার দাওয়াতী কাজ কে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারপরও পিতার মর্জাদা ও
শিক্ষদের প্রতি সম্মান বজায় রেখে সীমাহীর কষ্ট উপেক্ষা করে ধৈর্যের সাথে তার
আন্দোলনের কাজে চালিয়ে নিতে অনঢ় ছিলেন। আস্তে আস্তে তার কাজের খবর ও শিক্ষা দিক্ষা
নজদের চার পাশে আল আরেদ, দারইয়্যাহ, রিয়াদ অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
১১৫৩ হিজরি মুতাবিক ১৭৪০ সালে তার
পিতার মৃত্য হয়। পিতার মৃত্যর পর সাত পাঁচ না ভেবে তার সংস্কারমুখি দাওয়াতি কাজ
পুরা দমে শুরু করেন এবং প্রকাশ্য তিনি দাওয়াত দিতে থাকেন। পাশাপাশি নিয়মিত দারসে
বসেন এবং ওয়াজ নসিয়ত করতে থাকেন। হুরাইমালার অনেক মানুষ তার এই দাওয়াত কবুল করে।
এবং তার আত্মার আত্মীয়তে পরিনত হয়। এই সময়
তিনি তার বিখ্যাত কিতাব “কিতাবুত তাওহীদ” লিখেন।
১১৫৭ হিজরি মুতাবেক ১৭৪৪ সালের দিকে তার
এই দাওয়াত গ্রহনে পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র ও উত্পীড়নের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়।
এমন কি তার বিরুদ্ধবাদী দুষ্ট লোকজন তাকে হত্যা করার পরিকল্পনাও গ্রহন করে। তিনি তখন
ভাবলেন, রাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করা সম্ভব নয়। এ লক্ষে
তিনি হুরাইমালা থাকা অবস্থায়ই উয়াইনার শাসক উছমান ইবনে মা’মারের সঙ্গে চিঠি আদান
প্রদাণ শুরু করেন। এবং যখন তিনি ভাবলে যে, শ্বাষক উছমান ইবনে মামার সত্য গ্রহনে
প্রস্তত আছে তখন তিরি নিজেই উয়াইনার চলে আসেন। উছমান শাইখকে স্বাগত জানালেন। এ সময় তিনি
উসমানের ভাতিজী জাওহারা বিনতু আবদিল্লাহ ইবনু মা’মারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ
হন। এই বিবাহের সূত্র ধরে তিনি ব্যাপক হারে তার দাওয়াতি কাজ করতে থাকেন। এবং বহু
উয়াইন বাসি তার দাওয়াত গ্রহণ করে। উসমানও
তার দাওয়াত কবুল করে বললেন, আপনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে থাকুন। আমরা আপনার সাথে
থাকবো এবং আপনাকে সাহায্য করবো। উছমান এমনি আরো ভালো কথা বললেন,
শাইখের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করলেন এবং তাঁর দাওয়াতের প্রতি সমর্থন
ব্যক্ত করলেন।
উছমানের আশ্বাস পেয়ে শাইখ মানুষকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দান, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ কল্যাণের দিকে আহবান করতে থাকলেন। শাইখের দাওয়াত উয়ায়নার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামের মানুষ শাইখের কাছে আসতে থাকলো এবং নিজেদের ভুল আকীদাহ বর্জন করে শাইখের দাওয়াত কবুল করতে লাগল। এ সময় তিনি নিম্মক্ত সংস্কারমূলক কাজ গুল করেনঃ
উছমানের আশ্বাস পেয়ে শাইখ মানুষকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দান, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ কল্যাণের দিকে আহবান করতে থাকলেন। শাইখের দাওয়াত উয়ায়নার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামের মানুষ শাইখের কাছে আসতে থাকলো এবং নিজেদের ভুল আকীদাহ বর্জন করে শাইখের দাওয়াত কবুল করতে লাগল। এ সময় তিনি নিম্মক্ত সংস্কারমূলক কাজ গুল করেনঃ
ক। যায়েদ বিন
খাত্তাবের কবরের উপর নির্মিত গম্বুজ ধ্বংশ করেনঃ ঐ সময় জুবাইলা নামক স্থানে যায়েদ
বিন খাত্তাব নামে একটি মিনার ছিল। যায়েদ বিন খাত্তাব ছিলেন উমার (রাঃ) এর ভাই।
তিনি মিথ্যুক নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
পরবর্তীতে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকেরা তার কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করে। কালক্রমে তা এক
দেবতা মন্দিরে পরিণত হয়। এতে বিভিন্ন ধরণের মানত পেশ করা হতো এবং কাবা ঘরের ন্যায়
তাওয়াফও করা হতো। সেখানে আরো অনেক কবর ছিল। আশেপাশের গাছপালারও এবাদত হতো।
একদা শাইখ আমীর উছমানকে বললেনঃ চলুন
আমরা যায়েদ বিন খাত্তাবের কবরের উপর নির্মিত গম্বুজটি ভেঙে ফেলি। কেননা এটি
অন্যায়ভাবে এবং বিনা দলীলে নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই কাজের প্রতি কখনই
সন্তুষ্ট হবেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর কোন কিছু
নির্মাণ করতে এবং কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। এই গম্বুজটি মানুষকে
গোমরাহ করছে, মানুষের আকীদাহ
পরিবর্তন করছে এবং এর মাধ্যমে নানা রকম শির্ক হচ্ছে। সুতরাং এটি ভেঙে ফেলা আবশ্যক।
আমীর উছমান বললেনঃ এতে কোন অসুবিধা নেই। অতঃপর উছমান বিন মুআম্মার গম্বুজটি ভাঙ্গার জন্য ৬০০ সৈনিকের একটি বাহিনী নিয়ে বের হলেন। শাইখও তাদের সাথে ছিলেন।উছামানের বাহিনী যখন জুবাইলিয়ার নিকটবর্তী হলো এবং জুবাইলিয়ার অধিবাসীরা জানতে পারলো যে, যায়েদ বিন খাত্তাবের মিনার ভাঙ্গার জন্য একদল লোক আগমণ করেছে তখন তারা গম্বুজটি রক্ষা করার জন্য বের হলো। কিন্তু আমীর উছমান এবং তাঁর সৈনিককে দেখে তারা ফিরে গেল। উছমানের সৈনিকরা গম্বুজটি গুড়িয়ে দিল। শাইখের প্রচেষ্টায় এই মিনারটি ভেঙে ফেলা হয় এবং তিনি শাইখ নিজেও ভাঙ্গার কাজে অংশ নেন।
খ। ব্যভিচারের হদ্দ (শাস্তি) কায়েমঃ উয়ায়নাতে অবস্থানকালে এক মহিলা একদিন তাঁর কাছে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার করে বিচার প্রার্থনা করে। মহিলাটির অবস্থা স্বাভাবিক কি না, তা জানার জন্য তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন, মহলিাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং তার মাথায় কোন পাগলামী নেই, তখন মহিলাটিকে বললেনঃ সম্ভবতঃ জবরদস্তি করে তোমার সাথে এই অপকর্ম করা হয়েছে। সুতরাং তোমার বিচার প্রার্থনা করার দরকার নেই। অবশেষে মহিলাটি জোর দাবী জানালে এবং বার বার স্বীকার করতে থাকলে তিনি লোকদেরকে নির্দেশ দিলে তারা পাথর মেরে মহিলাটিকে হত্যা করে ফেলে। বর্ণিত আছে,উয়াইনার শাসক উছমান ইবনে মা’মারই সর্ব প্রথম মেয়েটিকর পাথর মারেন।
আমীর উছমান বললেনঃ এতে কোন অসুবিধা নেই। অতঃপর উছমান বিন মুআম্মার গম্বুজটি ভাঙ্গার জন্য ৬০০ সৈনিকের একটি বাহিনী নিয়ে বের হলেন। শাইখও তাদের সাথে ছিলেন।উছামানের বাহিনী যখন জুবাইলিয়ার নিকটবর্তী হলো এবং জুবাইলিয়ার অধিবাসীরা জানতে পারলো যে, যায়েদ বিন খাত্তাবের মিনার ভাঙ্গার জন্য একদল লোক আগমণ করেছে তখন তারা গম্বুজটি রক্ষা করার জন্য বের হলো। কিন্তু আমীর উছমান এবং তাঁর সৈনিককে দেখে তারা ফিরে গেল। উছমানের সৈনিকরা গম্বুজটি গুড়িয়ে দিল। শাইখের প্রচেষ্টায় এই মিনারটি ভেঙে ফেলা হয় এবং তিনি শাইখ নিজেও ভাঙ্গার কাজে অংশ নেন।
খ। ব্যভিচারের হদ্দ (শাস্তি) কায়েমঃ উয়ায়নাতে অবস্থানকালে এক মহিলা একদিন তাঁর কাছে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার করে বিচার প্রার্থনা করে। মহিলাটির অবস্থা স্বাভাবিক কি না, তা জানার জন্য তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন, মহলিাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং তার মাথায় কোন পাগলামী নেই, তখন মহিলাটিকে বললেনঃ সম্ভবতঃ জবরদস্তি করে তোমার সাথে এই অপকর্ম করা হয়েছে। সুতরাং তোমার বিচার প্রার্থনা করার দরকার নেই। অবশেষে মহিলাটি জোর দাবী জানালে এবং বার বার স্বীকার করতে থাকলে তিনি লোকদেরকে নির্দেশ দিলে তারা পাথর মেরে মহিলাটিকে হত্যা করে ফেলে। বর্ণিত আছে,উয়াইনার শাসক উছমান ইবনে মা’মারই সর্ব প্রথম মেয়েটিকর পাথর মারেন।
গ। শির্ক বিশ্বাস বরকতপূর্ণ গাছ কেটে
ফেলাঃ এ সময় উয়াইনায় অবস্থিত আল যীর এবং দারইয়ায় অবস্থিত কারইউন নামক বৃক্ষ করে
বরকত মনে করে পুজা করা হত। মানুষের আকিদা সৃষ্টি কর্তার আল্লাহে বাদ দিয়ে গাছের
প্রতি গড়াল। এ সব শির্ক বিশ্বাস শাইখ খবই কষ্ট দিত। এই গাছগুলি তিনি নিজ হাতে কেটে
ফেলেন এবং শিকড়সহ উপড়ে ফেলেন। (উসমান ইবনু বিশর, উনওয়ানুল মাজদ ১/৯-১০)।
তার এই সংস্কারের পাশাপাশি জামাতে
সালা্তের বিধান কায়েম করেন। জামাতে শরীক না হলে শাস্তির বিধান চালু করেন। এই সকল
ভাল আমল এবং বিদআদ বিরোধী কাজ কর্মের ফলে বিদআতী ও পথভ্রষ্টদের মধ্যে ব্যাপক
প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
উয়াইনা থেকে বহিষ্কার এবং দরঈয়ায়
হিজরতঃ
উয়ায়নাতে উছমান বিন মা’মারের
সহযোগিতায় ও সমর্থনে শাইখের সংস্কার আন্দোলন যখন পুরোদমে চলতে থাকে,
তখন “আল আহসার” দুশ্চরিত্র ও বদ মেজাজী প্রভাবশালি শাসক সুলায়মান ইবনু
মুহাম্মদ ইবনু গারীর কাছে এই খবর পৌঁছে গেল। শাইখের বিরোধীরা সুলায়মানকে জানিয়ে
দিল যে, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি
কবরের উপর নির্মিত গম্বুজগুলো ভেঙে ফেলছে এবং ব্যভিচারের শাস্তিও কায়েম করছে।
আহসার আমীর এতে রাগান্বিত হলো এবং সে উয়ায়নার আমীর উছমানকে এই মর্মে পত্র লিখলো যে,
আপনি অবশ্যই এই লোকটিকে (শাইখকে) হত্যা করবেন। অন্যথায় আমরা আপনাকে
খিরাজ (টেক্স) দেয়া বন্ধ করে দিবো।
উল্লেখ্য যে, “আল আহসার”
এই গ্রাম্য অশিক্ষিত শাসক উছমানকে বিরাট অংকের টেক্স প্রদান করতো। তাই উছমান
পত্রের বিষয়টিকে খুব বড় মনে করলেন এবং এই আশঙ্কা করলেন যে, শাইখের
দাওয়াতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখলে আল আহসার খিরাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের পক্ষ
হতে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘেষণারও ভয় রযেছে। তাই তিনি শাইখকে পত্রের বিষয় অবগত করলেন
এবং আহসার শাসকের পত্র মুতাবেক আমরা আপনাকে হত্যা করা সমীচিন মনে করছিনা। আপনাকে
সাহায্য ও সহযোগিতা করাও এখন থেকে আর সম্ভব হবেনা। কারণ আমরা আল আহসার শাসক
সুলায়মানকে খুব ভয় করছি। আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও সক্ষম নই। সুতরাং আপনি যদি
আমাদের কল্যাণ ও আপনার নিজের কল্যাণ চান, তাহলে আমাদের নিকট
থেকে চলে যান।
শাইখ তখন বললেনঃ আমি যেই বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা তো আল্লাহর দ্বীন। এটিই তো কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহএর দাবী। যে ব্যক্তি এই দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করবে, ইহার সাহায্য করবে এবং দৃঢ়তার সাথে এই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করবেন এবং তাঁর শত্র“দের উপর তাকে বিজয় দান করবেন। সুতরাং আপনি যদি ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকেন এবং এই দাওয়াতের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখেন, তাহলে আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে অচিরেই বিজয় দান করবেন এবং এই গ্রাম্য যালেম শাসক ও তার বাহিনী থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। সেই সাথে আল্লাহ আপনাকে তার অঞ্চল ও তার গোত্রের শাসনভার আপনার হাতেই সোপর্দ করবেন। এতে উছমান বললেন, হে সম্মানিত শাইখ! তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই এবং তার বিরোধীতা করার মত ধৈর্যও আমাদের নেই। তাই তিনি উছমানের অনুরোধে বাধ্য হয়ে শাইখ উয়ায়না থেকে বেরিয়ে পড়লেন। এক হিসাবে তাকে বহিষ্কারই করা হয়। এই শাইখ মনে করলেন, দরঈয়ার আমীর মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ তাকে সাহায্য করবে, তাই তিনি উয়াইনা থেকে দরঈয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বলা হয়ে থাকে যে, বের হওয়ার সময় শাইখ পায়ে হেঁটে বের হন। কারণ উছমান শাইখের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করেন নি। তাই সকাল বেলা বের হয়ে সারাদিন পায়ে হেঁটে বিকাল বেলা দরঈয়ায় গিয়ে পৌঁছেন।
শাইখ তখন বললেনঃ আমি যেই বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা তো আল্লাহর দ্বীন। এটিই তো কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহএর দাবী। যে ব্যক্তি এই দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করবে, ইহার সাহায্য করবে এবং দৃঢ়তার সাথে এই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করবেন এবং তাঁর শত্র“দের উপর তাকে বিজয় দান করবেন। সুতরাং আপনি যদি ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকেন এবং এই দাওয়াতের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখেন, তাহলে আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে অচিরেই বিজয় দান করবেন এবং এই গ্রাম্য যালেম শাসক ও তার বাহিনী থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। সেই সাথে আল্লাহ আপনাকে তার অঞ্চল ও তার গোত্রের শাসনভার আপনার হাতেই সোপর্দ করবেন। এতে উছমান বললেন, হে সম্মানিত শাইখ! তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই এবং তার বিরোধীতা করার মত ধৈর্যও আমাদের নেই। তাই তিনি উছমানের অনুরোধে বাধ্য হয়ে শাইখ উয়ায়না থেকে বেরিয়ে পড়লেন। এক হিসাবে তাকে বহিষ্কারই করা হয়। এই শাইখ মনে করলেন, দরঈয়ার আমীর মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ তাকে সাহায্য করবে, তাই তিনি উয়াইনা থেকে দরঈয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বলা হয়ে থাকে যে, বের হওয়ার সময় শাইখ পায়ে হেঁটে বের হন। কারণ উছমান শাইখের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করেন নি। তাই সকাল বেলা বের হয়ে সারাদিন পায়ে হেঁটে বিকাল বেলা দরঈয়ায় গিয়ে পৌঁছেন।
দরঈয়ার আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের সাথে
সাক্ষাতঃ
দরঈয়ায় পৌঁছে শাইখ প্রথম আব্দুল্লাহ
ইবনু আবদির রহমান আল উরাইনির বাড়িতে উঠেন এবং পরে তার এক জন শিষ্য আহমদ ইবনু
সুয়াইলিমের বাড়িতে উঠেন। শাইখের অবস্থানের কারনে বাড়িটি এক সময় তাওহীদের প্রচার ও
দাওয়াতের প্রান কেন্দ্রে পরিনত হয়। সাধারণ জনগন থেকে শুরু করে দরঈয়ার আলেম উলামা
সকলে শাইখের ইলমি জ্ঞান থেকে উপকার পেতে
শুরু করে। এমন কি দরঈয়ার শাসক মুহাম্মাদ ইবনু সঊদের দুই ভাই মিশারী এবং ছানইয়ানের তার
ভক্ত হয়ে যায়, যারা পরবর্তিতে এই আন্দোলনের জন্য বহু শ্রম দেন। শাইখ তার দাওয়াতে
কাজ কখনোও গোপনে করার পক্ষে ছিলেন না। তাই তিনি দরঈয়ার
শাসক মুহাম্মাদ
ইবনু সঊদের সাথে সাক্ষাত করার ইচ্ছ প্রষণ করলেন। মুহাম্মাদ ইবনু সঊদের দুই ভাই
মিলে তার স্ত্রী মাওযা বিনতু আবি ওয়াহতানের সঙ্গে সাক্ষাত
করেন। এই বিদুষী মহিলা ছিলেন অত্যান্ত মেধাবী ও ধর্মভীরু। দুই ভাই মিলে ভাবির কাছে
শাইখের ইলম, আমল আখলাক চরিত্রের ভীষন প্রশংষা করেন। এবং বিষয়টি নিয়ে তাকে তাদের
ভাই দরঈয়ার শাসক মুহাম্মাদ
ইবনু সঊদের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। এই ধর্মভীরু মহিলা তার স্বামী দরঈয়ার শাসক মুহাম্মাদ ইবনু সঊদকে বললেন, “এই ব্যক্তি আপনার নিকট আগমণ
করছেন। তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে গনিমত মনে করে সম্মানিক করা এবং তাকে সার্বিক
সাহায্য সহযোগিতা করা আপনার কর্তব্য”। (উসমান ইবনু
বিশর, উনওয়ানুল মাজদ ১/১১)।
তার স্ত্রী আর বলেন, “আপনার এলাকায়
এমন একজন লোক আগমণ করেছেন, যিনি আল্লাহর দ্বীনের
দিকে মানুষকে আহবান করেন, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের
দিকে দাওয়াত দেন। কত সুন্দর এই গণীমত! সুতরাং আপনি দ্রুত তাকে কবুল করে নিন এবং
তাকে সাহায্য করুন। খবরদার! আপনি কখনই এ থেকে পিছপা হবেন না”।
দরঈয়ার শাসক মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ পূর্বে থেকেই
উন্নদ চরিত্রের লোক ছিলেন। তিনি তাঁর ধর্মভীরু স্ত্রীর
এই মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করলেন। এবং শাইখের প্রতি তার হৃদয়ের গভীরে ভালবাসার
সৃষ্টি হয়। অতঃপর তিনি ইতস্ততঃবোধ করছিলেন। তিনি নিজেই শাইখের কাছে যাবেন?
