সর্বশেষ

2/recent/ticker-posts

মুরজিয়া ফির্কা

মুরজিয়া ফির্কা

ফির্কার নামঃ মুরজিয়া
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন
ইসলাম  ধর্মের আর একটি ফির্কার নাম মুরজিয়া’অনেকে কাছে এ গোষ্ঠীর নাম অপরিচিত হলেও এক সময় তাদের আবির্ভাব ঘটিছিল সদর্পেআজোও বিভিন্ন গোষ্ঠির মাঝে তাদের আকিদা পাওয়া যায়। পৃথিবীতে ভ্রান্ত এবং বিপথগামি সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম হল এই “মুরজিয়াগোষ্ঠী। ইতিহাসে যখন খারেজী ও শিয়াদের আবির্ভাব হয়, তখনই মুরজিয়াদের আবির্ভাব হয়। খারেজীরা ঘোষণা করেছিল সকল সাহাবী কাফের। কবিরা গুনাহকারিও কাফির। এমতাবস্থায় কিছু শিয়া উসমান, মোয়াবিয়া, আয়শা এবং আরো অনেককে কাফির ঘোষণা করে। মুরজিয়া গোষ্ঠী খারেজী ও শিয়াদের বিপরীত অবস্থান গ্রহন করে। তারা বলল কবিরা গুনাহের কারণে মুসলিমকে কাফির বলা যাবে না। এমনকি তারা সুস্পষ্ট শির্কে আকবার বা কুফরে আকবার করলেও ঈমান অক্ষুন্ন থাকে বলে প্রচার করলকিন্তু সালাফদের মানহাজ হল, খারেজীদের বিপরীতে, কবিরা গুনাহের কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় না। গুনাহকারি ফাসিক তাওবা না করে মৃত্যু বরন করলে পাপের শাস্তি ভোগ করবে এবং পরে জান্নাতে যাবে। আবার  মুরজিয়াদেরও বিপরীতে সুস্পষ্ট শিরকে লিপ্ত ব্যাক্তি মুমিন থাকে না। সুতারং সালাফদের মানহাজের বাহিরে গিয়ে যে নতুন ফির্কার উদ্ভব হল তার নাম ছিল ‘মুরজিয়া’।
নাম করন: শাব্দিকভাবে মুরজিয়া শব্দটি ‘ইরজাথেকে এসেছেআর ইরজা অর্থ  পিছিয়ে দেয়া, বিলম্বিত করা, অবকাশ দেওয়া বা পশ্চাৎবর্তি করা। মুরজিয়াগন ঈমান থেকে আমলকে বিলম্বিত করে এবং তাকফীরকে (কাফির বলাকে) বিলম্বিত করে। তাদের বিশ্বাস কাউকে তাকফীর করার অধিকার কারো নেই। আল্লাহই আখেরাতে সবাইকে বিচার করবেন। তাহলে এখানে কোন তাকফীর করা ইত্যাদি।
মুরজিয়া শব্দটি ‘ইরজাথেকে এসেছে যা কোরআনের কয়েকটি স্থানে উল্লেখ আছে। যেখানে ইরজা শব্দটি আশা প্রদান করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারন তারা আশা করে কবিরা গুনাহকারিকে কাফির থেকে অবকাশ দেওয়া হবেঅর্থৎ কাফির কে আশা প্রদান করে। যে আয়াতে ইরজা শব্দটি আশা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সে আয়াতে হল:
মহান আল্লাহ বলেন:
 وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لَا يَرْجُون
 এবং তোমরা আল্লাহর কাছে আশা কর, যা তারা আশা করে না। (সুরা নিসা ৪:১০৪)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
 مَا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا
তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্টত্ব আশা করছ না। (সূরা নূহ ৭১:১৩)। 
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَإِنَّ كُلاًّ۬ لَّمَّا لَيُوَفِّيَنَّہُمۡ رَبُّكَ أَعۡمَـٰلَهُمۡ‌ۚ إِنَّهُ ۥ بِمَا يَعۡمَلُونَ خَبِيرٌ۬ (١١١)
আর একথাও সত্যি যে, তোমার রব তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের পুরোপুরি বদলা দিয়েই তবে ক্ষান্ত হবেন৷ অবশ্যি তিনি তাদের সবার কার্যকলাপের খবর রাখেন৷ (সুরা হুদ ৭:১১১)
.
অতএব, ভাষাগতভাবে উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলির আলোকে মুরজিয়ারা সকল আমল ও কাজকে একপাশে রেখে তা বিশ্বাস থেকে আলাদা করে দেয়া। আর এভাবে তারা সকল পাপাচারীকে এই আশা দেয় যে তাদের পাপ তাদের ঈমানের সংগে সাংঘর্ষিক নয়। আসলে মুরজিয়ারা বিশ্বাস করে আমাল ও ঈমান কোনভাবে একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় এবং ঈমানের উপর আমলের কোনই প্রভাব নেই, চাই সেটা ইতিবাচকভাবে হোক কিংবা নেতিবাচকভাবে
সর্বপ্রথম যে ইরজাকরে তার নাম হল বাসর বিন আবদুল্লাহ আল হামদানি। তার সময়কার সকলে মানুষ তার বিরোধিতা করেছেন এবং তারা এমনকি কখনো তার সালামের জবাব দেননি। এরপর ইরজার এই বিদআত ইরাকের কুফায় ব্যাপক আকারে দেখা দিল। আর সেখানে মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম এর মত লোকেরা তার নেতৃত্ত দিচ্ছিল
মুরজিয়াদের দল ও উপদলসমুহ:
মুরজিয়ারা চারটি উপদলে বিভক্ত শ্রেণীরঃ
(১) খারেজি মনোভাবাপন্ন মুরজিয়া
(২) কাদরিয়া মনোভাবাপন্ন মুরজিয়া
(৩)জাবরিয়া মনোভাবাপন্ন মুরজিয়া
(৪) খালেছ মুরজিয়া
এই খালেছ মুরজিয়াদের ৫ টি ফির্কা আছে।
যেমন: ইউনুসিয়্যা, গাসসানিয়্যা, সাওবানিয়্যা, তাওমানিয়্যা, মুরিসিয়্যা। 