না শাইখকে নিজের কাছে ডেকে আনবেন? এবারও তাঁর
স্ত্রী তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, শাইখকে আপনার কাছে ডেকে আনা
ঠিক হবেনা। বরং শাইখ যেখানে অবস্থান করছেন, আপনাকেই সেখানে
যাওয়া উচিত। কেননা ইলম এবং দ্বীনের দাঈর সম্মানকে সমুন্নত রাখার স্বার্থেই তা করা
উচিত। আমীর মুহাম্মাদ এবারও তার স্ত্রীর পরামর্শ কবুল করে নিলেন।
দরঈয়ার শাসক মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য মুহাম্মাদ বিন সুওয়াইলিমের বাড়িতে
গেলেন। সেখানে গিয়ে শাইখকে সালাম দিলেন এবং তাঁর সাথে আলোচনা করলেন। পরিশেষে তিনি
বললেনঃ হে শাইখ! আপনি সাহায্যের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, নিরাপত্তার সুসংবাদ গ্রহণ করুন এবং সর্ব প্রকার সাহায্য-সহযোগিতারও
সুসংবাদ গ্রহণ করুন।
জবাবে শাইখও আমীরকে আল্লাহর সাহায্য, বিজয়, প্রতিষ্ঠা এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদ প্রদান করলেন। শাইখ আরো বললেনঃ এটি হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করবে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন, শক্তিশালী করবেন। অচিরেই আপনি এর ফল দেখতে পাবেন।
অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ বললেনঃ হে শাইখ আমি আপনার হাতে বায়আত করবো। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দ্বীনের উপর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমরা যখন আমাকে সমর্থন করবো, আপনাকে সাহায্য করবো এবং আল্লাহ তাআলা যখন শত্র“দের উপর আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন। এবং দরঈয়ার নিয়ম অনুযায়ী আমি তাদের নিকট থেকে ফসল কাটার সময় খারাজ নিয়ে থাকি, আমার ভয় হয় যে, আপনি তা নিষধ করবেন।
শাইখ জবাবে বললেনঃ এমনটি কখনই হবেনা। আমার রক্ত আপনাদের রক্ত আমারই রক্ত, আপনাদের ধ্বংস আমারই ধ্বংস। আপনার শহর ছেড়ে আমি কখনই অন্যত্র চলে যাবোনা। আর আল্লাহ পাক আপনাকে বিজয় দিলে অনেক দেশ জয় করার সুযোগ দিলে দরঈয়ার খারাজ থেকেও বেশী সম্পদ তারচেয়ে বেশী গনিমতের মাল আল্লাহ আপনাকে দার করবেন।
জবাবে শাইখও আমীরকে আল্লাহর সাহায্য, বিজয়, প্রতিষ্ঠা এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদ প্রদান করলেন। শাইখ আরো বললেনঃ এটি হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করবে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন, শক্তিশালী করবেন। অচিরেই আপনি এর ফল দেখতে পাবেন।
অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ বললেনঃ হে শাইখ আমি আপনার হাতে বায়আত করবো। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দ্বীনের উপর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমরা যখন আমাকে সমর্থন করবো, আপনাকে সাহায্য করবো এবং আল্লাহ তাআলা যখন শত্র“দের উপর আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন। এবং দরঈয়ার নিয়ম অনুযায়ী আমি তাদের নিকট থেকে ফসল কাটার সময় খারাজ নিয়ে থাকি, আমার ভয় হয় যে, আপনি তা নিষধ করবেন।
শাইখ জবাবে বললেনঃ এমনটি কখনই হবেনা। আমার রক্ত আপনাদের রক্ত আমারই রক্ত, আপনাদের ধ্বংস আমারই ধ্বংস। আপনার শহর ছেড়ে আমি কখনই অন্যত্র চলে যাবোনা। আর আল্লাহ পাক আপনাকে বিজয় দিলে অনেক দেশ জয় করার সুযোগ দিলে দরঈয়ার খারাজ থেকেও বেশী সম্পদ তারচেয়ে বেশী গনিমতের মাল আল্লাহ আপনাকে দার করবেন।
১১৫৭ হিজরি অথবা ১১৫৮ হিজরি সালে দরঈয়ার শাসক মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ, মুহাম্মাদ
ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের নিকট এই কথার উপর বাইয়াত গ্রহণ করেন যে, তিনি স কাজের আদেশ
ও অস কাজের বাধা দান করবেন এবং আল্লাহ কিতার ও তার রাসূল সাঃ এর সুন্নাত মুতাবিক
আমল করবেন। (উসমান ইবনু বিশর, উনওয়ানুল মাজদ
১/১১-১২)।
এভাবেই ঐতিহাসিক বায়আত সম্পন্ন হলো,
যা পরবর্তিতে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছিল।
শাইখের দাওয়াতের নতুন যুগঃ
এভাবে শাইখের দাওয়াত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। দরঈয়ার আমীরের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করার অঙ্গিকার পেয়ে শাইখ নতুন গতিতে নির্ভয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন। শাইখ মানুষকে আল্লাহ্র পথে ডাকার কাজ করে গেলেন এবং তাদেরকে পথ দেখালেন আল্লাহ্র জন্য ধার্মিক হওয়ার, নীতিবান হওয়ার এবং ভালবাসার। ক্রমান্বয়ে শাইখ খ্যাতি লাভ করা শুরু করলেন। প্রতিবেশী অঞ্চল এবং গ্রাম থেকে মানুষ তার সাথে সাক্ষাৎ কারার জন্য আসতো। তিনিও অনেক আলেমের কাছে চিঠি লিখতেন তাদের সাহায্য চেয়ে এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন আল্লাহ্র দ্বীনের জন্য পুজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার। নাযদ, মক্কাহ্ এবং মদিনা থেকে অনেক আলেম তার আহ্বানে সারা দিয়েছিলেন আবার অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, নিন্দা করেছে তার কাজকে, দোষারোপ করেছে এবং তার থেকে দুরে থেকেছে। আস্তে আস্ত অনেকে তার তাওহীদের মর্মকথা বুঝতে পারে এবং প্রত্যেক অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকেরা দরঈয়ায় আসতে লাগল। শাইখ সম্মান ও ইজ্জতের সাথে এখানে বসবাস করতে লাগলেন এবং তাফসীর, হাদীছ, আকীদাহ, ফিক্হসহ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে র্দাস দানে মশগুল হয়ে পড়লেন। নিয়মিত দারস্ দানের পাশাপশি সমর্থক ও সাথীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে শির্কের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে থাকেন এবং যেসব মাজারে হাদীয়া তোহফা পেশ করা হতো তা একের এক উচ্ছেদ করতে থাকেন। মাজার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। দরঈয়ায় শির্ক উচ্ছেদ করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার একটি উদাহরন হলঃ
এভাবে শাইখের দাওয়াত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। দরঈয়ার আমীরের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করার অঙ্গিকার পেয়ে শাইখ নতুন গতিতে নির্ভয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন। শাইখ মানুষকে আল্লাহ্র পথে ডাকার কাজ করে গেলেন এবং তাদেরকে পথ দেখালেন আল্লাহ্র জন্য ধার্মিক হওয়ার, নীতিবান হওয়ার এবং ভালবাসার। ক্রমান্বয়ে শাইখ খ্যাতি লাভ করা শুরু করলেন। প্রতিবেশী অঞ্চল এবং গ্রাম থেকে মানুষ তার সাথে সাক্ষাৎ কারার জন্য আসতো। তিনিও অনেক আলেমের কাছে চিঠি লিখতেন তাদের সাহায্য চেয়ে এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন আল্লাহ্র দ্বীনের জন্য পুজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার। নাযদ, মক্কাহ্ এবং মদিনা থেকে অনেক আলেম তার আহ্বানে সারা দিয়েছিলেন আবার অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, নিন্দা করেছে তার কাজকে, দোষারোপ করেছে এবং তার থেকে দুরে থেকেছে। আস্তে আস্ত অনেকে তার তাওহীদের মর্মকথা বুঝতে পারে এবং প্রত্যেক অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকেরা দরঈয়ায় আসতে লাগল। শাইখ সম্মান ও ইজ্জতের সাথে এখানে বসবাস করতে লাগলেন এবং তাফসীর, হাদীছ, আকীদাহ, ফিক্হসহ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে র্দাস দানে মশগুল হয়ে পড়লেন। নিয়মিত দারস্ দানের পাশাপশি সমর্থক ও সাথীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে শির্কের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে থাকেন এবং যেসব মাজারে হাদীয়া তোহফা পেশ করা হতো তা একের এক উচ্ছেদ করতে থাকেন। মাজার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। দরঈয়ায় শির্ক উচ্ছেদ করে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার একটি উদাহরন হলঃ
শাইখ জানতে পারলেন যে, দরঈয়ায় একটি খেজুর গাছ রয়েছে, যাকে (الفحل) ফাহল বা
ফাহ্হাল বলা হতো। এই খেজুর গাছের ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল,
কোন মহিলার বিয়ে হতে দেরী হলে কিংবা তাকে বিয়ের জন্য কেউ প্রস্তাব
না দিলে এই খেজুর গাছটির গাছটিকে জড়িয়ে ধরত এবং বলতোঃ “হে সকল পুরুষের সেরা পুরুষ!
বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তোমার কাছে একজন পুরুষ চাই”। তাদের ধারণায়
এভাবে এই গাছকে জড়িয়ে ধরলে অবিবাহিত মহিলাদের দ্রুত বিয়ে হতো এবং বিয়ে হয়ে গেলে
তারা এই গাছকেই বিয়ে হওয়ার কারণ মনে করতো। তাদের মুর্খতা এতদূর গিয়ে পৌঁছেছিল যে,
কোন মহিলা গাছটিকে জড়িয়ে ধরার পর যখন তার বিয়ের প্রস্তাব আসতো,
তখন তারা বলতোঃ তোমাকে এই গাছটি সাহায্য করেছে। অতঃপর শাইখের আদেশে
গাছটিকে কেটে ফেলা হয়। আল্লাহ তাআলা শির্কের এই মাধ্যমটিকে চিরতরে মিটিয়ে দিলেন। এভাবেই
আল্লাহ তাআলা শাইখের দাওয়াতকে দরঈয়াতে সফলতা দান করলেন।
দরঈয়ায় এসে ইসলামের
মুল দাওয়াত তাওহীদের প্রতি আহবান শুনাতে পারলেও আরব উপদ্বীপসহ বিশ্বময় ইসলামের মূল
আহবান সঠিকভাবে পুণরান পৌছান সহজ ছিল না। কারন তখন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক,
সামাজিক ও ধর্মীয অবস্থা খুবই লাজুক ছিল।
সালাফী বা ওয়াহ্হাবী
আন্দোলনের উৎপত্তি ও সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বঃ
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের জম্ম ১১১৫ হিজরিতে হলেও তার এই বরকতময় আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটেছিল মূলত ১১৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে, তার জম্মের ২৮ বছর পর। অতঃপর ১৭৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর আন্দোলন সারা আরবে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ক্রমশঃ জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। (শায়খ সালমান বিন সাহমান, আয-যিয়া আশ-শারেক ফি রাদ্দি শুবহাতিল মাযেক আল-মারেক; রিয়াদঃ ইদারাতুল বুহূছ, ৫ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খৃঃ, পৃঃ ১০)।
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের জম্ম ১১১৫ হিজরিতে হলেও তার এই বরকতময় আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটেছিল মূলত ১১৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে, তার জম্মের ২৮ বছর পর। অতঃপর ১৭৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর আন্দোলন সারা আরবে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ক্রমশঃ জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। (শায়খ সালমান বিন সাহমান, আয-যিয়া আশ-শারেক ফি রাদ্দি শুবহাতিল মাযেক আল-মারেক; রিয়াদঃ ইদারাতুল বুহূছ, ৫ম প্রকাশ, ১৯৯৪ খৃঃ, পৃঃ ১০)।
তিনি তাওহীদের
পবিত্র দাওয়াত নিয়ে যখন আরব সমাজে নেমেছিলেন, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তখন মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অতীব
নাজুক। সার্বিক অবস্থা ছিল এতই দুর্দশাগ্রস্ত ও কলুষিত যে, বহু
ক্ষেত্রে তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছিল। নিম্নে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি সংক্ষিপ্তাকারে পেশ হ’ল।
রাজনৈতিক অবস্থা :
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তুরস্কের ওছমানীয় খেলাফত, পারস্যের ছাফাভী এবং ভারতের মোগল-এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য।
ওছমানীয় সাম্রাজ্য : প্রতাপশালী ওছমানীয় সাম্রাজ্যের শাসকগণ তখন এতই দুর্বল হয়ে পড়েন যে, তারা মন্ত্রী পরিষদ ও ভঙ্গুর সেনাবাহিনী প্রধানদের হাতের পুতুলে পরিণত হন, যারা রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মোটেও অভিজ্ঞ ছিলেন না। বিভিন্ন অঞ্চলে যারা গভর্নর হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন তারাও ছিলেন দুর্বলচেতা ও প্রশাসন পরিচালনায় অদক্ষ। জনগণের কাছ থেকে কর আদায় ছাড়া তাদের আর কোন চিন্তা ছিল না। সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ায় ওছমানীয় সাম্রাজ্য প্রায় সর্বদিক থেকে ইউরোপীয়দের কব্জাভূত হয়ে পড়ে এবং একের পর এক অঞ্চল ইউরোপীয়দের ভাগবাটোয়ারার শিকার হ’তে থাকে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত তিউনিসিয়া, আলজেরিয়াতেও বিরাজ করছিল একই অবস্থা। মরক্কোতে চলছিল সা‘দ বংশের শাসন। তারাও স্প্যানিশ ও পর্তুগীজদের হামলার ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকত। আর আরব ও বার্বারসহ বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধ তো লেগেই ছিল। (ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সালমান, প্রবন্ধ; হাক্বীক্বাতু দাওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, মাজাল্লাতুল বুহূছ আল-ইসলামিয়াহ, পৃঃ ১২৮) ।
পারশ্য বা ছাফাভী সাম্রাজ্য : প্রায় আড়াইশ বছর রাজত্ব করার পর পারস্য তথা ইরানের ছাফাভী সাম্রাজ্য তখন আফগানদের দখলে চলে যায়। ১৭২৯ সালে ক্ষমতায় আরোহন করেন আফগান শাসক নাদির শাহ। তিনি নিজেকে সাম্রাজ্যের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে রাজত্বের সীমানা বাড়াতে থাকেন এবং আরব সাগর থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত তাঁর রাজত্বের সীমানা বিস্তৃত করেন। ১৭৪৭ তাঁর মৃত্যু হ’লে সাম্রাজ্য জুড়ে শুরু হয় বিশৃংখলা। ১৭৮৮ সালে কাজার বংশ ক্ষমতা দখলের আগ পর্যন্ত এই অরাজক অবস্থা চলতে থাকে।
মোগল সাম্রাজ্য : মোগল সাম্রাজ্যের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। আমীর-ওমারাদের গৃহযুদ্ধে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হ’তে থাকে। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরই মূলতঃ বৃটিশদের হাতে এর চূড়ান্ত পতন ঘটেছিল। মোগলদের সাম্রাজ্য ভারত উপমহাদেশ সম্পুর্ণ বৃটিশদের হাতে চলে যায় এবং মুসলিমদ আলেমদের উপর চরম নির্যাতণ শুরে করে। অনেক কে হত্যা করে আলেমদের কেউবা আবার হিজরত করে মক্কা মদীনা চলে যায়।
ধর্মীয় অবস্থা :
মুসলমানদের ধর্মীয় অধঃপতনের সূচনা অবশ্য আরো কয়েকশত বছর পূর্বেই হয়েছিল, যখন মুসলিম সমাজে যিন্দীক তথা অন্তরে কুফরী গোপন রেখে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণকারী সম্প্রদায়ের উদ্রব ঘটে। ইসলামী খিলাফতের স্বর্ণযুগে এসব ভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যক্তিদের গোপন ষড়যন্ত্র এবং তাদের আমদানী করা বিষাক্ত চিন্তা-দর্শন ইসলামী আক্বীদা-আমলের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলিম সমাজ নানা ফেরকা ও মাযহাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে এই অধঃপতনের ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের পতন যখন আসন্ন হয়ে উঠে, তখন পরিস্থিতি হয়ে পড়ে আরো নাজুক। বিশেষতঃ আলেম-ওলামার মন-মগজে চেপে বসে এক ধরনের জমাটবদ্ধতা, কূপমন্ডকতা আর এক অন্ধ ঐতিহ্যপ্রিয়তা। আযহারী হোক বা হেজাযী হোক অধিকাংশ ওলামা এই দুর্দশায় নিপতিত ছিলেন।
ধর্মীয় এই অধঃপতনের পিছনে শাসকসমাজের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা কোনরূপ সংস্কারধর্মী ও সংশোধনমূলক চিন্তাকে স্বাগত জানাতেন না; বরং এরূপ চিন্তাধারার লোকদের তারা প্রায়শই কাফের বলে সাব্যস্ত করতেন। যেমনভাবে তারা ওয়াহ্হাবী আন্দোলনকেও ইসলাম বহির্ভূত সাব্যস্ত করেছিলেন। অথচ অপরদিকে তারা বিদ‘আতী ও ছূফীদের বিশেষভাবে প্রশ্রয়দান করেন, যাতে ছূফীদের প্রতি অনুরক্ত জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ফলে ছূফীবাদীরা একই সাথে শাসক ও জনগণের প্রশ্রয় পেয়ে তাদের বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমল প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র পেয়ে যায়। এমনকি তাদের কেউ কেউ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার দায়িত্বও পেয়ে যায়। এভাবে তাদের দৌরাত্ম্যে ওছমানীয় খেলাফতের সর্বত্র শিরক ও বিদ‘আতের বাধাহীন প্রসার ঘটে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো থেকে তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক আক্বীদা-আমল বিলীন হ’তে থাকে। বিভিন্ন দেশে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ওলী-আওলিয়াদের সুরম্য মাযার। এসব কবর-মাযারের প্রাচুর্য মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে সরিয়ে নিয়ে ওলী-আওলিয়ামুখী করে তুলে। আল্লাহর পরিবর্তে মাযারের ওলীর উপরই তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেখানে গিয়ে দো‘আ-দরূদ, নযর-নেওয়ায, কুরবানী ইত্যাদি পেশ করতে থাকে। আর নানা অলীক ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কারের তো কোন ইয়ত্তা ছিল না। ফলে কবর-মাযার সংস্কৃতির প্রভাব হেজায ও ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরাক, মিসর, পশ্চিম আফ্রিকা ও পূর্বপ্রাচ্য পর্যন্ত ইসলামী বিশ্বের সর্বত্রই বাধাহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ শিরক ও বিদ‘আতকেই ইসলাম ভেবে একনিষ্ঠতার সাথে পালন করতে থাকে। ফলে তাদের জীবনাচরণে তাওহীদ ও সুন্নাতের খুব সামান্য নিদর্শনই অবশিষ্ট ছিল। (হাকীকাতু দা‘ওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, পৃঃ ১২৯)।
মুসলমানদের ধর্মীয় অধঃপতনের সূচনা অবশ্য আরো কয়েকশত বছর পূর্বেই হয়েছিল, যখন মুসলিম সমাজে যিন্দীক তথা অন্তরে কুফরী গোপন রেখে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণকারী সম্প্রদায়ের উদ্রব ঘটে। ইসলামী খিলাফতের স্বর্ণযুগে এসব ভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যক্তিদের গোপন ষড়যন্ত্র এবং তাদের আমদানী করা বিষাক্ত চিন্তা-দর্শন ইসলামী আক্বীদা-আমলের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলিম সমাজ নানা ফেরকা ও মাযহাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে এই অধঃপতনের ধারা অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওছমানীয় সাম্রাজ্যের পতন যখন আসন্ন হয়ে উঠে, তখন পরিস্থিতি হয়ে পড়ে আরো নাজুক। বিশেষতঃ আলেম-ওলামার মন-মগজে চেপে বসে এক ধরনের জমাটবদ্ধতা, কূপমন্ডকতা আর এক অন্ধ ঐতিহ্যপ্রিয়তা। আযহারী হোক বা হেজাযী হোক অধিকাংশ ওলামা এই দুর্দশায় নিপতিত ছিলেন।
ধর্মীয় এই অধঃপতনের পিছনে শাসকসমাজের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা কোনরূপ সংস্কারধর্মী ও সংশোধনমূলক চিন্তাকে স্বাগত জানাতেন না; বরং এরূপ চিন্তাধারার লোকদের তারা প্রায়শই কাফের বলে সাব্যস্ত করতেন। যেমনভাবে তারা ওয়াহ্হাবী আন্দোলনকেও ইসলাম বহির্ভূত সাব্যস্ত করেছিলেন। অথচ অপরদিকে তারা বিদ‘আতী ও ছূফীদের বিশেষভাবে প্রশ্রয়দান করেন, যাতে ছূফীদের প্রতি অনুরক্ত জনগণের কাছে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ফলে ছূফীবাদীরা একই সাথে শাসক ও জনগণের প্রশ্রয় পেয়ে তাদের বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমল প্রচারের উর্বর ক্ষেত্র পেয়ে যায়। এমনকি তাদের কেউ কেউ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার দায়িত্বও পেয়ে যায়। এভাবে তাদের দৌরাত্ম্যে ওছমানীয় খেলাফতের সর্বত্র শিরক ও বিদ‘আতের বাধাহীন প্রসার ঘটে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো থেকে তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক আক্বীদা-আমল বিলীন হ’তে থাকে। বিভিন্ন দেশে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ওলী-আওলিয়াদের সুরম্য মাযার। এসব কবর-মাযারের প্রাচুর্য মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে সরিয়ে নিয়ে ওলী-আওলিয়ামুখী করে তুলে। আল্লাহর পরিবর্তে মাযারের ওলীর উপরই তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সেখানে গিয়ে দো‘আ-দরূদ, নযর-নেওয়ায, কুরবানী ইত্যাদি পেশ করতে থাকে। আর নানা অলীক ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কারের তো কোন ইয়ত্তা ছিল না। ফলে কবর-মাযার সংস্কৃতির প্রভাব হেজায ও ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরাক, মিসর, পশ্চিম আফ্রিকা ও পূর্বপ্রাচ্য পর্যন্ত ইসলামী বিশ্বের সর্বত্রই বাধাহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ শিরক ও বিদ‘আতকেই ইসলাম ভেবে একনিষ্ঠতার সাথে পালন করতে থাকে। ফলে তাদের জীবনাচরণে তাওহীদ ও সুন্নাতের খুব সামান্য নিদর্শনই অবশিষ্ট ছিল। (হাকীকাতু দা‘ওয়াতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব ওয়া আছরুহা ফিল ‘আলামিল ইসলামী, পৃঃ ১২৯)।
লোথ্রোব
স্টোডার্ড সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে এভাবে চিত্রিত করেছেন,
‘দ্বীনে ইসলাম তখন হারিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ আবরণীর অন্তরালে। ইসলামের
বার্তাবাহক রাসূল (ছাঃ) দুনিয়ার বুকে যে একত্বের নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন, তা আবৃত হয়ে পড়েছিল ছূফীবাদের খোলসে ও কুসংস্কারে বিস্তৃত চাদরে।
মসজিদগুলো হয়ে পড়েছিল মুছল্লীশূন্য। সমাজে মূর্খ দ্বীন প্রচারক ও ফকীর-দরবেশের দল
ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যারা গলায় তাবীয-কবজ-তসবীহ
ঝুলিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। তারা মানুষের মধ্যে মিথ্যা- অলীক, রহস্যময় সব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে তথাকথিত ওলী-আওলিয়াদের কবরে
তীর্থযাত্রার জন্য প্ররোচিত করত এবং কবরে দাফনকৃত মানুষগুলোর শাফা‘আত বা সুফারিশ লাভের মিথ্যা প্রলোভন দেখাত।...খোদ মক্কা ও মদীনার অবস্থাও
ছিল মুসলিম বিশ্বের আর সব এলাকার মতই। যে পবিত্র হজ্জকে আল্লাহ সামর্থ্যবানদের উপর
অপরিহার্য করেছিলেন, তা নিছক এক ঠাট্টা-বিদ্রূপের অনুষ্ঠানে
পরিণত হয়েছিল। মোটকথা মুসলমানরা আত্মপরিচয় হারিয়ে যেন পরিণত হয়েছিল অমুসলিমে। পতিত
হয়েছিল অধঃপতনের অতল তলে। যদি ইসলামের বার্তাবাহক এই যুগে আবার পৃথিবীতে ফিরে
আসতেন এবং ইসলামের এই দুরবস্থা দেখতেন, তবে অবশ্যই তিনি
ক্রোধে ফেটে পড়তেন এবং এসবের জন্য যারা দায়ী, তাদেরকে মুরতাদ
ও মূর্তিপূজকদের মতই লা‘নত করতেন। (হাযেরুল ‘আলামিল ইসলামী, ১/২৫৯ পৃঃ)।
শাইখের কর্ম বা দাওয়াতের সফলাতা
যুগঃ
আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরকে তাওহীদের
জ্ঞান অর্জন ও তা বাস্তবায়নের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই সাথে যেসব বিষয়