মুরজিয়াদের বিভক্ত পর্যালোচনা করে বলা যায় তারা মোটামুটি তিনটি দলে বিভক্ত:
(১) চরমপন্থী মুরজিয়া
() হকপন্থী মুরজিয়া
(). বিদাতি মুরজিয়া

চরমপন্থী মুরজিয়া: জাহম বিন সফওয়ান এবং তার অনুসারীরা বলে থাকে, ঈমান আনয়ন করা হচ্ছে কেবলমাত্র ক্বালব বা অন্তর দ্বারা সত্যায়ন করা এবং (ঈমানের বিষয়াদি সংক্রান্ত) জ্ঞান অর্জন করার নাম। তারা অন্তরের কাজকে ঈমানের অন্তর্ভূক্ত করে না। তারা ধারনা করে একজন মানুষ শুধুমাত্র অন্তর দ্বারাই কামেল ঈমানদার হয়ে যায়, যদিও সে এর পাশাপাশি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে গালি দেয়, আল্লাহর বন্ধুদের বিরূদ্ধে শত্রুতা করে, মসজিদ ধ্বংস করে, কুরআনের মাসহাফ কিংবা মুমিনদের চূড়ান্ত অবমাননা করে, কাফেরদের চূড়ান্ত পর্যায়ে সম্মান করে। জাহম বিন সফওয়ান ও তার অনুসারীরা বলে: এ সবগুলো কাজই গুনাহ, তবে ঈমানের বিপরীত নয়। কারণ ঈমান থাকে অন্তরে। বরং সে এ কাজগুলো করার পরেও বাতিনী বা অভ্যন্তরীনভাবে আল্লাহর দৃষ্টিতে একজন মুমিন।তারা বলে, এই ব্যাক্তির উপর দুনিয়াতে কাফেরের অনুরূপ হুকুম সাব্যস্ত হবে, যেহেতু এ কথাগুলো কুফরের লক্ষণ (তবে স্বয়ং কুফর নয়)
হকপন্থী মুরজিয়া: যে সকল মুরজিয়াগন মনে করে  কবিরা গুনাহকারি ফাসিক তাওবা না করে মৃত্যু বরন করলে পাপের শাস্তি ভোগ করবে অথবা ক্ষমা করবেন এবং পরে জান্নাতে যাবে। অনন্তকাল জহান্নামে থাকবে না। তাদের এই বিশ্বাস সরাসরি অধিকাংশ সালাফদের মানহাজের সাথে সামজস্যপূর্ণ বলেই তারা হকপন্থী।

বিদাতি মুরজিয়া: বিদাতি মুরজিয়া বলতে ঐ সকল মুরজিয়া বুঝান হয়েছে যারা মুরজিয়া নামে পরিচিত এবং যাদের ঈমান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সাথে সাংঘর্সিক।
  
মুরজিয়াদের আকিদা:
মুরজিয়াদের বিভিন্ন উপদলের আবির্ভাবের পর তাদের বিশ্বাসের মধ্যেও বিরাট তারতম্য সৃষ্টি হয়। তাই এখানে মুরজিয়া আকিদা বলতে শুধু চরমপন্থী মুরজিয়াদের আকিদা লেখা হল:

ক.  তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর বা ‘আল আসমা ওয়াস সিফাত’ কে নাকচ করে অথচ আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন:
وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِہَا‌ۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِىٓ أَسۡمَـٰٓٮِٕهِۦ‌ۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ (١٨٠)
সবচেয়ে সুন্দর নাম সমূহ আল্লাহ্‌র অধিকারভুক্তসুতরাং সেই নামেই তাঁকে ডাকযারা তাঁর নামকে অবজ্ঞা করে সে সব লোককে বর্জন করতারা যা করে শীঘ্রই তার প্রতিশোধ নেয়া হবে, (আরাফ- ৭: ১৮০)
 আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের কিছু উদাহরণ হল: আর রহমান (দয়াবান), আর রহীম (দয়ালু), আস সামী (সর্বদ্রষ্টা), আল বাসির (সর্বশ্রতা),আল আযিয(পরাক্রমশালী), আল হাকিম (প্রজ্ঞাময়), আল হালিম (সহনশীল), আর আলীম (সর্বজ্ঞ) আল আলীউল কাবির (সর্বোচ্চ), আল হাইউল (চিরঞ্জীব)
আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসূল সল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন:
‘‘আল্লাহর নিরানববই নামটি নাম রয়েছে যে ব্যক্তি সেগুলোর যথাযথভাবে আয়ত্ব করতে সক্ষম হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’(বুখারী, ২৭৩৬ ও মুসলিম, ২৬৭৭)
খ. তাদের কেউ কেউ জান্নাত ও জাহান্নামের পরিসমাপ্তিতে বিশ্বাস করে।
অথচ আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন:
بَلَىٰ مَن كَسَبَ سَيِّئَةً۬ وَأَحَـٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيٓـَٔتُهُ ۥ فَأُوْلَـٰٓٮِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ‌ۖ هُمۡ فِيهَا خَـٰلِدُونَ (٨١وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡجَنَّةِ‌ۖ هُمۡ فِيہَا خَـٰلِدُونَ (٨٢
যে ব্যক্তিই পাপ করবে এবং পাপের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে সে-ই জাহান্নামী হবে এবং জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকবে চিরকাল ৷  আর যারা ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে থাকবে তারা চিরকাল। (সুরা বাকারা ২:৮১-৮২।)
গ. ইমান বা বিশ্বাস কখনো বাড়েও না কমেও না এবং তারা সকলে একমত যে, বিশ্বাসের উপর আমাল কোনভাবেই প্রভাব ফেলে না, কোন কিছুই ক্ষতিসাধন করে না চাই সেটা বড় পাপ হোক কিংবা ছোট।
অথচ আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন:
إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُہُمۡ وَإِذَا تُلِيَتۡ عَلَيۡہِمۡ ءَايَـٰتُهُ ۥ زَادَتۡہُمۡ إِيمَـٰنً۬ا وَعَلَىٰ رَبِّهِمۡ يَتَوَكَّلُونَ (٢)
সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে৷ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে৷  (সুরা আনফাল ৮:২)।
ঘ. তাদের বিশ্বাস মহান আল্লাহ আদম আলাইহিস সালামকে নিজেন আকৃতিতে সৃষ্টি করছেন। অথচ মহান আল্লাহর আল কুরআনে বলা হয়েছে:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِي
অর্থ: কোন বস্তুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সব শোনেন, সব দেখেন। (সুরা শুরা ৪২:১১)

উম্মাহর মধ্যে মুরজিয়ার লক্ষণ:
বর্তমানের পথভ্রষ্ট লোকেরা কিছু ব্যাপারে সাধারণভাবে মুরজিয়ার বিশ্বাসের অনুসরণ করছে। বর্তমান যুগের মুরজিয়ারা যদিও মুখে মুখে এই দাবী করে যেন- ঈমান হচ্ছে অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি ও আমলের সমন্বয়কিন্তু বাস্তবে তারা নানা অযুহাতে আমলকে ঈমান এর বাইরে রেখে দেয়। সালাত আদায় না করলেও ইমানের দাবি করে। ইসলাম বিরোধী কার্যকালাপের হুকুম দানকারি হয়েও, পাক্কা ঈমানের দাবিদার। আসল পর্দা মনেন পর্দা, বলে বেপর্দা চলাফেরা করে। সুদ ঘুস হামার জেনেও প্রকাশ্যে সুদ ঘুস খাচ্ছে। আর মুরজিয়াদের মত দাবিকরে ঈমান হল আমল থেকে আলাদা।
সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইনউ

Post a Comment

0 Comments