তাওহীদের বিপরীত এবং যা মানুষের তাওহীদকে নষ্ট করে দেয় সেসব বিষয় সম্পর্কেও শাইখ
গভীর পারদর্শিতা অর্জন করেন। সে সময়ের দরঈয়ার শাসক সম্প্রদায়ও শাইখের দাওয়াতকে
কবুল করে নেন এবং সাহায্য করেন। যদিও তারা দীর্ঘ দিন শির্ক বিদআতে নিমজাজ্জিত
থাকার কারনে সত্য গ্রহনে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিল। শাসক শ্রেণীর মধ্যে যারা প্রথম
দিকে তার দাওয়াত গ্রহন করেন তাদের মধ্যে ছিল মুহাম্মাদ ইবনু সঊদ তিন ভাই ছাহিয়ান
ইবনু সঊদ (মৃত ১১৮৬ হিজরী), মিশারী ইবনু সঊদ (মৃত ১১৮৯ হিজরী) এবং ফারহান ইবনু সঊদ
(হুসাইন ইবনু গান্নাহ ১/৯৪; ১/১০৫)।
মুহাম্মদ ইবনে সাউদ তিনি তার ক্ষমতা
এই মাহন আন্দোলনে কাজে লাগান। অপর দিকে, শাইখের দাওয়াত নতুন গতি পেয়ে দ্রুত
প্রসারিত হতে থাকে। বিশেষ করে তারা আশপাশের শহর এবং গোত্রগুলোতে দ্রুততার সাথে
প্রচার কাজ শুরু করে এবং তাওহীদের দাওয়াত কবুল করে নেয়। এই আন্দোলনের
একেবারে শুরুতেই যে কাজটি করা হয় তাহলো উয়াইনা’য় সাহাবাদের এবং আওলিয়াদের মাযারগুলোকে কেন্দ্র করে যে শির্ক কাজ হত তার
মূল উৎপাতণ করা। তিনি তার দাওয়াতে সকলকে বলে দিলেন, আল্লাহর অলিদের নিকট সাহায্যের
জন্য শরণাপন্ন হওয়া শির্ক এবং মূর্তিপূজার মতো অপরাধ। এবং যারা একাজ
করবে তাদেরকে তিনি মুসরিক বলে সাব্যস্ত করবেন। শাইখ তাওহীদের
দাওয়াতকে পুনরুজ্জিবীত করার জন্য সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নবী-রাসূলদের
দাওয়াতের মূল বিষয় তথা তাওহীদে উলুহীয়াতের দাওয়াত দেয়ার শুরু করেন এবং শির্ক ও
বিদআতের প্রতিবাদ করেন। তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি তাঁর একাধিক ইলমী মজলিস
ছিল। প্রতিদিন তিনি তাওহীদ, তাফসীর, ফিকাহ এবং অন্যান্য বিষয়ে একাধির দারস্ প্রদান করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর
দাওয়াতের মধ্যে বরকত দান করলেন। ধীরে ধীরে আরব উপদ্বীপের লোকেরা তাঁর দাওয়াত কবুল
করে শির্ক, বিদআত ও কুসংস্কারের অন্ধকার পরিহার করে তাওহীদের
আলোর দিকে ফিরে আসতে থাকল। তাঁর বরকতময় দাওয়াত অল্প সময়ের মধ্যেই আরব উপদ্বীপের সীমা পার হয়ে
ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরোক্ক, ভালতবর্ষসহ পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই পৌঁছে যায়। যার ফলে নজদ এবং নজদের
বাইরে তাদের বহু যুদ্ধ করেতে হয়েছে। ইয়েমেন, হেজাজ, সিরিয়ার উপকণ্ঠ, ইরাকে
তারা যতগুলি অভিজান চালনা করেছিল তার মুল কারণ ছিল শির্ক ও বিদআতকে সমূলে ধ্বংশ
করা। ফলে তিনি ১২শ শতকের মুজাদ্দেদ তথা তাওহীদের দাওয়াতের সংস্কারক উপাধিতে ভূষিত
হন। বর্তমানে সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বে যেই তাওহীদের দাওয়াত চলছে, শাইখের দাওয়াতের দ্বারাই প্রভাবিত।
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব মুসলিম সমাজ থেকে বিকৃত ইসলামকে বিতাড়িত
করতে একদল মর্দ্দে মুজাহিদ তৈরী করেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ইসলাম বিবর্জিত
বাদশাহদের হঠিয়ে খেলাফত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। এরপর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব
সুসজ্জিত মাজার ভেঙ্গে মাজার পূজা বন্ধ করেন। তুর্কিরা অনেক সময় দুঃচরিত্রা নারী
নিয়ে হজ্বে আসত তার দাওয়াতের ফলে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মক্কা মদিনার পবিত্র স্থান সমূহ প্রচলিত শির্ক-বেদা’তের
মুলোৎপাটন করেন। তার আমলে বিজিত প্রদেশগুলোতে তিনি ইসলামী রীতি নীতি প্রর্বতন
করেন। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাবের মৃত্যুর পরে তার অনুসারীরা ক্ষমতা হারাবার
পূর্ব পর্যন্ত প্রদেশগুলোতে ইসলামী রীতি নীতি প্রচলন রাখেন। যুগে যুগে যখনই কোন
শ্রেণি বা গোষ্ঠি মানুষকে প্রকৃত ইসলামের দিকে আহ্বান করে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্ঠার
মাধ্যমে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তখনই
তাদের ওপর তৎকালীন শাসক শ্রেণির নির্যাতন নেমে এসেছে। সে সময় কায়েমী স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে এক শ্রেণির
আলেম ও প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবি সরকারের পক্ষ নেয়। এই শ্রেণি ইসলামের প্রকৃত
অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফতোয়া জারি করে এবং তাদের আন্দোলনকে স্তিমিত করতে
নানা রকমের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু এই মহান কাজে বিদআতিদের কোর প্রতি
বন্ধকতা কোর কাজে আসেনি। আল্লাহর অসীম রহমতে তার তাওহীদ কালেমা আবার বিশ্বব্যাপি
আওয়াজ তুলতে সমর্থ হয়ে ছিল।
শাইখের চারিত্রিক গুণাবলীঃ
আমানতদারী,
সত্যবাদিতা, মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ,
দানশীলতা, ধৈর্যশীলতা, দূরদর্শিতা,
দৃঢ়তা এবং তার মধ্যে আরো এমন চারিত্রিক উন্নত ও বিরল গুণাবলীর
সমাহার ঘটেছিল, যা তাকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেছিল।
ইতিহাসে যে সব মহাপুরুষ স্বীয় কর্মের মাধ্যমে প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছেন তাদের খুব
অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যেই এই চারিত্রিক গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার্থীদের জন্য
তিনি খুব বিনয়ী ছিলেন, সায়েল ও অভাবীদের প্রয়োজন পূরণে বিশেষ
তৎপর ছিলেন। তাঁর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে কঠোরতা, অজ্ঞতা এবং
দ্বীন পালনে দুর্বলতা ইত্যাদি যেসব অভিযোগ করে থাকে, শাইখ
ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
শাইখের দাওয়াতের মূলনীতিঃ
পরিশুদ্ধ ইসলামী মানহাজ এবং দ্বীনের
সঠিক মূলনীতির উপর শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দাওয়াতের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
ছিল, এবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেস করা,
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে
সামনে যে সমস্ত মূলনীতির ভিত্তিতে শাইখের দাওয়াতী কর্মতৎপরতা পরিচালিত হতো,
নিম্নে তা থেকে কয়েকটি মূলনীতি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১) মানুষের অন্তরে তাওহীদের শিক্ষা
বদ্ধমূল করা এবং শির্ক ও বিদআতের মূলোৎপাটন করা। মুসলিমদের অন্তরে এই মূলনীতিকে
সুদৃঢ় করার জন্যই তিনি প্রয়োজন পূরণের আশায় কবর যিয়ারত করা,
কবরবাসীর কাছে দুআ করা, কিছু চাওয়া, রোগমুক্তি ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার লাভের আশায় তাবীজ ঝুলানো, গাছ ও পাথর থেকে বরকত গ্রহণ করা, আল্লাহ্ ছাড়া
অন্যের জন্য পশু যবেহ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য মানত
করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে আশ্রয় চাওয়া, কবর পূজা করা, আল্লাহ ও বান্দার মাঝে উসীলা নিধারণ
করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়ার কাছে
শাফাআত চাওয়াসহ যাবতীয় শির্ক কর্জন করার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
২) নামায কায়েম করা,
সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাসহ দ্বীনের অন্যান্য ফরয ও নিদর্শনগুলো
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। যার ফলে শির্ক বিদআত এবং অপসংস্কৃতি থেকে মুসলীমগর চিরতরে
রক্ষা পাবে।
৩) সমাজে ন্যায় বিচার ও অন্যান্য
ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর হদ্দ তথা নির্ধারিত দন্ডবিধি কায়েম করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়ের ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা।
৪) তাওহীদ,
সুন্নাহ, ঐক্য, সংহতি,
সম্ভ্রম, নিরাপত্তা এবং ন্যায় বিচারকে
মূলভিত্তি করে একটি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যে সমাজের মুসলীম
জনগোষ্ঠী ইসলামকে এক মাত্র জীবন বিধান মেনে নেবে এবং তারই আলোকে ইবাদত করবে ও
রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
যে সমস্ত অঞ্চলে শাইখের দাওয়াত
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আরব উপদ্বীপের যেই এলাকাগুলো এই দাওয়াতের দ্বারা সরাসরি
প্রভাবিত হয়েছে, সেখানে উপরোক্ত
মূলনীতিগুলোর সবই বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সংস্কার আন্দোলনের পতাকাবাহী সৌদি আরবের
প্রতিটি স্তরেই এর প্রভাব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই দাওয়াত যেখানেই প্রবেশ
করেছে, সেখানেই তাওহীদ, ঈমান, সুন্নাত, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রবেশ করেছে। এতে
আল্লাহর ওয়াদা ও অঙ্গিকার বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا
الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ
مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ
وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا
يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ
الْفَاسِقُونَ
“তোমাদের মধ্যে যারা
বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা
দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবেন। যেমন
তিনি প্রতিষ্ঠা দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন
তাদের সেই দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং
তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার এবাদত
করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য”। (সূরা হজ্জঃ ৫৫)
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ
لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (৪০) الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا
الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ
الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
“যারা আল্লাহ্র সাহায্য করে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহ্র হাতে”। (সূরা নূরঃ ৪০-৪১)।
“যারা আল্লাহ্র সাহায্য করে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহ্র হাতে”। (সূরা নূরঃ ৪০-৪১)।
শাইখের
দাওয়াত বা সংস্কারের উত্সঃ
এই মহতি সংস্কার আন্দোলনের উত্স হিসাবে তিনি নিজের বুদ্ধি,
বিবেক, যুক্তির উপর নির্ভর করে পরিচালিত করেনি কারন মানুষের যুক্তি ও বিবেক
ভূলত্রুটির উর্ধে নয়। তাই তিনি কুরআন, সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
ও আছার আল সালাফ এই তিনটি উত্স থেকে জ্ঞান নিয়ে সংস্কার চালান।
একঃ
কুরআনঃ কুরআনুর কারিম ইসলামী শরিয়তের মুল উত্স। তিনি তার এই সংস্কার
আন্দোলনের উত্স হিসাবে কুরআকেই গ্রহন করে।
তিনি তার বিভিন্ন লেখার প্রতি কথার প্রমান হিসাবে কুরআনেন আয়াত উদৃতি দিয়েছেন। তিনি
তার লেখা “উসুলুল ঈমান” কিতাবে একটি অধ্যায়ের নাম দেন “ আল্লাহে কিতাবের ব্যাপার
অসিয়ত। কুরআনের প্রতি তার বিশ্বাসে ধারনা দিতে গিয়ে তিনি আল কাসিম এলাকার লোকদের
উদ্দেশ্যে এক পত্রে লিখেনঃ আমি বিশ্বাস করি কুরআন আল্লাহ কালাম। কুরআন সৃষ্ট বস্তু নয়। আল্লাহর নিকট
থেকে নাজিল হয়েছে, তার নিতট প্রত্যাবর্তণ করবে। প্রকৃত পক্ষে কুরআন আল্লাহ কথা।রূপক কথা নয়। তিনি তা তার
বান্দা, রাসূল, যিনি তার ও তার বান্দাদের
মাঝে বিশ্বস্ত, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর
নাযিল করেছেন।
দুইঃ
সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাত হল ইসলামী শরিয়তের দ্বিতীয় উত্স।
ছোট সময় থেকেই তিনি কুরআনের পাশাপাশি হাদিস শিক্ষার প্রতি নজর দেন। যার প্রমান তার
লেখায় কুরআনের উদৃতির সাথে সথে অসংখ্যা
হাদিসের উদৃতি। তিনি তার লেখা “উসুলুল ঈমান” কিতাবে একটি অধ্যায়ের নাম দেন “
সুন্নাতে রাসূল আকড়ো ধরার প্রতি রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্সাহ
দান”। তিনি পাঠদের সুবিধার জন্য সহিহ
বুখারির প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা “ফাতহুল বারি’ ও “সীরাতে ইবনু হিসাম” কিতাব দুটির সার
সংক্ষেপ রচনা করছেন।
তিনঃ আছার আল সালাফঃ শাইখ মুহাম্মাদ কুরআন ও সুন্নার পাশাপাশি আল্লহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক সনদ প্রাপ্ত সালফে সালেহিন অর্থাৎ সাহাবি রাঃ, তাবিঈন,
তাবে তাবিঈন থেকে প্রাপ্ত সহিহ আসার সমুহের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। বিশেষ করে
প্রসিদ্ধ চারজন ইমামঃ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহম্মেত ইবনু
হাম্মল। তার কিতাবে তার লেখার স্বপক্ষে এই চার ইমামের বহু উদৃতি পাওয়া যায়। তিনি
ইমাম আহম্মেত ইবনু হাম্মল (মৃঃ ২৪১ হিজরি), ইমাম ইবনু তাইমিয় (মৃঃ ৭২৮ হিজরি) এবং
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু কাইয়্যেম (মৃঃ ৭৫১ হিজরি) খুর বেশী প্রভাবিত ছিলেন। যার
স্বাক্ষর তিনি তার দাওয়াতি কর্মসূচি, চিন্তা চেতনা, মতামত এবং তার কিতাবাদিতে যার
প্রমাণ সুষ্পষ্টভাবে বিদ্যামান।
শাইখের বিরোধীতা ও তার উপর মিথ্যাচারঃ
শাইখ যখন জনপ্রিয়তা লাভ
করতে লাগল তার শিক্ষকতার দ্বারা, বিশ্ব
ব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া তার লেখার জনপ্রিয়তার দ্বারা, তখন
হিংসার ফলে অনেক দল বের হল তার বিরোধিতার জন্য। একদল ভণ্ড আলেম বের হল যারা সত্যকে
মিথ্যা মনে করত এবং মিথ্যাকে সত্য মনে করত। তারা কবর বাঁধাই করা এবং কবরের ব্যক্তিদের
কাছ থেকে চাওয়া ইসলামে বৈধ মনে করত। দ্বিতীয় দলের কাছে সঠিক জ্ঞান ছিল কিন্তু
তারা শাইখের কাজকে গুরুত্ব দেয়নি। তারা অন্যদের বিশ্বাস করত এবং শাইখ থেকে দূরে
থাকত। তৃতীয় দল যারা শেইখের বিরোধিতা করেছিল, তারা ভয়
পাচ্ছিল যে তাদেরকে বাদ দেওয়া হবে তাদের অবস্থান এবং পদ থেকে। তারা শাইখের
অনুসারীদের সাথে নম্র ব্যাবহার করেছে যেন অনুসারীরা তাদের অবস্থান থেকে উচ্ছেদ না
করে এবং তাদের এলাকা দখল না করে।
কেউ
তার বিরোধিতা করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে, কেউ রাজনীতির দোহাই দিয়ে, যদিও তারা দাবি করত তারা
শিক্ষিত, ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানী, কিন্তু
অন্যরা যারা শাইখের সাথে শত্রুতা করেছে তাদের কাছে প্রচার করত যে শাইখ ঐক্য নষ্ট
করছে, বিভিন্ন ভাগ তৈরির মাধ্যমে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার বিরোধীরা বলেছে তিনি
খারেজী দলভুক্ত। অনেকে তাদের অজ্ঞতা বশত তার নিন্দা করেছে ইত্যাদি। এভাবেই কথা
যুদ্ধ চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক এবং ঝগড়ার মাধ্যমে। তিনি তাদের কাছে চিঠি লিখতেন,
তারা আবার উত্তর দিত, এবং তিনি আবার পাল্টা
উত্তর দিতেন। এভাবেই একাধিক প্রশ্ন এবং উত্তর জমানো হয় এবং তা বিভিন্ন খণ্ডে
সংরক্ষণ করা হয়। আর আলহামদুলিল্লাহ্, অধিকাংশ গুলিই ছাপা
হয়েছে। এরপর শেইখ জিহাদের দিকে অগ্রসর হন ১১৫৮ হিজরিতে, তিনি
বিভিন্ন লোকের কাছে চিঠি লিখে দাওয়াত দিতেন জিহাদে অংশ গ্রহণ করার জন্য এবং
পুজাতন্ত্র দূর করার জন্য যা তাদের অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল।
সত্যের অনুসারী এবং সত্যের পথে যারা
আহবান করেন, তারা কোন যুগেই
বাতিলপন্থীদের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্র“তা ও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। যেমন রেহাই পান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ
বান্দা নবী-রাসূলগণ। আমাদের সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) যখন
সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন এবং সাহসিকতা ও বলিষ্ঠতার সাথে শির্ক, বিদআত ও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক কুসংস্কারের প্রতিবাদ শুরু করেন,
তখন বিদআতী আলেমরা তাঁর ঘোর বিরোধীতা শুরু করে। আর করবে না কেন, এটাতো
নবীদের সুন্নত। তাঁর
বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করে। এমনকি এক শ্রেণীর
স্বার্থান্বেষী লোক সমসাময়িক শাসকদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতেও
দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁকে একাধিকার হত্যা করারও প্রচেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিরোধীদের
সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়। আল্লাহর ইচ্ছা অতঃপর শাইখের সৎসাহস ও নিরলস কর্ম তৎপরতার
মুকাবেলায় বিরোধীদের সকল প্রচেষ্টাই বর্থ হয় এবং আল্লাহর দ্বীন ও তাওহীদের দাওয়াতই
বিজয় লাভ করে।
শাইখের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার
জবাবঃ
বিদআতীদের পক্ষ হতে শাইখের বিরুদ্ধে
সে সময় অনেকগুলো অভিযোগ পেশ করা হয়ে থাকে। সম্ভবতঃ বর্তমানকালেও তার বিরুদ্ধে এই
অভিযোগগুলো ছাড়া অন্য কোন অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অভিযোগগুলো নিম্নরূপঃ
প্রথম অভিযোগঃ শাইখ অলী-আওলীয়াদের কবরে মানত পেশ করা ও কবরকে সম্মান করা এবং কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা বন্ধ করে দিয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু যবেহ করা হারাম করেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া, শাফাআত চাওয়া এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলা দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
জবাবঃ আসলে এইগুলো কোন অভিযোগের আওতায় পড়েনা। এগুলো এমন বিষয়, যা কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল দ্বারাই হারাম করা হয়েছে। তাঁর পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) এ ধরণের শির্ক-বিদআতের জেরালো প্রতিবাদ করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে সেও বুঝতে সক্ষম হবে যে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বীনের সঠিক শিক্ষা না থাকার কারণে, তাওহীদের আলো নিভে যাওয়ার সুযোগে এবং সর্বত্র মুর্খতা, পাপাচারিতা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে উক্ত কুসংস্কার গুলোও ঢুকে পড়েছিল। উক্ত কাজগুলো ইসলামী শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এবং তাওহীদের সরাসরি বিরোধী হওয়ার কারণে শাইখ মুসলিমদেরকে সঠিক দ্বীনের দিকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। এটি শুধু তার একার দায়িত্ব ছিলনা; বরং সকল আলেমের এই দায়িত্ব ছিল। তাই শাইখের দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণ তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক। এটি ছিল একটি সংস্কার আন্দোলন।
প্রথম অভিযোগঃ শাইখ অলী-আওলীয়াদের কবরে মানত পেশ করা ও কবরকে সম্মান করা এবং কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা বন্ধ করে দিয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু যবেহ করা হারাম করেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া, শাফাআত চাওয়া এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলা দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
জবাবঃ আসলে এইগুলো কোন অভিযোগের আওতায় পড়েনা। এগুলো এমন বিষয়, যা কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল দ্বারাই হারাম করা হয়েছে। তাঁর পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) এ ধরণের শির্ক-বিদআতের জেরালো প্রতিবাদ করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে সেও বুঝতে সক্ষম হবে যে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দ্বীনের সঠিক শিক্ষা না থাকার কারণে, তাওহীদের আলো নিভে যাওয়ার সুযোগে এবং সর্বত্র মুর্খতা, পাপাচারিতা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে উক্ত কুসংস্কার গুলোও ঢুকে পড়েছিল। উক্ত কাজগুলো ইসলামী শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এবং তাওহীদের সরাসরি বিরোধী হওয়ার কারণে শাইখ মুসলিমদেরকে সঠিক দ্বীনের দিকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। এটি শুধু তার একার দায়িত্ব ছিলনা; বরং সকল আলেমের এই দায়িত্ব ছিল। তাই শাইখের দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণ তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক। এটি ছিল একটি সংস্কার আন্দোলন।
দ্বিতীয় অভিযোগঃ শাইখ নিজ মতের বিরোধীদের মুসলীমদের কাফির বলেন,
তাদের সাথে যুদ্ধে করেছেন এবং তাদের জান মাল হালাল করেছেনঃ
জবাবঃ
শাইখ নিজ মতের বিরোধীদের সাথে যুদ্ধে করেছেন এবং অন্যায়ভাবে তাদেরকে হত্যা করেছেন এবং তাদের
জান মাল হালাল করেছে। এমন অভিযোগের জবাব “ভারত উপমহাদেশে শাইখের এই আন্দোলনের
বিরোধীতার কারন” আলোচনার চার নম্বরে আলোচিক হবে
সেখানে এই অভিযোগের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে। সেখানে এই যুদ্ধের যে ষ্পষ্ট
নীতিমানা অনুসরণ করা হয়েছে তার বর্নণা আছে।
তৃতীয় অভিযোগঃ শাইখ “সালাফী বা ওয়াহ্হাবী” নামে মাযহাব পঞ্চম মাযহাব
তৈরী করছেন।
জবাবঃ এটি একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। উপরে বর্নিত শাইখ এর জীবনি
পড়ে সহজেই বুঝা যাচ্ছে তিনি কোন মাহাব তৈরী করেন নি। বরং
মুসলিমদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহবান জানিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর কিতাবাদি পড়লে
বুঝা যায় দ্বীনের শাখা ও ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে হান্বালী মাযহাবের প্রতি তাঁর
ঝুক ছিল। তবে তিনি মাজহাবী গোঁড়ামির সম্পূর্ণ উর্ধ্বে ছিলেন। সহিহ সুন্নাত আলোকে
ফতোয়া দিতে থাকে, তাই তারা নির্দিষ্ট একক কোন ইমামের তাক্বলীদ থেকে বের হয়ে আসে
এবং চার ইমামের সকলকেই হক জেনে শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে অনুসরণ করে। তার অধিকাংশ
অনুসারীগন ও এই নীতি মেনে চলেন এবং এখন চলছেন যার বাস্তব প্রমান আজকের মক্কা
মদীনার আলেম সমাজ। তারা চার মাযহারকে হক বা সত্য বলে স্বীকার করেন, যারা তাদের
তাক্বলীদ করেন তাদের গোমরা মনে করেন না কিন্তু তারা যে ইমাদের ইজতেহাদ কুরআন
সুন্নাহ অধিক নিকটবর্তী তার অনুসরণ করেণ।।
যেমন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল
ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ এর ছেলে আব্দুল্লাহ, তার কিতাব “আদ দুরারুস সারিয়্যা ফিল
আজরুরাতিল নাজদীয়া” কিতাবের প্রথম খন্ডের ২২৭ পৃষ্ঠায় লিখেন,
আমরা ফুরিয়ী বা শাখাগত মাসয়ালা মাসায়েলের ক্ষেত্রে ইমাম
আহম্মদ ইবনে হাম্মলের অনূসরণ করি। আর যারা চার ইমামের কোন এক ইমামের অনুসরণ করে
আমরা তাদের ব্যাপারে কোন আপত্তি করি না। হ্যা, চার ইমামের বাইরে কোন মাজহাবের
অনুসরন করা কে আমরা জায়েয মনে করি না কেননা তাদের মাজহাব সুসংরক্ষিত নেই। যেমনঃ
রাফিজী, জায়দিয়া, ইমামিয়া ইত্যাদি। এদের আমরা স্বীকার করি না, কারণ এরা ফাসেক।
কাজেই চার ইমামের অনুসরণে কোন আপত্তি নেই বরং আমরা বাধ্য করি চার ইমামের কোন এক
ইমামের অনুসরণ করতে। তাই আমরা ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্মলকে অনুসরণ করি, কারন আমরা
মুজতাহীন নই, ইজতেহাদ করার ক্ষমতা আমাদের নেই কিন্তু কথিপয় মাসয়ালার ক্ষেত্রে যদি
আমরা ষ্পষ্ট ও সহিহ দলিল পাই, তখন আমরা আমাদেন মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাবের
মাসয়ালা গ্রহণ করি। অর্থাৎ যে ইমামের মতামত অধিক শক্তিশালী আমরা তার মতামত গ্রহণ
করি।
তারা চার ইমামের ইজতেহাদকে একসাথে এনে ষ্পষ্ট, সহিহ এবং
শক্তিশালী দলিলের ভিক্তিতে কুরআন সুন্নাহ অনুসরণ করে তাকে।
চতুর্থ
অভিযেগঃ অনেকে তাকে হাদিছে বর্ণিত ‘নাজদ’এর ফিতনা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম
এবং ইয়ামানে বরকত দান করো। সকলে বললঃ আর আমাদের নাজদে ? তিনি বললেন,
ওখান থেকে শয়তানের শিং উদিত হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
জবাবঃ ইবনে হাযার আস্কালানীসহ অন্যান্য আলেমগণ বলেনঃ হাদিছে
উল্লেখিত নাজদ হল ইরাকের নাজদ শহর। আর ইরাকেই সকল বড় বড় ফিতনা দেখা দিয়েছে। আলী
(রাঃ) এবং হুসাইন (রাঃ) এর যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইরাক শান্ত হয়নি। সেখানের
ফিতনার কারণেই আলী (রাঃ) কুফায় এবং হোসাইন (রাঃ) কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন। হেজাযের নাজদে
কোন ফিতনাই দেখা যায়নি। যেমনটি ইরাকে দেখা দিয়েছে। সুতরাং হেজাযের নাজদ থেকে
শাইখের যেই তাওহীদি দাওয়াত প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছে,
তা ছিল নাবী-রাসূলদেরই দাওয়াত। সুস্পষ্ট বিদআতী আর অন্ধ ছাড়া কেউ এই
দাওয়াতকে নাজদের ফিতনা বলতে পারেনা।
পঞ্চম অভিযোগঃ যারা তার দাওয়াত গ্রহণ করেনা শাইখ তাদের কাফির বলতেন।
শাইখ মুহাম্মাদ ইবনি আব্দুল
ওয়াহ্হাবের প্রতি অপবাদ দেওয়া হয় যে, তিনি দাবি করেছেন যে, যারা তার দাওয়াত গ্রহণ
করেনা তারা তদের কাফির। এ প্রসঙ্গে ইবনু আবিদীন শামী (মৃত ১২৫৮ হিজরি/১৮৪২ ইং) তার
প্রসিদ্ধ “রাদ্দুল মুখতার” কিতাবের টিকায় লিখেন যেমন বর্তমান যুগের মুহাম্মাদ ইবনি
আব্দুল ওয়াহ্হাব অনুসারিদের দখতে পাওয়া যায়। যারা নজদের অধীবাসি, পবিত্র হারামাইন
শরিফাইন (মক্কা ও মদীনা) উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং নিজেদের হাম্বলি মাজহাবের
অনুসারি দাবি করছে, তাদের বিশ্বাস হল তারাই কেবল মুসলিম। আর যার তাদের আকিদা পরিপন্থ
তারা হল মুসরিক। তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এবং তাদের আলিমগনকে হত্যা করা বৈধ
মনে করে।(“রাদ্দুল মুখতার” ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ৩০৯; শাইখ মুহাম্মাদ ইবনি আব্দুল
ওয়াহ্হাব রহঃ জীবন কর্ম পৃষ্ঠা ১১৮ )
জবাবঃ ইতিপূর্বে শাইখ
মুহাম্মাদ ইবনি আব্দুল ওয়াহ্হাব কি কি কারনে কাউকে কাফির বলতেন তা উল্লেখ করা
হইয়াছে। আমরা দেখিছি এ ব্যাপার তাহার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল কাজেই তিনি আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামায়াত কোন লোককে কাফির বলনি। তার জীবদ্দসায় এমন অভিযোগ আসলে তিনি
তা শক্তভাবে প্রত্যাখান করে বলেনঃ
আমরা কখন কোন মুসলিমকে কাফির ঘোষণা করিনা, যারা না জেনে, না
বুঝে শায়খ আব্দুল কাদির, আহমাদ বাদাবী এবং তাদের মত অন্যদের কবরের গম্বুজের উপর
প্রতিষ্ঠিত মুর্তির (সনম) পূজা করে কিন্তু
তাদের সতর্ক করার কেউ নেই। তাহলে যারা শির্ক করেনি কিংরা কুফরি করেনি অথচ আমাদের
দাোওয়াতের অনুসারী নয়, তাদের কে কিভাবে কাফির ঘোষনা করব?...আল্লহর পবিত্রতা ঘোষনা
করে বলছি এটা মস্তবড় অপবাদ। (হুসাইন ইবনু গান্নাম, রাওযাতুল আফকার এবং শাইখ
মুহাম্মাদ ইবনি আব্দুল ওয়াহ্হাব রহঃ জীবন কর্ম পৃষ্ঠা ১১৯ )
ভারত উপমহাদেশে শাইখের এই আন্দোলনের বিরোধীতার কারনঃ
শইখ মুহম্মদ ইবরে আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ এই মহতি
আন্দোলনে বিরোধীতা করার অনেক কারন ছিল নিম্মে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলঃ
এক.
তার আন্দোলন সম্পর্কে তথ্যের অভাবঃ
তার আকিদা বিশ্বাস সম্পর্ক ভারত উপমাদেশের আলেমদের তেমন জ্ঞান ছিলনা। তার কারণ
তারা তার সংস্কারের কোন খবরই পাননি। বর্তমান সময়েরমত মিডিয়া না থাকায় কোন স্থানের
সঠিক খবর পাওয়া ছিল খুবই দুরহ। তার আন্দোলনে সংবাদ বা এ বিষয় তথ্য জানার একমাত্র
মাধ্যম ছিল আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ হাজী সাহেবগণ মক্কা-মদীনায় যিয়ারতে যাইত।
তারা সেখান কার আলেম ও জনতার মুখে যা শুনত তাই এখানে এসে বলত। এই সময় ইসলামের
প্রান কেন্দ্র মক্কা মদীনায় সাহাবিদের কবর কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বিদআত
চলছিল। তিনি তাদের সে সকল বিদআত থেকে বিরত থাকার জন্য ১১৬৫ হিজরিতে শাইখ
জীবিতাবস্থায় নজদের একদল আলেম মক্কায় প্রেরণ করেন এবং সেখানকার আলেমদের সঠিক
ইসলামে ফিরে আসার জন্য কিন্তু তারা তখন সে দাওয়াত কবুল করে নি। শাইখ এর মৃত্যু হয় ১৭৯৩
সালে, আর মক্কা তার অনুসারিদে শাসনে আসে ১৮০৩ সালে, মদীনা ১৮০৪ সালে আর জেদ্দা আসে
১৮০৬ সালে। এতে সহজেই অনমান করা যায় যে, শাইখের জীবন দসায় মক্কা-মদীনার হারামাইন
তুর্কী শাসকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। যার ফলোশ্রুতিতে, আমাদের দেশের হাজ্বি সাহেবগণ তার আন্দোলনের
সঠিক সংবাদ বহন করতে পারেনি বরং তার বিরোধী সংবাদ বহন করে। এর ফলে অধিকাংশ আমাদের ধর্মপ্রাণ
হাজী সাহেবগণ মক্কা-মদীনায় যিয়ারতে গিয়ে শাইখ এর সংস্কার বিরোধী প্রচারণায়
প্রভাবিত হয়। এ ফলে ভারত উপমহাদেশেও ওয়াহ্হাবী বিরোধী প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে।
দুই.
শির্ক-বিদআতী আমলের জন্যঃ ভারত উপমহাদের
মুসলীমদের প্রধান ধর্মীয় আমল কবর ও মাজার জিয়ারত করা, মাজারে বার্ষিক উরুশ পালন
করা, ধর্ম যার যার উত্সর সবার বলে হিন্দুদের পুজায় অংশ গ্রহণ করা, বিভিন্ন পর্ব
পালন করা, ধর্মের নামে বেনামে নানার বিদআতী ও শির্ক অনুষ্ঠাণ করা। আর মুহম্মদ ইবনু
আব্দুল ওয়াহ্হাব এর সংস্কার আন্দোলন ছিল এ সব বিদআতী ও শির্ক অনুষ্ঠাণের বিরুদ্ধে। কাজেই
হজ্জ বা জিয়ারতে মক্কা-মদীনা গিয়ে তখন তারা বিদআত সমর্থিত আলেমদের নিকট থেকে তখন
শুনতে পেত যে, মুহম্মদ ইবরে আব্দুল ওয়াহ্হাব অলী আওলীয়াদের কবরে মানত পেশ করা, কবরকে
সম্মান করা, কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা, মাজারের নামে বা অলীদের নামে পশু যবেহ করা
হারাম করেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া,
শাফাআত চাওয়া এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলা দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
তখন তারা মনে করত ঐ লোকটা অবশ্য বিভ্রান্ত, তা না হলে এমন আমলকে কেই খারাপ বলতে
পারে। বাস উপমহাদেশের বিদআতি আলেমদের নিকট তিনি হয়ে গেলেন মহা ফিতনাবাজ। মাজার
পন্থী অনেক আলেম তার বিরুদ্ধে কিতাব পর্যান্ত রচনা করেছে।
শাইখের বিরোধীতা এতই প্রচার পেল যে, তখন
উপমহাদেশে যে কেই কবর মাজার বিরোধী কথা বললে তাকে ওয়াহ্হবী বলে গাল দেওয়া হত। কেই
প্রচলিত শির্কি বিদআত বিরোধী কথা বললেও তাকে ওয়াহ্হবী বলে গাল দেওয়া হত। অবস্থা
এমন হল যে নাচ গান ও মদ পন্থী বেশরা লোকেরাও সুন্নী লোকদের ওয়াহ্হবী বলে গালি দিত
বলে প্রমান পাওয়া যায়। ইসলামি আকিদাও ভ্রান্ত মতবাদ কিতাবের ৪৫২ পৃষ্ঠায় বলা হয়।
ভারতের এক শহরে ওয়াহ্হবী অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অনুসন্ধানে যানা গেল তাকে একজন
তাড়ী পান করতে দেখেছে। তার সাক্ষীর ভিত্তিতে তাকে ওয়াহ্হবী অভিযোগ থেকে নিস্কৃতি
দেওয়া হয়। অন্য এক জন কে গ্রেফতারের পর যারা যায় সে নাচ দেখেছে, তখন তাকেও
ওয়াহ্হবী অভিযোগ থেকে নিস্কৃতি দেওয়া হয়। খারাপ কাজ শির্ক বিদাতি কাজ কোন ওয়াহ্হবী
করতে পারে না। আজও যদি আপনি ব্রেলভী বা শিয়া আকিদার কাউকে কবর মাজারের বিদআত
সম্পর্কে কিছু বলেন, সে সাথে সাথে বলবে ওয়াহ্হবী কোথাকার। তার আমলের কোন দলিল চান,
বললে দলিল চাওয়া ওয়াহ্হবীদের কাজ।
তিন. মুসলিমদের কে বৃটিশ
বিরোধী আন্দোলন থেকে বিরত রাখার জন্যঃ
ওয়াহ্হবী বিরোধী প্রচারণা যেহেতু বৃটিশ আমলে ব্যাপকতা লাভ করেছিল, তাই বৃটিশ সরকার সে অস্ত্রটি আমাদের আজাদী সংগ্রামের সংগ্রামী আলেমগণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। তারা আজাদী সংগ্রামের পথিকৃত বালাকোটের শহীদ মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদকে সাথে সাথে গোটা মুজাহিদ আন্দোলন ও আজাদী সংগ্রামকে ‘ওয়াহ্হবী আন্দোলন’ বলে অভিহিত করে। সাথে সাথে আমাদের বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা নিসার আলী ওরফে তীতুমীর এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন সবই বৃটিশ ঐতিহাসিক ও আমলা ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার প্রমুখ কর্তৃক ‘ওয়াহ্হবী আন্দোলন’ বলে অভিহিত হয়। কারন উপমহাদেশের মুসলীমগন মুহম্মদ ইবরে আব্দুল ওয়াহ্হাব এর সংস্কার সম্পর্ক অজ্ঞতার কারনে খারাপ চোখে দেখত। আর এই মুজাহীদের আন্দোলন কে যদি ওয়াহ্হাবী আন্দোলন বলে চালান যায়, তবে সাধারণ জনগণ এর প্রতি কোন সমর্থণ তো দেবেই না বরং খারাপ চোখে দোখবে। (আল্লাহ আলাম)
ওয়াহ্হবী বিরোধী প্রচারণা যেহেতু বৃটিশ আমলে ব্যাপকতা লাভ করেছিল, তাই বৃটিশ সরকার সে অস্ত্রটি আমাদের আজাদী সংগ্রামের সংগ্রামী আলেমগণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। তারা আজাদী সংগ্রামের পথিকৃত বালাকোটের শহীদ মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদকে সাথে সাথে গোটা মুজাহিদ আন্দোলন ও আজাদী সংগ্রামকে ‘ওয়াহ্হবী আন্দোলন’ বলে অভিহিত করে। সাথে সাথে আমাদের বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা নিসার আলী ওরফে তীতুমীর এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন সবই বৃটিশ ঐতিহাসিক ও আমলা ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার প্রমুখ কর্তৃক ‘ওয়াহ্হবী আন্দোলন’ বলে অভিহিত হয়। কারন উপমহাদেশের মুসলীমগন মুহম্মদ ইবরে আব্দুল ওয়াহ্হাব এর সংস্কার সম্পর্ক অজ্ঞতার কারনে খারাপ চোখে দেখত। আর এই মুজাহীদের আন্দোলন কে যদি ওয়াহ্হাবী আন্দোলন বলে চালান যায়, তবে সাধারণ জনগণ এর প্রতি কোন সমর্থণ তো দেবেই না বরং খারাপ চোখে দোখবে। (আল্লাহ আলাম)
গোলাম মোর্তজা লিখেছেন ‘ব্রেলভীর সৈয়দ আহমদ শহীদ রহঃ নিহত হওয়ার পর যেসব আন্দোলন, বিদ্রোহ বা সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল, সেগুলোকে বিকৃত
করে তাঁদের নাম পাল্টে কোনোটাকে বলা হয়েছে সিপাহী বিদ্রোহ, কোনোটাকে
বলা হয়েছে ওহাবী আন্দোলন, ফারায়েজী আন্দোলন, মুহাম্মদী আন্দোলন, আবার নোটাকে হিন্দু মুসলমানদের
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।’ (গোলাম আহমদ মোর্তজা রচিত “চেপে রাখা ইতিহাস” পুস্তকের ১৭৯ পৃষ্ঠা)।
হান্টারের ভাষ্যমতে,
সৈয়দ আহমদ বেরলভী মক্কায় গিয়ে ওহাবী আন্দোলনে দীক্ষিত হয়ে আসেন,
অথচ তিনি বা আমাদের তীতুমীর, হাজী
শরীয়তুল্লাহ প্রমুখ বীরপুরুষগণ যখন ১৮২০ সালের দিকে হজে যান তখন মক্কা-মদীনায়
সুদৃঢ় তুর্কী শাসন চলছিল এবং ঐ সব পবিত্র নগরীতে ওহাবী আন্দোলনের নামটি উচ্চারণ
করাও ছিল গুরুতর অপরাধ। এর এক দশক পূর্বেই তুর্কী সুলতানরা ১২৪৪ হিজরীতে/১৮১৩
খ্রি. ওহাবীদের কে হটিয়ে মুক্ত করে ফেলেছিলেন। সুতরাং ওটা ছিল নেহাৎই রাজনৈতিক
প্রচারণা এবং অসত্য বিবরণ। তাই ১৮৬৪ সালে ‘গ্রেট ওহাবী
ট্রায়াল’ নামে উপমহাদেশীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ‘কোলকাতা হাইকোর্টে’ সরকারী মামলা হয়েছিল-যার
ভিত্তিতে অনেকেরই ফাঁসি ও দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়েছিল। সে মামলার অভিযুক্তগণ
আদালতে তাদেরকে ‘ওয়াহ্হবী বলে অভিহিত করার প্রতিবাদ করে
বলেছিলেন, আমরা ‘ওয়াহ্হবী নই, মুহাম্মাদী তরীকার অনুসারী।’ তারা ‘ওয়াহ্হবীর পরিবর্তে তাদেরকে সুন্নী বলে অভিহিত করার দাবী করেছিলেন। স্বয়ং
হান্টার লেখেন, কার্যত ‘ওয়াহ্হবীরা
হচ্ছে সুন্নী সম্প্রদায়ের একটি অগ্রগামী অংশ এবং ইসলামের শুদ্ধাচারপন্থী অংশ।
বাংলা ও উত্তর পশ্চিম ভারতের প্রায় সকল মুসলমানই সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত।
(ইন্ডিয়ান মুসলিমস পৃ. ৪৫-৪৬)
শায়খ আলী আল- তানতাভী (রহঃ) যিনি বড় বড় ব্যক্তিত্বদের সম্বন্ধেও বহু বই লিখেছেন। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ) নামক বইতে তিনি লিখেছেন, হিন্দুস্তান ও অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে একত্ববাদের ধ্যান-ধারণা পৌছেঁছে মুসলিম হাজীদের দ্বারা, যারা মক্কা থেকে এই সম্বন্ধে ধারণা নিয়েছেন। ফলে ইংরেজ ও ইসলামের অন্যান্য শত্রুরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। কারণ, একমাত্র তাওহিদই মুসলিমদেরকে নিজ শত্রুদের বিরুদ্ধে একত্রিত করে। ফলে, তারা এমন অবস্থা সৃষ্টি করল, যে ব্যক্তিই তাওহীদের দিকে মানুষকে ডাকে তাকেই তারা ওহাবি নামে আখ্যায়িত করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমরা যেন সে তাওহিদ থেকে সরে যায়, যে তাওহিদ এক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়।
শায়খ আলী আল- তানতাভী (রহঃ) যিনি বড় বড় ব্যক্তিত্বদের সম্বন্ধেও বহু বই লিখেছেন। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ) নামক বইতে তিনি লিখেছেন, হিন্দুস্তান ও অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে একত্ববাদের ধ্যান-ধারণা পৌছেঁছে মুসলিম হাজীদের দ্বারা, যারা মক্কা থেকে এই সম্বন্ধে ধারণা নিয়েছেন। ফলে ইংরেজ ও ইসলামের অন্যান্য শত্রুরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। কারণ, একমাত্র তাওহিদই মুসলিমদেরকে নিজ শত্রুদের বিরুদ্ধে একত্রিত করে। ফলে, তারা এমন অবস্থা সৃষ্টি করল, যে ব্যক্তিই তাওহীদের দিকে মানুষকে ডাকে তাকেই তারা ওহাবি নামে আখ্যায়িত করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমরা যেন সে তাওহিদ থেকে সরে যায়, যে তাওহিদ এক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়।
চারঃ ব্যাপকভাবে প্রচার করে তিনি
মুসলীমদের কাফির বলে তাদের সাথে যুদ্ধে করেছেন এবং তাদের জান মাল হালাল করেছেনঃ
শাইখ নিজ মতের বিরোধীদের সাথে যুদ্ধে করেছেন এবং অন্যায়ভাবে
তাদেরকে হত্যা করেছেন এবং তাদের জান মাল
হালাল করেছে। এমননি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে
উত্থাপিত করা হয় স্বয়ং দেওবন্দী আলেমদের থেকে ও আজও তারা মনে করে তার এ জিহাদ অন্যায়
বাড়াবাড়ি।
দেওবন্দী আলেমদের
মতে, তাদের সব যুদ্ধ ছিল মুসলমান ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের বিরুদ্ধে। শাইখের
মুসলমানদেরকে মুশরিক বলা এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা ছিল অন্যায় ও বাড়াবাড়ি।
তার ও তার অনুসারীদের এই কাজকে সঙ্গত কারণেই আমরা শরয়ী জিহাদ বলতে পারছি না। মূল ধারার আলেমগণ এই বাস্তবতাকে সামনে
রেখেই তাকফিরের ক্ষেত্রে শাইখের বাড়াবাড়ির কথা বলেছেন। (বিশিষ্ট দেওবন্দী আলেম
মুফতি ইজহারের লেখা থেকে)।শাইখের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি বিরোধীদেরকে হত্যা করেছেন। এই অভিযোগও সঠিক নয়। কারণ যারা তার বিরুদ্ধে এবং তাওহীদের দাওয়াতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তিনি কেবল তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। তাঁর জিহাদ ছিল শরঈ জিহাদ। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হার কাফির ঘোষণা এবং যুদ্ধ করার জন্য একটি নীতিমালা করেন। তার নীতিমালাগুলি ছিল নিম্মরূপঃ
১) ওয়াজ নসিয়ত এবং
পাঠদানঃ ওয়াজ নসিয়ত এবং পাঠদানের সকলে তার শির্ক বিদআত কর্মসুচি তুলে ধরতেন, প্রয়োজনে
একাধীক বৈঠক করতেন।
২)বক্তৃতা বিবৃতিঃ বিভিন্ন সভ সমাবেশের মাধ্যমে বক্তৃতা বিবৃতি
প্রদান করে সাধারণ জনগনের নিকট দাওয়াত পৌছাতেন।
৩) চিঠি পত্রঃ বিভিন্ন দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভারশালী খ্যাতিমান এবং প্রশাসনে কর্তা ব্যক্তিদের নিকট তার
সংস্কার আন্দোলনে দাওয়াত দিতেন। এবং তাওহীদের ছায়াতলে আসার আহবান জানাতেন। অপর
দিকে তার সংস্কার আন্দোলনে বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আ অপবাদ প্রদান করা হত তিনি তাদের
নিকট পত্র মারফত এর উত্তর দিতেন।
৪) বাহাস, মুনাযারা, যুক্তি তর্ক ও সংলাপঃ শাইখ বিভিন্ন
অঞ্চলেন বিশেষজ্ঞ আলিম উলামদের নিকট তার দাওয়াত ও মতামত নিয়ে যুক্তি তর্ক ও সংলাপ
মাধ্যমে পেশ করতেন।
৫) কিতার রচনাঃ শাইখ তার সংস্কার
আন্দোলনে আদর্শ, নীতি, কর্মসুচি, কর্ম কৌসল, লক্ষ উদ্দেশ্য, দাওয়াতের প্রকৃত সরূপ
ইত্যাদি বিষয়গুলি সুষ্পষ্ট রূপে তুলে দরার জন্য এর উপর তিনি বহু কিতার রচনা
করেছেন।
শাইখ কোন অঞ্চলের
সাথে যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে এই পাঁচটি পদ্ধতিতে দাওয়াত দিতেন এর কোনটি যখন কাজে আসে
না, তখন তিনি চুড়ান্ত পদ্ধতি হিসবে কিতাল কে বেচে নিতেন। (শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু
আব্দুল ওয়াহ্হার রহঃ জীবন ও কর্ম, পৃষ্ঠা নম্বর ৮২ )।
ইহা ছাড়া কারোও দ্বারা আক্রান্ত হলেও জান মাল ইজ্জত আবরুর
হিফাজতের জন্য কিতালের পথ বেছে নিতেন।হোসাইন ইবনু গান্নাম, তারিখে নজম ৩৬১-৩৬২
পৃষ্ঠায় বলেন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হার কিতাল সম্পর্কে ষ্পষ্ট করে
বলেছেন।
আর লড়াই বা যুদ্ধ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হল যে, আমরা আমাদের জান মাল ইজ্জত আবরুর হিফাজত ব্যাতিত
এখন পর্যান্ত কারো সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হইনি। যারা আমাদের দেশে এসেছে এবং স্থায়ীভাবে
থাকছেনা তাদের সাথে লড়াই করিনা। তবে তাদের কারো কারো সাথে প্রতিশোধের ভিত্তিতে (যেমন আল্লাহর বাণী) “খারাবের পরিণতি অনুরূপ খারাপই হয়” (আশ শূরাঃ৪০) আমরা যুদ্দ করতে পারি। একইভাবে যে ব্যক্তি
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দ্বিন ভালভাবে জানার পরও ষ্পষ্ট গাল মন্দ করে তার
বিরুদ্ধে ও লড়তে পারি। (হুসাইন ইবনু গান্নাম, তারিখে নাজদ, পৃষ্টা ৩৬১ -৩৬২)।
অপর পক্ষে শাইখ কাফির ঘোষনার ক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট নীতিমালার
অনুসরণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তার লিখিত এক
চিঠিতে চার ধরনের লোকদের কাফির হিসাবে ঘোষনা করার উপযুক্ত মনে করেন। তিনি বলেন,
১) যে ব্যক্তি তাওহীদ জেনে বুঝে তা এড়িয়ে যায়। তাওহীদ মানে
না, শির্ক করা ছেড়ে দেয় না, সে কাফির।
২) যে ব্যক্তি তাওহীদ ও শির্ক ভালভাবেই, কিন্তু আল্লাহ
দ্বীন কে গানি দেয়, মুসরিকদের প্রশংসা করে। সে ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির চেয়েও
মারাকত্মক কাফির।
৩) যে ব্যক্তি তাওহীদ জানে ও মানে এবং শির্ক চেনে এবং তা
পরিহার ও করে। তবে সে কারে তাওহীদে বিশ্বাসি হয়ে ইসলামে প্রবেশ করাকি অপছন্দ করে
এবং শির্ক অবস্থায় তাকে ভাল জানে, সে ও কাফীর। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,
ذَٲلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَرِهُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ
فَأَحۡبَطَ أَعۡمَـٰلَهُمۡ (٩)
অর্থঃ কারণ আল্লাহ যে জিনিস নাযিল করেছেন
তারা সে জিনিসকে অপছন্দ করেছে৷ অতএব, আল্লাহ তাদের আমলসমূহ
ধ্বংস করে দিয়েছেন৷ (সূরা মুহাম্মাদ
৪৭:৯ )।
৪) যে ব্যক্তি নিজে এ
সব অপকর্ম ও চিন্তা থেকে মু্ক্ত বটে, তবে তার দেশের জনগণ যারা তাওহীদপন্থী তাদের
সাথে মত্রুতা করে। তাদের সাথে লড়াই করে, আর সে ব্যক্তিও তাদের পক্ষে তার জান মাল
দিয়ে অংশ গ্রহণ করে। সে ব্যক্তি কাফির। এখানে বাধ্যবাধকতার অজুহাত গ্রহণীয় নয়।
কেননা তার ঐ দেশ থেকে হিজরত করে অন্য দেশে যাবার সুযোগ আছে।
সুতরাং সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে যারা নিহত হয়েছে, তাদেরকে তিনি অন্যায়ভাবে হত্যা করেছেন, এই অভিযোগ যেমনঠিক নয়, তেমনিভাবে তিনি গয়রাহভাবে
মুসলিমদের কাফির বলেছেন এ কথাও ঠিক নয়।
শাইখের দাওয়াতের ফলাফলঃ
শাইখের বরকতময় দাওয়াতের ফলে আরব
উপদ্বীপসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চল থেকে শির্ক-বিদআত ও দ্বীনের নামে নানা কুসংস্কার
উচ্ছেদ হয়। যেখানেই এই দাওয়াত প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হকপন্থীগন সম্মানিত হয়েছেন। হাজীগণ
সারা বিশ্ব হতে মক্কা ও মদীনায় আগমণ করে শাইখের দাওয়াত পেয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে
গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন। বাদশাহ আব্দুল আযীযের যুগে সুবিশাল সৌদি
আরব তাওহীদের এই দাওয়াতের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ এই দাওয়াতের ফল ভোগ করছেন সৌদি
রাজ পরিবার ও তার জনগণ। বিশ্বের যেখানেই কুরআন, সুন্নাহ এবং
সহীহ আকীদার দাওয়াত ও শির্ক-বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, তা শাইখের এই বরকতময় দাওয়াতেরই ফসল। হে আল্লাহ! তুমি কিয়ামত পর্যন্ত
তাওহীদের এই দাওয়াতকে সমুন্নত রাখো। আমীন।
শাইখের ইলমী খেদমতঃ
শাইখের রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। তার কিতারগুলি মুলত পূর্ববর্তি হাদিস বিশারতগনের তরীকা অনুজায়ী কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সুষ্পষ্ট বক্তব্যে ভরপুর। তার লেখায় যুক্তিতর্কবিদ এবং পরবর্তি ফিতাহবিদগনের মত গ্রীক বা অন্যান্য দর্শনের ছোয়া নেই। তার লেখাগুলি কুরআন হাদিসের উদৃতি সমৃদ্ধ। কিতারগুলি সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা। সুফিদের পরিভাষা থেকে সম্পর্ণ মুক্ত। যে ভাষা সুফিরা গ্রীক দর্শণ ও হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে নিয়ে থাকে।
শাইখের রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। তার কিতারগুলি মুলত পূর্ববর্তি হাদিস বিশারতগনের তরীকা অনুজায়ী কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সুষ্পষ্ট বক্তব্যে ভরপুর। তার লেখায় যুক্তিতর্কবিদ এবং পরবর্তি ফিতাহবিদগনের মত গ্রীক বা অন্যান্য দর্শনের ছোয়া নেই। তার লেখাগুলি কুরআন হাদিসের উদৃতি সমৃদ্ধ। কিতারগুলি সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা। সুফিদের পরিভাষা থেকে সম্পর্ণ মুক্ত। যে ভাষা সুফিরা গ্রীক দর্শণ ও হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে নিয়ে থাকে।
তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কিতারগুলি হলঃ
(১)কিতাবুত্ তাওহীদ। (২) কাশফুস শুবুহাত (সংশয় নিরসন)। (২) আল উসূলুস ছালাছাহ ওয়া আদিল্লাতুহা।
(৪) উসূলুল ঈমান।
(৫) তাফসীরুল ফাতিহা। (৬)
মাসায়িলুল জাহেলিয়াহ। (৭) মুখতাসার যাদুল মাআদ (৮) মুখতাসার সিরাতুর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আরো অন্যান্য কিতাব। (৯) শুরুতুস সালাহ ওয়া
আরকানুহা (১০) আল কাওয়ায়িদ আল আরবায়াহ (১১) কিতাব ফযলিল ইসলাম (১২) কিতাবুল
কাবায়ির (১৩) নসীহাতুল মুসলীমীন (১৪) ছিত্তাতু মাওয়াযি মিনাস সীরাহ্ (১৫) তফসীরুশ
শাহাদাহ (১৬) আদাবুল মাশই ইলাস সালাত (১৭) কিতাবুস সিরাহ (১৮) আল হাদয়ুন নব্বী (১৯)
মুফিদূল মুসতাফিদ (২০) আদাবুল মাশই ইলাস সালাত (২১) মুখতাসারু ফাতহির বারী (২২) মুখতাসারুল
শারহুল কবীর (২৩) মুখতারুল সাওয়ায়িক্ব (২৪) মুখতাসারুল ঈমান (২৫) আহাদীছেল ফিতান (২৬)
ফাযায়েল কুরআন (২৭) মুখতাসারু সহিহ বুখাবী (২৮) মুখতাসারুল ইনসাফ (২৯) মুখতাসারুল আকল ও
নকল (৩০) মুখতাসারুল মিনহাজ (৩১) মাজমুউল
হাদিস আলা আবোওয়াবিল ফিক্বহ ইত্যাদি।
শাইখের মৃত্যুঃ
১৭৯২ সাল মোতাবেক ১২০৬ হিজরীতে যুল-কাদ মাসের শেষ তারিখে ৯২
বছর বয়সে শাইখ দরঈয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। এভাবে তিনি দ্বীন প্রচার এবং যুদ্ধ করে যান
৫০ বছর যাবত, ১১৫৮ হিজরি থেকে তার
মৃত্যুর ১২০৬ হিজরির পর্যন্ত। তার প্রচার কাজে সকল পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন,
জিহাদ, বক্তৃতা, বাঁধা,
তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা
আনুগত্য করত এবং বাঁধাই করা কবর ধ্বংস না করত এবং কবরের উপর করা মসজিদ ধ্বংস না
করত। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না তার পূর্ব পুরুষের ভ্রান্ত ধারনা ত্যাগ করে সঠিক ইসলাম মানত
এর নিয়মনীতি অনুসারে। তার মৃত্যুর পর আল্লাহ্র পথে তার আদর্শ অনুযায়ী কাজ
চালিয়ে যান তার, ছেলেরা, নাতীরা এবং
অনুসারীরা। হে আল্লাহ! তুমি শাইখকে তোমার প্রশস্ত রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করে নাও।
আহলে হাদিসদের আকিদা
বিশ্বাসঃ
শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন
আব্দুল ওয়াহ্হাব রাহিমাহুল্লাহ জীবনি আলোচনার শুরুতেই বলেছি আহলে হাদিস আসলে
সালাফীদের একটা প্রকরণ। তাই বিস্তারিতভাবে সালাফী আকিদা বিশ্বাস বর্ণনা করব, (ইনশা-
আল্লাহু আজিজ) এবং বুঝে নিবেন এটাই আহলে হাদিসদের আকিদা বিশ্বাস। সালাফীগন
আসলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতভুক্ত একটি ফির্কা বা দল। তাই তাদের আকিদা বিশ্বাস
পূর্বে উল্লেখিত কাদিয়ানি এবং ব্রেলভী আকিদার সম্পূর্ণ বিপরীত পক্ষান্তরে দেওবন্দী
এবং জামায়েতে ইসলামির আকিদার কাছাকাছি, যদিও তাদের মধ্যে আকিদাগত কিছু মতভেদ আছে।
ফিকহি বিষয় এদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ফিকহি মতভেদের বিষয়গুলির
মধ্যে আবার ফরজ এবং ওয়াজিব পর্যায় পার্থক্য সামন্যই কিন্তু সুন্নাত ও মুস্তাহাবে
মতভেদের সীমা পরিসীমা নেই। তার প্রধাণ কারন এক পক্ষ যে কোন একজন ইমামের তাক্বলীদ
করা নিজেদের জন্য ওয়াজিব করে নিয়েছে আর অন্যপক্ষ চার ইমামের হক জেনে তাদের সকলের
ইজতেহাদকে সামনে রেখে ষ্পষ্ট, সহিহ এবং শক্তিশালী দলিলের ভিক্তিতে যে কোন একজন বা
তাহাদের বাইরের কোন মুজতাহিদ (ইমাম তাইমিয়া, ইমান শাওকানী, নাসির উদ্দিন আলবানী
ইত্যাদি) এর অনুসরন করে।
যেহেতু সালাফীগন আসলে আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামাতভুক্ত, তাই তাদের আকিদা সুন্নীদাবিদার সকল মুসলিমই অনুমান করতে পারেন।
কিন্তু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে উপমহাদের দুটি হকপন্থি ফির্কা দেওবন্দী এবং
জামায়েতে ইসলামির সাথে তাদের কিছু আকিদাগত মতভেদ আছে। উপমহাদেশে হাজার হাজার
দেওবন্দী ফির্কার আলেম বিদ্যমান, যাদের লেখনি পড়ে, দরস্ (শিক্ষাদান) এবং ওয়াজ শুনে ষ্পষ্ট হয়, তাদের সাথেই মূলত
সালাফীদের আকিদাগত বা বিশ্বাসগত মতভেদ বিদ্যমান। কাজেই প্রথমে দেওবন্দী আলেমদের
সাথে তাদের মতেভেদপূর্ণ কিছু আকিদা তুলে ধরব। তার পর অন্য অন্য ফির্কার আকিদার
সাথে সালফীদের তুলনা করব। সর্বশেষ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুল আকিদাগুলী শুধু
উল্লেখ করব।
দেওবন্দী ফি্কার সাথে সালাফীদের আমিলগুল হলঃ
এই বইটিতে দেওবন্দ
আকিদা আলোচনার সময় দুটি বই এর সাথে পরিচয় করে দিয়ে ছিলাস। তাদের একটি হলঃ আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ, লেখক: খলীল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.) এবং অপরটি হলঃ “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” বইটি লিখেছেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত
উদ্দন, প্রকাশণায়: মাকতাবাতুল আবরার, ১১/১ বাংলা বাজার, ঢাকা। এই বইটি বর্তমানে
কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে আছে এবং বেফাক থেকে পরিমান মত নিসার নির্ধারণ করে।
“ইসলামী আকীদা ও
ভ্রান্ত মতবাদ” বইটির ৪৫০ পৃষ্ঠায় ওহাবী বা সালাফিগনের পরিচয় তুল ধরে মাওলানা মুহাম্মাদ
হেমায়েত উদ্দন লিখেন: “সালাফি বা ওহাবী মতবাদে সুচনাকারি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল
ওহাব বিদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অত্যান্ত কঠোর মনভাব গ্রহন করেন। তত্কালিন
ইসলামে যে বিদআত অনুপ্রবিষ্ঠ হয়েছিল, যেমন অলী আল্লাহর কবরে সৌধ নির্মাণ, কবরে
সিজদার স্থানে পরিনত করা, ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর মনভান প্রষন করেন। এটুকু
পদক্ষেপ জমহুরে উম্মত প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি ও তার অনুসারিরা বেশ কিছু বাড়াবাড়ি করে
ফেলেন, যা জমহুরে উম্মত মেনে নেয় নি”। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের স্মৃতি বিজরিত স্থান সমুহ সমূলে নিশ্চিত করে ফেলা, এ সব
স্থান থেকে কোনরূপ বরকত লাভ করার ধারনাকে সমুলে অস্বীকার করা, পীর মুরিদির
বাড়াবাড়ি প্রতিহত করতে যেয়ে সমূলে আধ্যাতিক সাধনার সিলসিলাকেই অস্বীকার করে বসা।
বুযুর্গের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে না জায়েয সাব্যস্ত করে, তাকলিদকে
খারাপ মনে করা এবং চার মাযহাবের বাইরে ইজতেহাদ করাকে আলেমদের কর্তব্য সাব্যস্ত করা
ইত্যাদি।
এর পর লেখক বলেন, সালাফিগন
প্রধানত ০৬ টি বিষয়ে জমহুরে উম্মতের সাথে ভিন্নমত পোষন করে থাকেন। যথাঃ
ক. তাকলীদ
প্রসঙ্গ
খ. তাসাওউফ প্রসঙ্গ
গ. দু’আর মধ্যে অসীলা প্রসঙ্গ
ঘ. তাবিজ করজ প্রসঙ্গ
ঙ. বুযুর্গানে দ্বীন ও অলী
আউলিয়াদের স্মৃতি বিজরিত স্থান থেকে বরকত লাভ প্রসঙ্গে।
চ. রওযায়ে
আতহার যিয়ারতে যাওয়ার নিয়ত প্রসঙ্গেসালাফী আলেমগন এ সকল আকিদাই প্রষোণ কর, যার প্রমার তাদের কিতাবাদিতে ভরপুর। এই ছয়টি আকিদার ক্ষেতে দেওবন্দী এবং সালাফীরা পরস্পর বিপরিতমুখী। দেওবন্দী আকিদা বর্ণনার সময় তাদের কিতার থেকে রেফারেন্সসহ তুলে ধরেছিলাম। এখানে শুধু আকিদা শিরোনামের মত তুলে ধরব যাতে সহজে তাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলি বুঝতে পারি।
এবার এই ছয়টি স্পর্কে শুধু দেওবন্দী আলেমদের মতামত আমরা আগেই পেয়েছি এখন শুধু সালাফীদের মতামত তুলে ধরব। তার তাদের অন্য আকিদা ও শিরোনামের মত তুলে ধরব, ইনশা আল্লাহ।
০১। তাক্বলীদ প্রসঙ্গঃ
তাক্বলীদের বলতে
বুঝায়, অন্যের উক্তি বা কর্ম সঠিক এরূপ সুধারনার ভিত্তিতে কোর দলির প্রমান না দেখে
তার অনুসরন করা। যেন অনুসারী ব্যক্তি অন্যের কথা বা কাজকে প্রমান তলর ছাড়া নিজের
গলার হার বানিয়ে নিল। (“ইসলামী
আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” পৃষ্ঠা – ৪৩৯)।
এ ক্ষেত্রে দেওবন্দীদের আকিদা হলঃ যে
কোন এক মাজহাবের তাক্বলীদ করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে চার ইমামের হক জেনে তাদের সকলের ইজতেহাদকে সামনে রেখে ষ্পষ্ট,
সহিহ এবং শক্তিশালী দলিলের ভিক্তিতে যে কোন একজন বা তাহাদের বাইরের কোন মুজতাহিদ
(ইমাম তাইমিয়া, ইমান শাওকানী, নাসির উদ্দিন আলবানী ইত্যাদি) এর অনুসরন করে। বিস্তারিত অত্র পুস্থকের মাজহাব পরিচিতি অধ্যায়ের অলোচনায়
জানা যাবে।
২। তাসাওউফ প্রসঙ্গঃ
সালাফিগন আত্মার
পরিশুদ্ধির জন্য কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আমলের কথা বলেন। এবং তারা প্রচলিত “তাসাওউফ
বা সুফিবাদ’ কে সম্পুর্ণ ইসলাম বহির্ভূত মনে করে থাকেন। এ ব্যাপারে তাদের আলেমদের
অনেক লিখুনি আছে। এবং তাদের অনুসরনীয় আলেম ইমাম তাইমিয় রাহিমাহুল্লাহ অন্যতম যিনি
সুফিরাদের বিরুদ্ধে অনেক লিখেছেন।
০৩। দু’আর মধ্যে অসীলা প্রসঙ্গঃ
সালাফী আলেমগণ বলেন, আল্লাহর
বান্দাদের মধ্যে মৃত সৎলোক এবং নবী রাসূলগণের অসীলা দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা
জায়েয নয়। যেমন
এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ,
আমি তোমার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসীলায়
বা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর অসীলায় বা অমুক শাইখের অসীলায় বলছি, তুমি আমার পাপগুলো ক্ষমা করে আমাকে অনুগ্রহ কর।
পক্ষান্তরে দেওবন্দী
আলেমগণ বলেন, মৃত নেককার মকবুল বান্দা অলী হোক বা নবী হোক তার অসীলা দিয়ে দোয়া
করতে পারবে। (“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত
মতবাদ” পৃষ্ঠা –৪৫৩)।
০৪। তাবিজ করজ প্রসঙ্গেঃ
সালাফিগণ
সকল প্রকারের তাবিজ-কবজের ব্যবহার কে ছোট শির্ক মনে করে। কিন্ত ইহার উপর
তাওয়াক্কুল করা কে বড়
শির্ক মনে করে, যা কোন ব্যক্তি কে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।
“ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত
মতবাদ” কিতাবে বলা হয়েছে, “কুরআনের আয়াত,
আল্লাহ নাম ও মাসনুন দোয়া দ্বারা ঝাড়-ফুক জায়েজ। আর যা দ্বারা ঝাড়-ফুক জায়েজ তা দ্বারা
তাবিজ-কবজ ব্যবহার করাও জায়েজ’। কারন সকলের নিকট ঝাড়-ফুক ও তাবিজ-কবজ হুকুম একই। পক্ষান্তরে আর যা দ্বারা ঝাড়-ফুক জায়েজ
নেই, তা দ্বারা তাবিজ-কবজ ব্যবহার করাও জায়েজ নয়। তাদের রেফারেন্স
হল, আদ্বুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাজি:)
কর্তৃক অবুঝ বাচ্চাদের কুরআন দিয়ে তাবিজ লিখে দেওয়া। (মুসান্নাফে ইবনে আবী
শাইবা; “ইসলামী
আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” পৃষ্ঠা –৪৫৯)।
০৫। বুযুর্গানে দ্বীন ও অলী
আউলিয়াদের স্মৃতি বিজরিত স্থান থেকে বরকত লাভ প্রসঙ্গেঃ
সালাফিদের বিশ্বাস হল, কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত স্থান ও
বস্তু দ্বারা বরকত হাসিল করা যাবে। কিন্তু কুরআন সুন্নাহর বাহিরে স্থান ও বস্তু
দ্বারা বরকত হাসিল করা যাবে না। অর্থাৎ ইসলামি শরিয়তে যে সকল কোন ব্যক্তি বা
বস্তুর মাধ্যমে বরকত হাসিল করার কথা বলা হয়েছে শুধু সে গুল থেকেই বরকত হাসিল করা
যাবে। ইসলামি শরিয়তে নেই এমন ব্যক্তি বা বস্তুর মাধ্যমে বরকত হাসিল করা অনেক সময় হারাম আবার অনেক সময় শির্ক।
যেমন:
আল্লাহর জিকির কারি বা নেককারদের সাথে বসলে বরকত
হাসিল হয়। (বুখারি:৬৪০৮, মুসলীম:২৬৮৯)
সহিহ হাদিস প্রমান করে, মসজিদে হারাম, মসজিদে
নবী, মসজিদে আকসা, এই তিনটি মসজিদের বরকতময়। ইহা ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদসমুহ, অন্য
সকল স্থান থেকে উত্তম। খাদ্য হিসাবে যাইতুনের তৈল, (সুরা নুর-৩৫. তিরমিজি-১৮৫১২)
দুধ, (ইবনে মাজাহ-৩৩৮৫) মধু (সুরা নাহল৬৯, বুখারি-৫৬৮৪ মুসলিম-২২১৭) ও যমযমের পানি,
(মুসলিম-২৪৭৩) বরকতময়।
তাই খাদ্য হিসাবে যাইতুনের তৈল, দুধ, মধু ও
যমযমের পানি, আজও বরকতময়। মসজিদে হারাম, মসজিদে নবী, মসজিদে আকসা, এমনকি পৃথিবীর
সকল মসজিদসমুহ আজও বরকত হাসিলের কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহর জিকির কারি বা নেককারদের
সোহবত বরকতময় তা আর বরার অপেক্ষা রাখে না।
অপর পক্ষে লক্ষ করুন,
হাদিসসমুহ দ্বারা প্রমানিত যে, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের থুথু, ক্বফ, ঘাম, পোশাক ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাসিল করতেন। (সহিহ বোখারী,
মুসলীম)। এটা শুধু আল্লাহ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস ছিল। আমরা যদি কিয়াস করে বলি
আলেমরা হল নবীদের ওয়ারিস যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থুথু,
ক্বফ, ঘাম, পোশাক ইত্যাদি দ্বারা সাহাবিগন বরকত হাসিল করতেন। তাই আমরাও এখন ভাবে
আমাদের পীর, বুজুর্গ, আকাবিরদের থুথু, ক্বফ, ঘাম, পোশাক ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাসিল
করব। তা হলে মহা ভুল করবেন কারন এটা শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
জন্য খাস ছিল। তা না হলে আমাদের পীরের পীর, বুজুর্গদের বুজুর্গ, অলীদির অলী, হযরত
আবু বক্কর (রা:) ,হযরত ওমর (রা:), হযরত আলী (রা:), হযরত ওসমানসহ (রা:) কোন সাহাবির
থুথু, ক্বফ, ঘাম, পোশাক থেকে কেউ বরকত লাভ করছেন বলে জানা যায় না। তাছাড়া আমরা
যাকে তার বাহিজ্জিক আমল আখলাক দেখে আল্লাহর অলী মনে করছি। মহান আল্লাহর কাছে সে
অলী না ও হতে পারে।
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন দসায় সাহারাগন (রা:) সময় এবং দুযোগ থাকা
স্বত্বেও যে সকল স্থান, সময় এবং ব্যক্তি থেকে বরকত নেন নাই সে সকল স্থান, সময় এবং
ব্যক্তি থেকে বরকত নেয়া যাবে না।
যেমন: স্থান হিসাবে:
হেরাগুহা, জাবারে শুর, জাবালে রহমত, মোহদায়ো ওহুদের কবর জিয়ারত করে বরকত হাসিল করা
যা কোন সাহাবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন দসায় বা ওফাতের পর
করেনি। ক্বাবা ঘরের গিলাফ, যে কোন মসজিদ বা মাজারের দেয়াল, মাটি, জানালা, দরজা
ইত্যাদি চুমু খাওয়া।
কাজেই সালাফিদের বক্তব্য হল: যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতি বিজরিত স্থান থেকে
কোন সাহাবি বরকত লাভ করেনি, সেখানে আমরা কি ভাবে বুযুর্গানে দ্বীন ও অলী আউলিয়াদের
স্মৃতি বিজরিত স্থান থেকে বরকত লাভ করব? তাদের মুল বক্তব্য “কুরআন সুন্নাহ দ্বারা
প্রমানিত স্থান ও বস্তু দ্বারা বরকত হাসিল করা যাবে, অন্য স্থান ও বস্তু দ্বারা
নয়।
দেখুন ব্রেলভীরা তদের
বুযুর্গানে দ্বীন ও অলী আউলিয়াদের সৃস্মি বিজরিত স্থান থেকে বরকত লাভ করার ফলে, কবরকে
মাজারে (দর্শনীয় স্থান) পরিনত করছে। কবর কেন্দ্রিক মসজিদ তৈরি করছে। কবরকে সিজদার
স্থাসে পরিনত করছে।
০৬। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারত প্রসঙ্গঃ
সালাফিরা
কবর জিয়ারত কে সুন্নাত মনে করে কিন্তু কবর জিয়ারত উদ্দেশ্যে সফর করা কে নাজায়িয
মনে করে থাকে। অপর পক্ষে, দেওবন্দীগণ রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারত ওয়াজিব বা এর কাছাকাছি মনে করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারতে যাওয়ার ব্যপারে দেওবন্দ আলেদের অরস্থান একেবারে স্পষ্ট। “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত
মতবাদ” বইটিতে একটা অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন “রওযায়ে আতহার যিয়ারতে যাওয়ার নিয়ত প্রসঙ্গে”। লেখক
এখানে সালাফি আলেম ইবনে তাইমিয়া (র) এর আনিত অভিযোগ খন্ডন করার নিমিত্তে তার (ইবনে
তাইমিয়া) উল্লেখিত হাদিসের (তিনটি স্থান ব্যতিত নেকির উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না)
ব্যাখ্যা ও কয়েক জন বিসিষ্ট ইসলামি
চিন্তাবিদের মতামত তুলে ধরেছেন। এবং বলেছেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারত জন্য সফর করা নেকির কাজ। (“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ”
পৃষ্ঠা – ৪৬৭)।
০৭। সালাফীদের বিশ্বাস আল্লাহ
তায়ালা স্বত্বাগতভাবে সাত আসমানের উপর আরশে আযীমে সমুন্নোত।
মাহান আল্লাহ সব জায়গায় স্বসত্বায় বিরাজমান
নন। বরং তার ক্ষমতা,
রাজত্ব, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, জ্ঞান, দৃষ্টি ইত্যাদি সর্বত্র ও সব কিছুতে বিরাজমান। কিন্তু তিনি স্বত্বাগতভাবে, সাত আসমানের উপর আরশে আযীমে
সমুন্নোত। যার সার সংক্ষেপ হল- মহান আল্লাহ্
আরশে সমুন্নোত রয়েছেন তিনি সর্বত্র সবকিছুতে বিরাজিত নয়।
যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন,
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
অর্থ: দয়াময় আল্লাহ আরশের
উপর সমুন্নত হয়েছেন।” (সূরা ত্বহা – ২০: ৫)
এই আয়াতসহ আরোও আট/নয়টি আয়াত তারা দলিল হিসাবে ব্যাবহার করে। (আকিদা ওয়াসেত্বীয়া পৃষ্ঠা
নম্বর ৩২; ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহঃ)
৮. সালাফীদের বিশ্বাস মহান আল্লাহ তাআলার আকার আছে কিন্তু
এই আকারের ধরণ জানিনা।
আল্লাহ তাআলার আকার সম্পর্ক সালবফীদের আকিদা হলঃ
মহান আল্লাহর আকার আছে কিন্তু এই আকারের ধরণ জানিনা। তাদের কথঅ হলো, আল্লাহর
সিফাতকে তাঁর কোন মাখ্লুকের সাথে সাদৃশ্য না করে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে
হবে। কেউ তার আকার আকৃতি কেমন তা জানেন না (সুরা শুরা-১১)। যেমনঃ আল্লাহ্র
ইয়াদ (হাত) আছে, ওয়াজহ (মুখমন্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে কারন কুরআনে আল্লাহ এগুলো
উল্লেখ করছেন। কুরআনে আল্লাহ যা কিছু
উল্লেখ করছেন যেমন হাত, মুখমন্ডল, নফস ইত্যাদি সবই তার বিশেষন কোন স্বরূপ
বা প্রকৃতি নির্নয় ব্যতিরিকে। (আবু হানিফা রচিত আল ফিকহুল আকবারের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা ড. আব্দুল্লাহ
জাহাঙ্গীর পৃষ্ঠা-২২৫)।
তাদের যুক্তিঃ আর যাকে দেখা
যাবে সে কি করে নিরাকার হতে পারে না। ব্যপারটা এমন নয় যে, তিনি এখন নিরাকার তবে
কিয়ামতের দিন সকার হয়ে যাবেন। কারণ আল্লাহকে পরিবর্তনশীল মনে করাটাও আকীদাহ
পরিপন্থি। তাদের দাবি, সর্বপরি নিরাকার কথাটি কোরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। (আকিদা ওয়াসেত্বীয়া পৃষ্ঠা
নম্বর ২৩-২৫; ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহঃ)।
০৯। সালাফিদের রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন কিন্তু বারজাকি হায়াতে (কবরের জীবনে) জীবিত
আছেন।
তাদের দলিল নিম্নের
আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যে, মানুষ মাত্রই মরণশীল এমন কি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এর উর্দ্ধে নন।
আল্লাহ্
সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ
إِنَّكَ
مَيِّتٌ۬ وَإِنَّہُم مَّيِّتُونَ (٣٠)
অর্থ: নিশ্চয়ই তুমিও মারা যাবে , এবং নিশ্চয়ই তারাও মারা যাবে। (জুমার ৩৯:৩০)।
যে দিন কোন মানুষ পৃথিবীতে জন্ম
লাভ করে, তার পরের দিন থেকেই শুরু হয়
তার মৃত্যুর দিকে পথযাত্রা। প্রতিটি জীবন মানেই মৃত্যু। নবী রসুলেরাও
এর ব্যতিক্রম নয়। এর উর্দ্ধে নয় কোন অলী আওলিয়া বা কোন পূণ্যাত্মা
মানুষ। পাপী ও
পূণ্যাত্মা সকলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে।পুর্বের কোন নবী
বা রাসুল ও এর উর্দ্ধে ছিলন না। কাফেররা মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিদ্রূপ
করতো যে তিনি যদি সত্য নবী হন তবে মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করবে না। এরই প্রেক্ষিতে
উক্ত আয়াত নাজেল হয়।
আল্লাহ্ সুবাহানাহুয়াতালা এরশাদ করেন:
وَمَا جَعَلۡنَا لِبَشَرٍ۬ مِّن قَبۡلِكَ
ٱلۡخُلۡدَۖ أَفَإِيْن مِّتَّ فَهُمُ ٱلۡخَـٰلِدُونَ (٣٤) كُلُّ
نَفۡسٍ۬ ذَآٮِٕقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةً۬ۖ
وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ (٣٥)
অর্থ: (পৃথিবীতে) তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করা হয়
নাই। সুতারাং তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরদিন বেঁচে
থাকবে ? প্রতিটি
আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমাদের মন্দ ও
ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমারই নিকট তোমরা ফিরে
আসবে, (আম্বিয়া ২১:৩৪-৩৫)।
সালফী আর দেওবন্দীদের মধ্যে মূল
পার্থক্য হলঃ সালাফিদের
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন কিন্তু বারজাকি হায়াতে (কবরের
জীবনে) জীবিত আছেন। অপরপক্ষে দেওবন্দীগন
বিশ্বাস করে, আমাদের মত কবরে জীবিত আছেন। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে পার্থির জীবনের ন্যয় জীবিকা নির্বাহ
করছেন। এতে কোন প্রকার সংশয় নেই। (‘আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদের বাংলা অনুবাদের নাম দেওবন্দী আহলে সুন্নাতের আকিদা পৃষ্ঠা নম্বর -২৮)।
১০।
সালাফিরা ওয়াহদাতুল ওজুদ আকিদায় বিশ্বাস করে না।
সলাফীদের মতে “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” নিঃসন্দেহ
একটি কুফরি আকিদা। এই “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” এর প্রবক্তা হল
সিরিয়ার সুফি ইবনুল আরাবীর। (কুরআন
সুন্নাহর মানদন্ডে সুফিবাদ, পৃষ্ঠা-১২, মুহাম্মাদ জামীল যাইনু, শিক্ষক, দারুল
হাদিস, মক্কা মুকার্রমা।)
দেোওবন্দের মুহাক্কিক আলেম
সমাজ ও এই আকিদাকে কুফরি মনে করে। যেমনঃ “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” বইটিতে ওয়াহদাতুল ওজুদ
সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “মুসলিম
মনীষিদের মধ্যে সর্ব প্রথম শায়েখে আকবর ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি উদ্ভাবন করেন এবং তার অনুসাবীগণ এটির
প্রচার ও প্রসার ঘটান। ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্ব হুবহু আল্লাহর অস্তিত্ব”। (“ইসলামী আকীদা
ও ভ্রান্ত মতবাদ” প্রকাশণায়; মাকতাবাতুল আবরার; পৃষ্ঠা -৫৪৭)।
কিন্তু দেওবন্দের প্রখ্যাত
আলেম হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজীরে মক্কী (রহ:), মাওলানা রশিদ আহমদ গংগুহী (রহ:) এবং হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ)
এরা সকলে এই “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” বিশ্বাসি ছিল। তাদের “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” ও
ইবনুল আরাবীর প্রবর্তিত “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” এর মধ্য
পার্থক্য ছিল। যেমনঃ মাওলানা আশরাফ আলি থানভী
(রহ:) বলেছেনঃ যখন মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে পাওয়ার জন্য মেহনত মুজাহাদা শুরু করে,
সর্বদা এর জন্য চিন্তা-ফিকির করে এবং এর পিছনে লেগে যায় তখন কেউ কেউ
এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে , তার
কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু অস্তিত্বহীন মনে হয় । এটা মানুষের
একটি অবস্হা, এরই নাম হোলো
ওয়াহদাতুল উজুদ। এটি সবার জন্য জরুরী নয়, তবে কারো কারো এ অবস্হা হতে পারে। (মসনবী শরীফ এর অনুবাদ)
অপর পক্ষে যে সকল দেওবন্দী পীর মাশায়েক ইবনে আরাবিকে শায়েকে আকবর মনে
করে, তার প্রবর্তিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষন গ্রহন করছেন তারাই বিভ্রান্ত হয়ে কুফরিতে
নিপতিত হয়েছেন।
“ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ”
সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে অত্র বইয়ের “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” অধ্যয়
দেখার জন্য অনুরোধ করা হল।
১১। সালফীদের আকিদা হল মানুষ মারা গেলে সে আর কার উপকার বা অপকার করতে পারে না, তাই তিনি যত বড় বুজুর্গ হন না কেন।
মুরুব্বি বা পীর মারা গেলে সে আর কার উপকার বা অপকার করতে পারে না, তাদের উপকার বা বরকত আশা করা স্পষ্ট শির্কেরই অন্তর্ভুক্ত।
কারন ভাবা হয় যেসব বিষয়ে
জীবিতদের ক্ষমতা নেই সেসব বিষয়ে বুঝি মৃতরা ক্ষমতাবান? অথচ আল্লাহ তাআলা বলছেন,
وَمَا يَسۡتَوِى ٱلۡأَحۡيَآءُ وَلَا
ٱلۡأَمۡوَٲتُۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُسۡمِعُ مَن يَشَآءُۖ وَمَآ أَنتَ بِمُسۡمِعٍ۬
مَّن فِى ٱلۡقُبُورِ (٢٢)
অর্থ: আর জীবিতরা ও মৃতরা এক
নয়, নিশ্চয় আল্লাহ যাকে
ইচ্ছা শুনাতে পারেন, কিন্তু যে
ব্যক্তি কবরে আছে তাকে তুমি শুনাতে পারবে না। (সূরা ফাতির ৩৫:২২)।
কাজেই কোনো মৃতব্যক্তি,
ওলী, পীর, মুরুব্বি, খাজা, প্রমুখ ব্যক্তিদের কাছে বরকত আশা করা শির্ক।
আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদে বর্ণিত মক্কা-মদিনার আলমগন প্রশ্ন করেছিলেন, আকাবিরদের সীনা বা করর থেকে আত্মিক ফয়েজ হাসিল হয় এ সম্পর্কে আপনাদের মত কি? এই প্রশ্নের উত্তর ছিল নিম্মরূপ।
মাশায়েখদের আত্মিক ফয়েজ হাসিলেন বিষয় আমাদের বক্তব্য হল:
তাদের সীনা মুবারক বা কবর শরীফ থেকে নি:সন্দেহে ফয়েজ হাসিল বা উপকার লাভ করা
সম্ভব। তবে যার যে যোগ্যতা আছে সেই এ উপকার লাভ করতে পারবে। (‘আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ পৃষ্ঠা নম্বর ৩৭, প্রশ্ন নম্বর ১১ এর উত্তর)।
0 Comments
Thanks for your comment